রবিবার ইডেনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মনোজ তিওয়ারি। ছবি: পিটিআই।
রবিবারই ছিল মনোজ তিওয়ারি ক্রিকেট কেরিয়ারের শেষ ম্যাচ। বিহারকে হারিয়ে এ বারের মতো রঞ্জি ট্রফি অভিযান শেষ বাংলারও। সেই দিনই বিকেলে ইডেনে মনোজকে সংবর্ধনা দেওয়ার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বাংলার ক্রিকেট সংস্থা। যে বাংলার হয়ে রঞ্জি জেতাই ছিল মনোজের লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত সেই লক্ষ্য অধরাই থেকে গেল। ৩৮ বছর বয়সে অবসর নিলেন মনোজ। ক্রিকেটার হিসাবে তাঁর জীবনের একটি অধ্যায় শেষ হল। তারকাখচিত অনুষ্ঠানে শুধু দেখা গেল না ঋদ্ধিমান সাহা, অশোক ডিন্ডাদের।
সকালে ইডেনে বিহার ম্যাচ জিতে মনোজকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সতীর্থেরা। বিকেলের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিল গোটা বাংলা দল। কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্লের আহ্বানে মনোজের সতীর্থেরা মঞ্চে উঠে আসেন। অধিনায়ক মনোজকে নিয়ে ছবিও তোলে বাংলা দল। একটি পরিবার গড়ে তোলার বার্তা দিচ্ছিলেন কোচ। সামনে তখন বসে রয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মনোজ যাঁকে নিজের অনুপ্রেরণা বলে ঘোষণা করলেন মঞ্চে শেষ বার্তা দেওয়ার সময়। এমন একটা অনুষ্ঠানে শুধু দেখা গেল না বাংলা ছেড়ে ত্রিপুরায় চলে যাওয়া ঋদ্ধিমান সাহা এবং সুদীপ চট্টোপাধ্যায়কে। এক সময় মনোজের সতীর্থ ছিলেন তাঁরা। অনুষ্ঠানে দেখা গেল না অশোক ডিন্ডাকেও। বহু লড়াই অধিনায়ক মনোজ জিতেছেন যে পেসারের হাত ধরে। রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এখন দুই মেরুতে দু’জন। দেখা যায়নি প্রাক্তন ক্রিকেটার রণদেব বসু, শ্রীবৎস গোস্বামীকেও।
বাংলার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মনোজের অভিষেক হয়েছিল ২০০৪ সালে। রোহণ গাওস্করের নেতৃত্বে অভিষেক হয় তাঁর। ভিডিয়ো বার্তায় রোহণ জানালেন, তাঁর দেখা তরুণ মনোজ এখন কতটা পরিণত। মনোজের অভিষেক ম্যাচে বাংলার উইকেটরক্ষক ছিলেন দীপ দাশগুপ্ত। ধারাভাষ্য দিতে ব্যস্ত থাকায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি তিনি। দীপ ভিডিয়ো বার্তায় বলেন, “ছোটবেলায় মনোজের খুব মুখ চলত। কিন্তু ওর ব্যাটিং দেখে বুঝতে পারি যে, ছেলেটার শুধু মুখ নয়, ব্যাটও চলে।” মনোজ নিজেও মেনে নেন যে, ছোটবেলায় এমন অনেক কাজই করতেন, যা হয়তো ঠিক ছিল না। তিনি বলেন, “বয়স কম ছিল। বুঝতাম না। অনেক উদ্ধত ছিলাম। বয়সের সঙ্গে পরে পরিণত হয়েছি। সেটার জন্য আমার স্ত্রীয়ের কৃতিত্ব অনেক।”
মনোজ তিওয়ারির বিদায়ী অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে স্মারক তুলে দিলেন সিএবি প্রধান স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: সিএবি।
মনোজ সম্পর্কে বলতে উঠে সৌরভ বলেন, “মনোজ জীবনের সব চেয়ে মুল্যবান সময় বাংলাকে দিয়েছে। ভারতের হয়ে খেলেছে। কম ম্যাচ খেললেও তার দক্ষতা নিয়ে কখনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি জীবনে সঠিক সময়ে, সঠিক সুযোগটা পেতে হয়। সেটা সকলে সব সময় পায় না। তার মানে এটা নয় যে, কোনও ক্রিকেটার কম প্রতিভাবান।” ২০০৬ সালে রঞ্জি ফাইনালে মনোজের সঙ্গে ব্যাট করেছিলেন সৌরভ। সেই ঘটনার উল্লেখ করে সৌরভ বলেন, “মনোজ এবং আমি রঞ্জি ফাইনালে ৯০ রান করেছিলাম। সেই সময় আমার কেরিয়ারের শেষ পর্ব চলছে। কিন্তু মনোজের মধ্যে আমি একটা আগুন দেখেছিলাম। রান করার খিদে দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল, এই ছেলেটা ভারতের হয়ে খেলতে পারে।”
মনোজ ভারতের হয়ে খেলেছিলেন। ১২টি এক দিনের ম্যাচ এবং তিনটি টি-টোয়েন্টি খেলেছিলেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে শতরান করেছিলেন চেন্নাইয়ে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০ হাজার রানের মাইলফলক পার করেছেন মনোজ। রয়েছে ৩০টি শতরান। তাঁর কেরিয়ারের একটি ভিডিয়ো দেখানো হল বাংলার ক্রিকেট সংস্থার তরফে। সেখানে বাংলার জার্সি গায়ে বিভিন্ন ভিডিয়ো থাকলেও দেখা গেল না ভারতের জার্সিতে শতরানের সেই মুহূর্তের কোনও মুহূর্ত। যা ভিডিয়োটিকে আরও উজ্জ্বল করত বলেই মনে হয়েছে অনেকের।
ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে পিচে চুম্বন মনোজ তিওয়ারির। ছবি: পিটিআই।
বাংলার হয়ে শেষ ম্যাচ খেলে পিচে চুম্বন করে ক্রিকেটকে বিদায় জানান মনোজ। তাঁর বিদায়ী অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে মনোজ সম্পর্কে নানান কাহিনি বলেন সিএবি প্রধান স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাক্তন সিএবি প্রধান অভিষেক ডালমিয়া, মনোজ এক সময়ের সতীর্থ এবং এখন বাংলার কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্ল। মনোজের জীবনের কাহিনি শোনান বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং এখন বাংলার প্রধান নির্বাচক শুভময় দাশ। মনোজের পরিশ্রম এবং ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসার কথা সকলকে বলেন তাঁর সতীর্থ অনুষ্টুপ মজুমদার। ভিডিয়ো বার্তা দেন হরভজন সিংহ, মহম্মদ শামি এবং বাংলার বেশ কিছু ক্রিকেটার।
মনোজ তাঁর বিদায়ী বার্তায় স্মরণ করেন তাঁর বাবাকে। ২০১৭ সালে যিনি প্রয়াত হন। মনোজ জানান, সেই সময় তিনি আইপিএল খেলছিলেন। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। রবিবার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মনোজের মা। ছিলেন মনোজের স্ত্রী এবং ভাইও। মনোজের ক্রিকেট কেরিয়ার শেষ হলেও আগামী দিনে ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকার সম্ভাবনা প্রবল বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ মনোজ ক্রিকেটকে ছাড়লেও ক্রিকেট মনোজকে ছাড়বে না বলেই বিশ্বাস তাঁর প্রিয়জনদের।
গত বছর মনোজ রঞ্জি ফাইনালে হারের পর ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। পরে যদিও সেই সিদ্ধান্ত আবেগের বসে নেওয়া বলে জানান। অবসর ভেঙে ফিরে আসেন ক্রিকেটে। তবে এই মরসুমটাই শেষ বলে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল বাংলাকে রঞ্জি জিতিয়ে ক্রিকেটকে বিদায় জানানো। কিন্তু তা সম্ভব হল না।