বিশ্বকাপে দাপট আফগানিস্তানের। —ফাইল চিত্র।
সৈয়দ মুজতবা আলী ‘দেশে-বিদেশে’ বইয়ে লিখেছিলেন, “দিনের বেলা পেশওয়ার ইংরেজের, রাত্রে পাঠানের।” এ বারের বিশ্বকাপে ইংরেজদের হারানো আফগানিস্তান এখন শুধুই ১৫ জন পাঠানের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হেরে এ বারের প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিতে হলেও আফগানেরা মন জয় করে নিয়েছেন।
এখন পেশওয়ার পাকিস্তানের অংশ হলেও স্বাধীনতার আগে পাঠানমুলুক বলতে পেশওয়ারকেই বোঝানো হত। মুজতবা আলির দেখা সেই দেশ এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। যে আড্ডাবাজ পাঠানদের কথা তিনি লিখেছিলেন এখন আর তা দেখতে পাওয়া দায়। গুলি, বোমার আওয়াজে আফগানিস্তানের মানুষেরা এখন সন্ত্রস্ত। এই বদলে যাওয়া শুধু মানুষে আটকে নেই। আরও অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে।
বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের যে পতাকা দেখা গেল, সেটা আসলে সে দেশের পতাকাই নয়। কালো, লাল এবং সবুজ রঙের যে পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে রশিদ খানেরা জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন, সেই পতাকা বাতিল হয়ে গিয়েছে তালিবানের আফগানিস্তানে। বাতিল হয়ে গিয়েছে জাতীয় সঙ্গীতটিও। তালিবানের দেশে এখন আর কোনও জাতীয় সঙ্গীত নেই। এখনকার আফগানিস্তানে এই পতাকা বা জাতীয় সঙ্গীত না থাকলেও রশিদেরা আছেন। তাঁদের সাফল্যে আফগানিস্তান জুড়ে আনন্দ আছে, উৎসব আছে। হয়তো শুধু এটাই আছে!
বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলতে নামার আগে জাতীয় সঙ্গীতের জন্য দাঁড়িয়ে আফগান দল। ছবি: পিটিআই।
২০২১ সালের ১৫ অগস্ট, আফগানিস্তান সরকারের থেকে শাসনভার কেড়ে নেন তালিবেরা। দেশের সব বিষয়ে তাঁরা ঢুকলেও বাদ দিয়েছিলেন ক্রিকেটকে। বলা ভাল ছেলেদের ক্রিকেটকে। কারণ মেয়েদের ক্রিকেট এখনও বন্ধ আফগানিস্তানে। রশিদদের ক্রিকেট বোর্ডের দফতরে যদিও ঢুকেছেন তালিবেরা। কিন্তু ক্রিকেট খেলা নিয়ে কোনও আপত্তি নেই তাঁদের। রশিদদের খেলাতেও তালিবদের কোনও প্রভাব দেখা যায়নি। আসলে আফগানিস্তানে দ্বিতীয় বার শাসন করতে এসে তালিবেরা চাইছেন গোটা বিশ্বের সঙ্গে মিশে যেতে। আর সেখানে ক্রিকেটের থেকে ভাল মাধ্যম আর কী হতে পারে?
বিশ্বকাপে রশিদেরা ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, নেদারল্যান্ডস এবং শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে। সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ছিল তারা শেষ ম্যাচ পর্যন্ত। প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিরুদ্ধে জয়গুলি রশিদদের নায়ক করে দিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ তাকিয়েছিলেন বিশ্বকাপের দিকে। সেই মঞ্চে মহম্মদ নবি, নবীন উল হক, মুজিব উর রহমান, হসমতুল্লা শাহিদিরা পারফর্ম করছেন এবং দেশের মানুষকে বহু কষ্টের মাঝে আনন্দ এনে দিচ্ছেন। অনেকে মনে করছেন বিশ্বকাপে আফগানদের সাফল্য ইতিমধ্যেই দেশের ক্রিকেটকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। আগামী দিনেও যা এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
কাবুলিওয়ালাদের দেশ আফগানিস্তান। এক সময় কলকাতায় খুব সহজেই দেখা মিলত তাঁদের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে রহমত শুধু একটা চরিত্র ছিল না, কাবুল সম্প্রদায়ের প্রতীক ছিল। ভারতের দিল্লিতে এখনও বহু কাবুলিওয়ালার বাস। দিল্লিতে ম্যাচ খেলার সময় রশিদেরা তাই ভাল সমর্থনও পেয়েছেন। রশিদদের খেলা শুধু তাঁদের আনন্দ দিয়েছে এমন নয়, দেশের মানুষেরও মনোরঞ্জন করেছে। রশিদ বলেন, “আমাদের জন্য দেশের মানুষ প্রার্থনা করছেন। আমাদের খেলা দেখার জন্য টিভির সামনে বসছেন। আফগানিস্তানে ক্রিকেটটাই একমাত্র আনন্দের। বাকি আর কিছু নেই।”
২০১০ সালে আফগানিস্তান ক্রিকেটের কোচ হয়েছিলেন রশিদ লতিফ। তিনি একটি ঘটনার কথা জানান। রশিদ বলেন, “আফগানিস্তানের ক্রিকেটারেরা যে মাঠে অনুশীলন করত, সেখানে এক দিন সকালে দেখা গেল আমেরিকার হেলিকপ্টার ভেঙে পড়েছে।” এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই চলে আফগানিস্তানের ক্রিকেট। লতিফ আরও বলেন, “আফগানিস্তানের মিরওয়াইস আশরফের অভিষেক হয়েছিল আমি কোচ থাকার সময়। ও আমাকে দেখিয়েছিল ভেঙে পড়া হেলিকপ্টারটা। এখনও ওর সঙ্গে যোগাযোগ আছে আমার। আশরফ এখন চেষ্টা করছে আফগানিস্তানে ক্রিকেটের প্রচার বৃদ্ধি করতে। আফগানিস্তানের যে দলকে আমি প্রশিক্ষণ দিতাম, তারা বেশির ভাগ পেশওয়ারের উদ্বাস্তু। এখন আফগান দলে যারা খেলছে, তারা তালিবান যুদ্ধের শিকার। এই দু’টি দলের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল আছে। যুগ পেরিয়ে গেলেও এই সব ক্রিকেটারের খেলার প্রতি আবেগটা এক রকম রয়ে গিয়েছে।”
বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের প্রথম শতরানকারী ইব্রাহিম জাদরান। ছবি: পিটিআই।
মহম্মদ খান জাদরানের হাত ধরে রহমনুল্লা গুরবাজ, ইব্রাহিম জাদরান এবং মুজিব উর রহমানের মতো ক্রিকেটারেরা উঠে এসেছেন। সেই জাদরান বলেন, “আফগানিস্তানে ৫০০০ ক্রিকেট ক্লাব রয়েছে। শুধু খোস্ট জেলাতেই ১১০টা ক্লাব আছে। প্রতি জুন থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত ক্লাব ক্রিকেট খেলা হয়। সেখান থেকে গ্রেড ২ ক্রিকেটার বেছে নেওয়া হয়। সেই ক্রিকেটারদের নিয়ে খেলা হয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। মার্চ এবং এপ্রিলে হয় গ্রেড ১ ক্রিকেটারদের নিয়ে খেলা। সেটাই এই দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। সাদা বলের ক্রিকেট হয় জুন-জুলাইয়ে। এ ছাড়াও স্কুল ক্রিকেট আছে।”
আফগানিস্তানে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরু হয় ২০১৫-১৬ মরসুমে। সেই সময় থেকেই আফগান ক্রিকেট বোর্ড চেষ্টা করে ক্রিকেটের সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তির উন্নতি করতে। আফগানিস্তানের অধিনায়ক হসমত বলেন, “এখন আফগান ক্রিকেট বোর্ড ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য প্রতি মরসুমে প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা খরচ করে। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা হয় ১৬-১৭টা মাঠে। ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতি হচ্ছে বলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দল ভাল খেলছে।”
আফগানিস্তান প্রথম বার বিশ্বকাপ খেলেছিল ২০১৫ সালে। সে বারেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল তারা। সেই সময় অঘটন ছিল মহম্মদ নবির দলের জয়। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে কোনও ম্যাচ জিততে পারেনি আফগানিস্তান। কিন্তু এ বার চারটি ম্যাচ জিতে নিয়েছে তারা। রশিদদের খেলায় পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট। এ বারে রশিদেরা কোমর বেঁধেই নেমেছিলেন। এখন আর তাই আফগানিস্তান কাবুলিওয়ালার দেশ নয়, ক্রিকেটেরও দেশ।