নজরে: ১৯ ফেব্রুয়ারি মিলানের সান সিরো স্টেডিয়ামের সেই ম্যাচ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মুখোমুখি আটলান্টা-ভ্যালেন্সিয়া। আশঙ্কা, এই বিশাল সমাবেশ থেকে ছড়িয়ে থাকতে পারে করোনা। ফাইল চিত্র
ইটালির বার্গামো শহরে দাবানলের মতো করোনাভাইরাসের অতিমারি ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে কি কোনও ফুটবল ম্যাচ? সে দেশের ডাক্তার মহল থেকে এ রকমই একটা আশঙ্কা প্রকাশ করা শুরু হয়েছে।
ইটালির প্রথম সারির একটি সংবাদপত্রে ইমিউনোলজিস্ট ফ্রান্সেসকো লে ফোকে বলেছেন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আটলান্টা বনাম ভ্যালেন্সিয়া ম্যাচে বিপুল জনসমাবেশ হয়েছিল। লোম্বার্ডি অঞ্চলের বার্গামোতেই আটলান্টা ক্লাব অবস্থিত। সরকারি হিসাব বলছে, সে দিন মিলানের সান সিরো স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছিলেন চল্লিশ হাজারের উপর ফুটবলভক্ত। বার্গামো থেকে দলে-দলে মানুষ যান খেলা দেখতে। পরে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসে ইটালিতে সব চেয়ে আক্রান্ত শহর এই বার্গামোই। ইটালির ডাক্তারদের এখন মনে হচ্ছে, এই বিপুল জনসমাবেশ থেকেই দ্রুত ছড়িয়ে থাকতে পারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। তখনও অতটা সাবধানী হননি কেউ।
পাওলো রোসি, জানলুইগি বুফন, রবার্তো বাজ্জোদের দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগ ‘সেরি আ’-তে খেলে আটলান্টা। ঘরের মাঠে বিপুল জনসমর্থনে বলিষ্ঠ হয়ে তারা ৪-১ হারিয়েছিল স্পেনের ভ্যালেন্সিয়াকে। ফ্রান্সেসকো বলছেন, ‘‘এত ভয়ঙ্কর ভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে আটলান্টা-ভ্যালেন্সিয়া ম্যাচও থাকতে পারে।’’
ইটালীয় ক্লাবের জয় দেখে সে দিন উৎফুল্ল জনতা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছিল, হাতে হাত মিলিয়ে উৎসব করছিল। তাতে সর্বনাশ হয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা। বার্গামোতে যে ভাবে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা, তাতে ডাক্তারদের একাংশের এই আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলে মত। এমনই করুণ পরিস্থিতি সেখানে যে, মৃতদের সমাধিস্থ করার জায়গাও ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না সমাধিস্থলে। যাঁদের সমাধিস্থ করা যাচ্ছে না, সেই সব কফিন তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর ট্রাক।
ডাক্তার ফ্রান্সেসকোর সংযোজন, ‘‘১৯ ফেব্রুয়ারির ওই ম্যাচের পরে এক মাস পেরিয়ে গিয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ চরম আকার নেয় সংক্রমণ শুরুর এক মাসের আশেপাশে।’’ চল্লিশ হাজার মানুষ গা ঠেসাঠেসি করে, একে অন্যের থেকে এক সেন্টিমিটারের থেকেও কম দূরত্বে বসে আছেন! মৃত্যুপূরীতে পরিণত ইটালিতে বসে অনেকে এখন ভাবতে গিয়েও সবাই শিউরে উঠছেন! যেখানে মানুষের জমায়েতই করোনাভাইরাস রোধের সব চেয়ে বড় শত্রু। ফ্রান্সেসকো বলছেন, ‘আমার মনে হয়, অনেকে জ্বর বা সর্দি-কাশি থাকলেও ম্যাচ দেখতে যাওয়া বাতিল করতে চায়নি। আগে থেকে টিকিট কিনে রেখেছে। কে আর ম্যাচ দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়?’’ তার পরেই ডাক্তারের উপলব্ধি, ‘‘হয়তো তখন কেউ বুঝতে পারেনি। কারণ, ততটা ছড়ায়নি সংক্রমণ। ফিরে তাকিয়ে দেখলে এখন মনে হচ্ছে, সে দিন অত লোকের সমাবেশ সর্বনাশ ডেকে এনেছে!’’
ওই ম্যাচ দেখতে আসা দর্শকদের অনেকের কয়েক দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাস পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ ফল আসে। স্পেন থেকে খেলতে আসা ভ্যালেন্সিয়া দলের পঁয়ত্রিশ শতাংশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হন। একা ফ্রান্সেসকো নন, এমন সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন ইটালির আরও কয়েক জন ডাক্তার। বার্গামো থেকে সড়কপথে মিলান এক-দেড় ঘণ্টার পথ। ম্যাচের দিন সেই সড়কপথে এত গাড়ি ছিল যে, ট্র্যাফিক জ্যামে বহুক্ষণ আটকে থাকেন অনেক মানুষ।
বার্গামোয় পোপের নামাঙ্কিত হাসপাতালের ফুসফুস সংক্রান্ত রোগের প্রধান ফাবিয়ানো ডি মার্কো বলেছেন, ‘‘করোনার প্রকোপ এত দ্রুত, এত সাংঘাতিক ভাবে ছড়িয়ে পড়ার একাধিক কারণ থাকতে পারে। তবে আমি মনে করি, ১৯ ফেব্রুয়ারির ওই ম্যাচ। জনতার বিস্ফোরণ ঘটেছিল সে দিন।’’ ইটালি এর ফাঁকা মাঠে ম্যাচ আয়োজন করে কিন্তু তত ক্ষণে সম্ভবত অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
ফাবিয়ানো জানিয়েছেন, কী ভাবে তাঁদের হাসপাতালে মুহূর্তের মধ্যে বদলে গিয়েছিল করোনা নিয়ে পরিবেশ। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম তাঁরা বুঝতে পারেন করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে রোগী আসা শুরু হয়েছে। রাত আটটা নাগাদ তিনি প্রথম মোবাইল বার্তা পান। কিন্তু তখনও পরিস্থিতি সামাল দিতে না-পারার মতো কিছু ঘটেনি। শুক্রবারে প্রথম করোনা-আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়। রবিবার দুপুরের মধ্যে তাঁদের হাসপাতালের সংক্রমণ ব্যাধিতে আক্রান্ত বিভাগ ভর্তি হয়ে যায়। তখনও কেউ বুঝতে পারেননি, হিমশৈলের চূড়া দেখা গিয়েছে মাত্র। এর পর ফাবিয়ানোর কথায়, ‘‘সব কিছু বদলে গেল ১ মার্চ। হাসপাতালে পৌঁছে বুঝতে পারিনি, হাসপাতালে এসেছি না যুদ্ধক্ষেত্রে! যে দিকে চোখ যায়, শুধু নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী। সব ঘর তো উপচে পড়ছেই, এমনকি করিডরগুলোও ভর্তি। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক স্ট্রেচার। সকলের শ্বাসকষ্ট। আতঙ্ক, আতঙ্ক!’’
আটলান্টার ফুটবল অ্যাকাডেমিকে বলা হয় ইটালির ‘লা মাসিয়া’। সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার গাইতানো সিরেয়া থেকে শুরু করে রবার্তো ডোনাডিনি, আলেসিয়ো ডোমেঙ্গিনি— দারুণ সব ফুটবলার উপহার দিয়েছে তারা। কে ভাবতে পেরেছিল, ফুটবলপ্রেম এক দিন ডেকে
আনবে মৃত্যুমিছিল!