চর্চায়: সেই মুহূর্ত। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে গোল করার পথে লিভারপুলের গোলরক্ষক অ্যালিসন। ছবি সংগৃহীত।
লিভারপুলের ১২৮ বছরের ইতিহাসে অ্যালিসন বেকার-ই একমাত্র গোলরক্ষক, যিনি গোল করেছেন। রবিবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ওয়েস্ট ব্রমউইচের বিরুদ্ধে তাঁর বিস্ময় গোল নিয়েই এই মুহূর্তে চর্চা তুঙ্গে বিশ্বফুটবলে। অভিভূত ভারতের ফুটবলের অন্যতম সফল চার গোলরক্ষক— হেমন্ত ডোরা, সুব্রত পাল, তনুময় বসু এবং অতনু ভট্টাচার্যও।
আগামী মরসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে যোগ্যতা অর্জনের জন্য ইপিএল টেবলে প্রথম চারে থাকতেই হবে লিভারপুলকে। অথচ ওয়েস্ট ব্রমের বিরুদ্ধে ম্যাচের ১৫ মিনিটেই পিছিয়ে পড়েছিল তারা। ৩৩ মিনিটে মহম্মদ সালাহ সমতা ফেরালেও উদ্বেগ দূর হয়নি য়ুর্গেন ক্লপদের। সংযুক্ত সময়ে লিভারপুল কর্নার পেতেই গোল ছেড়ে অ্যালিসন উঠে যান বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে। অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ট্রেন্ট আলেকজ়ান্ডার-আর্নল্ডের কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে লিভারপুলকে নাটকীয় জয় উপহার দেন ব্রাজিলীয় গোলরক্ষক।
ভারতীয় দলের প্রাক্তন গোলরক্ষক হেমন্ত স্ট্রাইকার হিসেবেও সফল। জাতীয় পর্যায়ে অনূর্ধব-২১ বাংলা দলের হয়ে ফরোয়ার্ডেও খেলেছেন তিনি। হেমন্ত বলছিলেন, “এর আগে রেনে হিগুইতা, হোসে লুইস চিলাভার্ট, জর্জ ক্যাম্পোসকে গোল করতে দেখেছি। সেই ধারাই বজায় রাখল অ্যালিসন। মানসিক ভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী না হলে গোলরক্ষকদের পক্ষে এ ভাবে উঠে গিয়ে গোল করা সম্ভব নয়। কারণ, তাদের মূল দায়িত্বটা থাকে গোল বাঁচানোর। বিপক্ষের বক্সে উঠে গোল করার সাহস অনেকেই দেখাতে পারে না। যারা পারে, তারাই ব্যতিক্রম। যেমন অ্যালিসন।” তিনি যোগ করলেন, “অনেক সময় কোচেরাও এই ধরনের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেন না গোলরক্ষকদের। কারণ, বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে তখন নিজের দলের এক জন ফুটবলার তো বেশি থাকবে। যদি গোল হয়! তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয় গোলরক্ষককেই।”
ভারতীয় ফুটবলের সর্ব কালের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক সুব্রতর কথায়, “অ্যালিসনের হার-না-মানা মানসিকতাকে কুর্নিশ। প্রত্যেক ফুটবলারেরই কর্তব্য দলকে জেতানো। অ্যালিসন নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করছে।” ভারতীয় ফুটবলের ‘স্পাইডারম্যান’ যোগ করলেন, “আমিও অনেক ম্যাচে বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে উঠে গিয়েছি। যদিও গোল করতে পারিনি। অ্যালিসনের গোলের ক্ষেত্রে সব কিছুই ঠিক মতো হয়েছিল। অর্থাৎ, আলেকজ়ান্ডার-আর্নল্ড বলটা অসাধারণ রেখেছিল। অ্যালিসনও ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। আমার কাছে এই গোলের চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ লিভারপুল গোলরক্ষকের দলের প্রতি দায়বদ্ধতা ও শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা।” সুব্রত আরও বললেন, “আমরা হয়তো লক্ষ্য করিনি, এর আগেও অনেক ম্যাচে অ্যালিসন গোল করতে উঠেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। তাতে ও ভেঙে পড়েনি। হয়তো মনে মনে শপথ করেছে, পরের বার আমি গোল করবই। এই জেদের জন্যই লিভারপুলের ম্যানেজার ও অন্যান্য ফুটবলারদের আস্থা ছিল ওর উপরে।” কী ভাবে? সুব্রত বললেন, “ম্যানেজার ওকে বলতেই পারতেন, নিজের গোল ছেড়ে তোমার উঠে যাওয়ার দরকার নেই। একই রকম ভাবে সতীর্থরাও বলতে পারত, তুমি পেনাল্টি বক্সের বাইরেই থাকো। তা কিন্তু হয়নি। যা বাড়তি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল অ্যালিসনকে।”
জাতীয় দল ও কলকাতা ময়দানের আর এক তারকা গোলরক্ষক তনুময় বসু বলছিলেন, “নিজের গোল ছেড়ে উঠে গিয়ে গোল করার জন্য সাহস দরকার। সব গোলরক্ষকের এই ক্ষমতা নেই। দ্বিতীয়ত, এর জন্য যে ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন, তা সকলের থাকে না।”
কী ধরনের দক্ষতা? তনুময়ের ব্যাখ্যা, “এক জন সফল স্ট্রাইকার বা মিডফিল্ডারের সমস্ত গুণ থাকতে হবে গোলরক্ষকের মধ্যে। অর্থাৎ, বলের উপরে নিয়ন্ত্রণ, নিখুঁত শট ও জায়গা নেওয়ার ক্ষমতা থাকতেই হবে। পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে, যদি গোল করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে প্রতিআক্রমণের সময় দ্রুত নেমে যেতে হবে নিজের বক্সে। আমার নিজেরও সেই দক্ষতা ছিল না। তাই কখনও ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাইনি। তা ছাড়া এর জন্য নিয়মিত অনুশীলনও করতে হয়।”
এশিয়ান অলস্টার দলে সুযোগ পাওয়া বঙ্গ গোলরক্ষক অতনু ভট্টাচার্যের মতে, অ্যালিসনের মতো গোল অনেক স্ট্রাইকারও করতে পারবেন না। বললেন, “বিশ্বমানের গোল করেছে অ্যালিসন। এক জন গোলরক্ষকের দায়িত্ব শুধু গোল বাঁচানোই যে নয়, তা প্রমাণ করেছে ও। অ্যালিসনের জন্য গর্বিত।”