পদক জয়ের পর অচিন্ত্য। ছবি: পিটিআই
অচিন্ত্য শিউলি।
এই শিউলি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করেন না। ওজন তোলেন। যে হাত এক সময় সোনালি, রুপোলি জরি নকশা তুলত, সেই হাতই ওজন তোলে। ওজন তুলে পদক জেতে।
জরির কাজ করা হাত দু’টোর ভীষণ চেনা পদকের রং। সেই রঙের পদকই শোভা পাচ্ছে অচিন্ত্যর গলায়। বার্মিংহ্যাম কমনওয়েলথ গেমসে ভারোত্তোলনের ৭৩ কেজি বিভাগে সোনা জিতেছেন হাওড়ার পাঁচলার দেউলপুর গ্রামের ২০ বছরের যুবক। এমন সাফল্যের পরও অচিন্ত্য বলেছেন, ‘‘সোনা জেতার লক্ষ্য নিয়ে বার্মিংহ্যাম আসিনি। চেয়েছিলাম নিজের সেরা পারফরম্যান্স করতে। সেটা করতে না পারায় একটু খারাপ লাগছে।’’ স্ন্যাচ এবং ক্লিন-জার্ক মিলিয়ে ৩১৩ কেজি ওজন তুলে গেমস রেকর্ড গড়েও সন্তুষ্ট নন অচিন্ত্য! আরও সাফল্য চান আত্মবিশ্বাসী বঙ্গসন্তান। কমনওয়েলথ গেমসে সাফল্যের রং সোনালী হলেও তাঁর চলার পথ এমন ঝকঝকে নয়। বরং কঠিন, রুক্ষ। গ্রামের ছেলে সেই রুক্ষ জমিতেই সোনা ফলিয়েছেন।
ন’বছর আগে মারা যান ভ্যানচালক বাবা। নেমে আসে চরম দারিদ্র। অভাবের সংসারের জোয়াল টানতে মায়ের সঙ্গে জরির কাজ করতে হত অচিন্ত্যকে। ২০১০ সালে ভারোত্তোলন শুরু। দাদা অলোক শিউলির হাত ধরে পৌঁছন কোচ অষ্টম দাসের কাছে। সঙ্গী ছিল দারিদ্র। সম্বল ছিল জেদ। অলোকেরও স্বপ্ন ছিল বড় ভারোত্তোলক হওয়ার। সংসারের ভার বইতে গিয়ে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবু ভাইয়ের স্বপ্নভঙ্গ হতে দেননি। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন ভাইকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিতে।
দেউলপুরের ভাঙাচোরা টালির বাড়িতেই দিনের পর দিন স্বপ্ন বুনেছেন অচিন্ত্য। সোমবার সকাল থেকে সেই বাড়িই বিশেষ দ্রষ্টব্য। অচিন্ত্যর বাড়ি দেখতে আসছেন বহু মানুষ। আট থেকে আশি সকলেই তাঁর মা-দাদাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। মা পূর্ণিমা শিউলি বলেন, ‘‘স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে খুব কষ্টে দিন কেটেছে। দুই ছেলেকে নিয়ে জরির কাজ করে কোনও রকমে দু’টো ভাত জুটত।’’ অলোক বলেন, ‘‘ভাই পরিশ্রমের ফল পেয়েছে। অনেক লড়াই, অনেক কষ্ট করতে হয়েছে ওকে।’’ ভাইয়ের পাশে আরও ভাল ভাবে দাঁড়াতে একটা চাকরি চান তিনি। বলেন, ‘‘দমকল বিভাগে অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কাজ করি। একটা পাকা চাকরি হলে ভাল হয়।’’ অচিন্ত্যর সাফল্য ভাঙা বাড়িতে খুশি জোয়ার এনেছে। কিন্তু, অর্থকষ্ট কি ঘোচাতে পারবে?
অচিন্ত্যকে নিয়ে গর্বিত অষ্টম বলেছেন, ‘‘যখন আমার কাছে প্রথম আসে, তখন দেখে মনেই হয়নি ভারোত্তোলন করতে পারবে। খুব রোগা ছিল। তবে অচিন্ত্য খুব তাড়াতাড়ি শিখতে পারত।’’ আগামীর অচিন্ত্যদের জন্য সরকারি সাহায্য চান কোচ অষ্টম। নিজে শেখানোর জন্য টাকা নেন না। চাষ বা মাটি কাটার কাজ করে সংসার চালান। তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে যারা শেখে, তারা অনেকেই প্রতিভাবান। কিন্তু কোনও পরিকাঠামো নেই। গাছের ছায়ায় অনুশীলন করাই। সরকারি সাহায্য পেলে আর একটু ভাল করে তৈরি করতে পারি ছেলেময়েগুলোকে।’’
অলোক, অষ্টমরা পিছনে থেকে অচিন্ত্যকে সাফল্যের রাস্তায় পৌঁছতে সাহায্য করেছেন। বার্মিংহ্যামে সোনা জয়ের পর তাই অচিন্ত্যর মুখে উঠে এসেছে দাদা এবং ছোটবেলার কোচের কথা। কমনওয়েলথ গেমসের পদক তিনি তাঁদেরই উৎসর্গ করেছেন।
ভরোত্তোলকদের পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। অচিন্ত্যর পুষ্টিকর খাবার বলতে ছিল সিদ্ধ ডিম আর ঘুঘনি। সেই ডিম আর ঘুঘনির জন্যও ধান কাটতে যেতে হত তাঁকে।
অচিন্ত্যর বন্ধু বাদল বর জানিয়েছেন, পুণেতে সেনাবাহিনীর স্পোর্টস ইনস্টিটিউটে সুযোগ পাওয়ার পর পরিস্থিতি বদলায়। অনুশীলন এবং পড়াশোনার সুযোগ পায়। তার আগে পর্যন্ত খুবই কষ্টে কেটেছে অচিন্ত্যর।
হাওড়ার দেউলপুরে অচিন্ত্যর বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।
২০২০ সালে অচিন্ত্যকে পুরস্কৃত করে রাজ্য সরকার। তার পর আর তেমন সরকারি সাহায্য মেলেনি তাঁর। বার্মিংহ্যামের সাফল্যের পর অবশ্য দেউলপুরের যুবককে অভিনন্দন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনন্দন জানিয়েছেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
কমনওয়েলথ গেমসে অচিন্ত্যর সোনার সাফল্য কি দিন বদলাতে পারবে। গত বছর পাওয়া সার্ভিসেসের চাকরি স্বস্তি দিলেও সমস্যা মেটেনি। আর কত ওজন তুললে ঢাকা পড়বে সব সমস্যা?