ইউএস ওপেন জিতে উল্লাস কোকো গফের। ছবি: টুইটার
এ ভাবেও ফিরে আসা যায়। প্রথম সেট দেখে মনে হয়েছিল বেলারুসের এরিনা সাবালেঙ্কার সামনে দাঁড়াতে পারবেন না আমেরিকার কোকো গফ। কিন্তু ফিরলেন তিনি। শুধু ফিরলেন না, প্রথম সেট হেরে যাওয়ার পরেও বিশ্বের দ্বিতীয় বাছাই সাবালেঙ্কাকে ২-৬, ৬-৩, ৬-২ গেমে হারিয়ে জিতলেন ইউএস ওপেন। সেই সঙ্গে ছুঁয়ে ফেললেন সেরিনা উইলিয়ামসকে। ১৯৯৯ সালে শেষ বার কিশোরী সেরিনা জিতেছিলেন ইউএস ওপেন। এই শতাব্দীতে প্রথম কিশোরী টেনিস খেলোয়াড় হিসাবে সেই কীর্তি ছুঁলেন গফ। জিতলেন নিজের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম। ক্রমতালিকায় ছ’নম্বর থেকে উঠে এলেন তিন নম্বরে।
চলতি বছরের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছিলেন সাবালেঙ্কা। ফরাসি ওপেন ও উইম্বলডনে সেমিফাইনালে বিদায় নিয়েছিলেন। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে বছরের শেষটা করার সুযোগ ছিল তাঁর। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মহিলা টেনিস খেলোয়াড় ইগা শিয়নটেক আগেই বিদায় নেওয়ায় বিশ্বের এক নম্বর হয়েই ফাইনালে নেমেছিলেন শিয়নটেক। কিন্তু ফাইনালে হেরে গেলেন তিনি। সাবালেঙ্কাকে হারিয়ে দিল এক কিশোরী খেলোয়াড়ের জেদ ও আত্মবিশ্বাস। নিজের শক্তির উপর ভরসা রাখলেন গফ। সাবালেঙ্কার শক্তির পাল্টা দিলেন। আর তাতেই বাজিমাত করলেন তিনি।
প্রথম সেটের প্রথম গেমেই নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগান সাবালেঙ্কা। ফাইনালের চাপে নিজের প্রথম সার্ভিস ধরে রাখতে পারেননি গফ। শক্তিশালী টেনিসের জোরে প্রথম গেমে গফের সার্ভিস ভেঙে এগিয়ে যান সাবালেঙ্কা। দ্বিতীয় গেমে নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন বেলারুশের প্রতিযোগী। তাঁর খেলা দেখে মনে হচ্ছিল গফ প্রথম সেটে পয়েন্টই পাবেন না। কিন্তু সাবালেঙ্কার ভুলেই খেলায় ফেরেন গফ।
তৃতীয় গেমে নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন গফ। চতুর্থ গেমে ভুল করতে শুরু করেন সাবালেঙ্কা। শুরু থেকেই তিনি চেষ্টা করছিলেন যত জোরে সম্ভব শট মারতে। আর সেটা করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিলেন না। চতুর্থ গেমে দু’বার ডবল ফল্ট করেন সাবালেঙ্কা। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাবালেঙ্কার সার্ভিস ভেঙে দেন গফ। ভুল করে মেজাজ হারাতে দেখা যায় বিশ্বের দ্বিতীয় বাছাইকে। গ্যালারিতে তখন বসে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, মারিয়া শারাপোভা, নিকোল কিডম্যানরা। তাঁদের সামনে ম্যাচে ফেরার প্রত্যয় দেখান গফ।
পঞ্চম গেমে আবার খেলায় ফেরেন সাবালেঙ্কা। তাঁর যে কয়েকটি শট ঠিক জায়গায় পড়ছিল, সেখানে গফ কিছু করতে পারছিলেন না। কিন্তু ধারাবাহিকতা দেখাতে পারছিলেন না সাবালেঙ্কা। একটি উইনারের পরেই আনফোর্সড এরর করছিলেন। পঞ্চম গেমে গফের সার্ভিস ভেঙে এগিয়ে যান সাবালেঙ্কা। পরের গেমেই আবার ব্রেক পয়েন্ট পান গফ। ঠিক সেই সময় দেখা গেল ১৭ শটের র্যালি। সাবালেঙ্কার শক্তির বিরুদ্ধে গফের দমের লড়াই। সেই র্যালি জেতেন সাবালেঙ্কা। তার পরে নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ৪-২ এগিয়ে যান তিনি। একটি গেম চলে ৮ মিনিট ধরে। ষষ্ঠ গেম জিতে সাবালেঙ্কার চিৎকার বুঝিয়ে দেয় এই পয়েন্টটা জেতা কতটা দরকার ছিল তাঁর।
গোটা আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়াম পাশে ছিল ১৯ বছরের গফের। তিনি একটি করে পয়েন্ট জিতলে হাততালিতে কান পাতা যাচ্ছিল না। সেটা হয়তো শাপে বর হল সাবালেঙ্কার। সপ্তম গেম থেকে খেলা বদলে গেল সাবালেঙ্কার। শক্তির পাশাপাশি বুদ্ধিও ব্যবহার করতে শুরু করলেন তিনি। ড্রপ শট মারা শুরু করলেন। আর সাবালেঙ্কা ছন্দ পেতেই ভুল করতে শুরু করলেন গফ। অষ্টম গেমে ম্যাচের প্রথম ডবল ফল্ট করলেন তিনি। সেই গেমেও গফের সার্ভিস ভাঙলেন সাবালেঙ্কা। এগিয়ে গেলেন ৫-২ গেমে। পরের গেমে নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ৬-২ প্রথম সেট জিতে যান সাবালেঙ্কা।
দ্বিতীয় সেটের শুরুতেও চাপে পড়ে গিয়েছিলেন গফ। আবার ব্রেক পয়েন্ট পেয়ে গিয়েছিলেন সাবালেঙ্কা। কিন্তু এ বার হাল ছাড়েননি গফ। পর পর তিনটি পয়েন্ট জিতে নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন তিনি। কিন্তু তত ক্ষণে সাবালেঙ্কার আত্মবিশ্বাস চরমে। তাই আর্থার অ্যাশ কোর্টের সমর্থনও কাজে আসছিল না গফের। নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ১-১ করেন সাবালেঙ্কা।
দ্বিতীয় সেটে আবার নিজের সার্ভিস করতে সমস্যা হচ্ছিল গফের। বার বার ডবল ফল্ট করছিলেন তিনি। তার মধ্যেই কোনও রকমে নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন তিনি। চতুর্থ গেমে আবার ভুল করেন সাবালেঙ্কা। তিনি এর আগে গফের ফোর হ্যান্ড লক্ষ্য করে খেলছিলেন। কারণ, গফের প্রধান শক্তি তাঁর ব্যাক হ্যান্ড। চতুর্থ গেমে নিজের ব্যাক হ্যান্ডের ব্যবহার করলেন গফ। ডবল ফল্ট করে গেম খোয়ান সাবালেঙ্কা। ৩-১ গেমে এগিয়ে যান গফ। তাঁর সঙ্গে তখন আর্থার অ্যাশ কোর্টের ২৩ হাজার দর্শকও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন প্রত্যাবর্তনের।
পরের গেমে সার্ভিস ভাঙার সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেননি সাবালেঙ্কা। হাল ছাড়ছিলেন না গফ। ৪-১ গেমে এগিয়ে যান তিনি। পরের গেমে দুই প্রতিযোগীর কাছে সেরা টেনিস দেখল বিশ্ব। দুরন্ত র্যালি, হার না মানা মানসিকতা খেলাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল। পর পর দু’টি উইনার মেরে নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন সাবালেঙ্কা। কিন্তু গফও ছন্দ পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই দ্বিতীয় সেটে আর তাঁকে থামাতে পারেননি সাবালেঙ্কা। ৬-৩ জিতে সমতা ফেরান আমেরিকার কিশোরী।
তৃতীয় সেটের প্রথম গেমেই সাবালেঙ্কার সার্ভিস ভেঙে এগিয়ে যান গফ। যত সময় গড়াচ্ছিল তত ডানা মেলছিলেন তিনি। প্রতিটি শট থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিল আত্মবিশ্বাস। অন্য দিক গফের পাশাপাশি নিজের বিরুদ্ধেও খেলতে হচ্ছিল সাবালেঙ্কাকে। বার বার মেজাজ হারাচ্ছিলেন। গায়ের জোরে খেলতে গিয়ে ভুল করছিলেন। চাপের মুখে যে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ও ভুল করেন তা সাবালেঙ্কাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল। বার বার র্যাকেট বদলেও খেলার ছবিটা বদলাচ্ছিল না। তৃতীয় গেমে আবার সাবালেঙ্কা ভুল করলেন। আবার ব্রেক পয়েন্ট জিতে ৩-০ এগিয়ে গেলেন গফ।
গোটা ম্যাচে গফের দ্বিগুণের বেশি আনফোর্সড এরর করেছেন সাবালেঙ্কা। গায়ের জোরে উইনার মারতে গিয়ে এই ভুল হয়েছে তাঁর। দ্বিতীয় সেট থেকে সাবালেঙ্কার শক্তির বিরুদ্ধে গফ যে বুদ্ধি দিয়ে খেললেন তা বুঝিয়ে দিল টেনিসে দীর্ঘ দিন থাকতে এসেছেন তিনি। গায়ের জোরে না পারলেও দমের জোরে সাবালেঙ্কাকে টেক্কা দিয়েছেন গফ। তৃতীয় সেটের পঞ্চম গেমে বোঝা গেল ধারাবাহিকতার কতটা অভাবে ভুগছেন বেলারুসের প্রতিযোগী। পর পর দু’টি এস মারার পরে ডবল ফল্ট করলেন তিনি। গফের রক্ষণ তাঁকে ভুল করতে বাধ্য করছিল।
তৃতীয় সেট চলাকালীন পায়ে টান ধরে সাবালেঙ্কার। ফলে মেডিক্যাল বিরতি নিতে বাধ্য হন তিনি। বিরতির পরে গফের সার্ভিস ভাঙেন সাবালেঙ্কা। খেলায় ফিরলেও দেখে বোঝা যাচ্ছিল তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সেই সুযোগ নেন গফ। লম্বা র্যালি খেলে পরের গেমেই সাবালেঙ্কার সার্ভিস ভাঙেন তিনি। সেখান থেকে আর ফিরতে পারেননি সাবালেঙ্কা। প্রথম সেট জিতলেও ম্যাচ হারতে হয় তাঁকে।