বেটের কাছে এই ভাবেই বার বার আটকে গেলেন হিউমরা। ছবি-আইএসএল।
চেন্নাইয়ান এফসি-৩ : আটলেটিকো দে কলকাতা-০
(ব্রুনো, জেজে, মেন্ডোজা)
চেন্নাই দলে শনিবার দু’জন কোচ ছিলেন।
এক জন মাঠে— মার্কো মাতেরাজ্জি।
অন্য জন মাঠের বাইরে— অভিষেক বচ্চন!
স্টেডিয়ামের দু’প্রান্তে দাঁড়িয়ে দু’জনকে নির্দেশ দিতে দেখা যাচ্ছিল টিমকে।
রিজার্ভ বেঞ্চে কালো ট্র্যাকসুট পরা ইতালিয়ান বিশ্বকাপার ঠায় দাঁড়িয়ে। আর সেই অবস্থানেই মাতেরাজ্জির হাত উঠছিল যন্ত্রের মতো। কোন দিকে পাস বাড়াতে হবে, কে কর্নার মারবে ইঙ্গিত করে যাচ্ছিলেন।
আর জুনিয়র বচ্চন? চেন্নাইয়ানের ‘ওয়ানর্স এনক্লোজার’ থেকে তিনিও হাত নাড়িয়ে গেলেন নাগাড়ে। হৃতিক রোশন, সৌরভ, জন আব্রাহাম— আইএসএলের অন্য সেলিব্রিটি টিম মালিকদের কখনও যা করতে দেখা যায়নি নিজেদের দলের ম্যাচ চলাকালীন, তা-ই করছিলেন অভিষেক। মেন্ডোজারা যখন সহকারী রেফারির সঙ্গে তর্ক করছিলেন, ম্যানুয়েল যখন বিশ্রী ট্যাকল করে কার্ড দেখলেন তখন দেখা গেল চিৎকার করে তাঁর দলের ফুটবলারদের মাথা ঠান্ডা রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন অমিতাভ-পুত্র। পুণের এই স্টেডিয়াম আইএসএলের সবচেয়ে ছোট বলে ফুটবলাররাও মাঠে দাঁড়িয়েই শুনতে পাচ্ছিলেন গ্যালারি থেকে আসা টিম মালিকের অভাবিত নির্দেশ-মালা!
মাঠে এসেই মেয়ে আরাধ্যাকে কোলে নিয়ে তাসা-ব্যান্ডের তালে তালে এক প্রস্থ কোমর দুলিয়ে নিয়েছিলেন অভিষেক। চেন্নাইয়ানের তিনটে গোলের প্রত্যেকটায় হাততালি দিতে দিতে নাচছিলেন। লুঙ্গি পরা থাকলে হয়তো ‘চেন্নাই-স্টেটমেন্ট’ হয়ে দাঁড়ানো লুঙ্গি-ডান্স করতেন! তবে ম্যাচ শেষ হওয়ামাত্র ছুটে এলেন মাঠে। জেজেদের সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। মাঠ ছাড়ার সময় জানিয়ে গেলেন, গোয়ায় চ্যাম্পিয়ন হলে অবশ্যই নাচবেন। লুঙ্গি-ডান্স!
মাতেরাজ্জি এবং তাঁর ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাস কি মাঠ, ড্রেসিংরুম ছাড়িয়ে এখন টিম মালিকের মধ্যেও বইছে? যে আত্মবিশ্বাস নামক প্রবল শক্তির কাছেই সেমিফাইনালের প্রথম পর্বে ০-৩ পিছিয়ে পড়ে আইএসএলের সবচেয়ে ধারাবাহিক দলের ফাইনালে ওঠা এখন এভারেস্ট টপকানোর মতোই দুর্গম?
গোলের পর ব্রুনো। শনিবার। ছবি-আইএসএল।
যতই সেই দলের নাম হোক আটলেটিকো দে কলকাতা! যতই সেই টিমের কোচের নাম হোক আন্তোনিও হাবাস! যতই তারা গত বারের চ্যাম্পিয়ন হোক! যতই ফিরতি সেমিফাইনালে এটিকে তাদের ঘরের মাঠ যুবভারতীতে পাক চেন্নাইয়ানকে!
টানা পাঁচ ম্যাচ জয়। আইএসএলে যে কৃতিত্ব অন্য কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজির নেই। কিন্তু চেন্নাইয়ানের সেই কৃতিত্বও আজ ছাপিয়ে যাচ্ছে, যে মস্তানির ভঙ্গিতে গত বারের চ্যাম্পিয়নদের দুমড়েমুচড়ে দিল বন্যাবিদ্ধস্ত শহরের দলটা! এর পর মাতেরাজ্জি-অভিষেকের দল আইএসএল ট্রফিটাও তুলে নিলে অবাকের কিছু নেই।
চেন্নাইয়ানের জোড়া কোচের কোচিংয়ের সামনে পড়ে কী করছিলেন সাদা-শার্ট? হাবাসকে দেখে মনে হচ্ছিল বিধস্ত এক বাহিনীর দিশাহারা সেনাপতি। কোমরে হাত। প্যান্টে গোজা বিখ্যাত সাদা শার্ট খুলে বেরিয়ে আসছে বারবার। গোঁজার চেষ্টা করছেন এবং ব্যর্থ হচ্ছেন। যেন এ দিনের তাঁর আটলেটিকো কলকাতা দলেরই প্রতিবিম্ব তিনি।
এটা সন্ধে সাতটা থেকে পরের দু’ঘণ্টার ছবি। বিকেল পাঁচটায় স্টেডিয়ামে ঢোকার মুখে চেন্নাইয়ানের দু’টো পোস্টার নজর কাড়ল। একটায় লেখা, ‘ভিক্টরি— ইটস ইন আওয়ার ব্লাড’। অন্যটায় ‘ইউনিটি— ইটস ইন আওয়ার ব্লাড’। যে দু’টোই এ দিন বিকেল পর্যন্ত ছিল হাবাসের টিমের সঙ্গী। যে দু’টোই শনিবাসরীয় রাত ন‘টায় নির্মম ভাবে ছিনিয়ে নিল মাতেরাজ্জির চেন্নাইয়ান। জেতার জন্য কী তীব্র বাসনা! কী অদম্য জেদ! কী অফুরান দায়বদ্ধতা! যেন জীবনের জন্য খেলতে নেমেছিলেন জেজে-খাবরারা। চেন্নাইয়ানকে তো নয়, যেন চেন্নাইয়ের বন্যা-দুর্গতদের উদ্ধারে নেমেছিলেন এগারো ফুটবলার।
মাঠে অতি বৃষ্টি হয়নি। বন্যাও নয়। তা সত্ত্বেও হাবাসের সাজানো কলকাতা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল! গোলের বন্যায় ভেসে গেল। প্রবল বৃষ্টির মতো চেন্নাইয়ানের আক্রমণ আছড়ে পড়ছিল কলকাতার ডিফেন্সে। তিনটে কারণ উঠে আসছে। এক) হাবাসের দলের বিখ্যাত এবং ভয়ঙ্কর উইং প্লে-টাই আজ করতে দেননি মাতেরাজ্জি। দুই) হিউম, দ্যুতি, আরাতা— গোলের মধ্যে থাকা কলকাতার তিন তারাকেই মাঝমাঠে খাঁচা-বন্দি করে রেখেছিলেন চেন্নাই ডিফেন্ডাররা। তিন) ইলানো-হীন বিপক্ষও যে এতটা আগ্রাসী মনোভাব দেখাবে সেটা হয়তো আঁচ করতে পারেননি অর্ণব-গাভিলানরা। তার উপর আবার প্রথমার্ধেই ব্রুনোর চল্লিশ গজের বিশ্বমানের ফ্রি-কিকে করা প্রথম গোলটা নড়িয়ে দিয়েছিল গোটা এটিকের আত্মবিশ্বাসকেই।
বোঝা গেল হাবাসও মানুষ। তাঁরও ভুল হয়। যুবভারতীতে আরও নব্বই মিনিট রয়েছে উঠে দাঁড়ানোর জন্য জানা সত্ত্বেও ১-০ হওয়ার পর তিনি লেকিচের মতো আনফিট স্ট্রাইকারকে নামালেন আজ। বোরহার চোট পেয়ে বসে যাওয়াটা এমনিতেই বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। ‘আনফিট’ লেকিচের ভরসায় কলকাতা পাল্টা আক্রমণে উঠতে গিয়ে আরও বড় ভুল করে বসে। এতক্ষণ এটিকে রক্ষণ মেন্ডিস-জেজেকে জোনাল কভারিংয়ে রেখে তাও মোটামুটি সামাল দিচ্ছিল। কিন্তু কাছা খুলে আক্রমণে যাওয়ায় মাঝমাঠে ব্লকার বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকল না। সেই সুযোগে গোল্ডেন বুটের আরও কাছে চলে গেলেন মেন্ডোজা। ১২ গোল হয়ে গেল তাঁর। জেজেও পাঁচ থেকে ছয় করে ফেললেন নিজের গোল সংখ্যা।
মাতেরাজ্জি জানতেন হাবাসের সেকেন্ড বল খেলার স্ট্র্যাটেজি। সেটাও চেন্নাইয়ান কোচ ছিনিয়ে নিলেন তাঁর দুই বিদেশি ডিফেন্ডার দিয়ে। ম্যাচের পর মাতেরাজ্জির গলায় স্বভাবতই উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ছিল। ‘‘দু’বছরে চারটে ম্যাচ খেললাম। কখনও কলকাতাকে তিন গোল দিতে পারিনি। আমার ছেলেরা আজ দারুণ তৃপ্তি দিল।’’
হাবাসের পক্ষে এর পরে কি ৩-৩ করা সম্ভব? ফুটবলে অনেক কিছুই হয়। এটাই মজা। আশার মজা। আবার যুক্তি বলছে, না। মাতেরাজ্জিরা জিততে জিততে এখন প্রকৃত চ্যাম্পিয়নের মতোই খেলছে। টিমটাকে অশ্বমেধের ঘোড়া দেখাচ্ছে। এদের চার দিন পরে চার গোল দিতে হলে অলৌকিক কিছু দরকার।
‘‘সবাই সব ম্যাচ জেতে না...’’ বিড়বিড় করতে করতে মিডিয়া সেন্টার থেকে বেরিয়ে গেলেন হাবাস। বিধ্বস্ত। বিমর্ষ। চেন্নাইয়ানের ফুটবল-বন্যার সামনে পড়ে যেন ধরে নিয়েছেন বাঁচা অসম্ভব। ডুবতেই হবে!
অঙ্কে না হোক, কলকাতার বিদায় মনে হয় হয়েই গেল আইএসএলে।
আটলেটিকো দে কলকাতা: অমরিন্দর, রিনো, অর্ণব, তিরি, অগাস্টিন, আরাতা, বোরহা, (লেকিচ), গাভিলান, নাতো, দ্যুতি (বলজিৎ), হিউম।