‘আমিই এক নম্বর’। নোভাক জোকোভিচকে হারিয়ে সেটাই কি বলতে চাইছেন কার্লোস আলকারাজ়? ছবি: রয়টার্স।
বাজল না ভায়োলিন। চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঘাসও খেলেন না কেউ। উইম্বলডনের সেন্টার কোর্ট দেখল এক অচেনা নোভাক জোকোভিচকে। বেসলাইন থেকে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দিয়ে ডাউন দ্য লাইন শটও দেখা গেল না। বদলে অনেক বেশি ক্রস কোর্ট শট খেলার চেষ্টা করলেন। বার বার নেটে এগিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে সহজ শট মিস্ করলেন। তিনি কী পরিকল্পনা করে নেমেছিলেন সেটাই বোঝা গেল না। জোকোভিচের ভুল কাজে লাগালেন কার্লোস আলকারাজ়। গত বছর এই সেন্টার কোর্টে জোকোভিচকে হারিয়ে তারকা হয়েছিলেন আলকারাজ়। তাতে যেন সিলমোহর পড়ল এ বার। যে ভাবে বেসলাইন থেকে ড্রপ শটে জোকোভিচকে বোকা বানালেন, যে ভাবে ডাউন দ্য লাইন শট খেললেন তাতে অবাক হলেন সবাই। জোকোভিচ নিজেও হাততালি দিতে বাধ্য হলেন। ৩৭-এর জোকোভিচকে স্ট্রেট সেটে (৬-২, ৬-২, ৭-৬) হারিয়ে পর পর দু’বার ঘাসের কোর্টের রাজা হলেন ২১-এর আলকারাজ়। লন্ডনের কোর্টে স্পেনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি।
২০১৮ সালে শেষ বার পুরুষদের উইম্বলডন ফাইনাল স্ট্রেট সেটে জিতেছিলেন জোকোভিচ। ছ’বছর পরে সেই জোকোভিচকে স্ট্রেট সেটে হারিয়েই উইম্বলডন জিতলেন আলকারাজ়।
জোকোভিচের কাছে সুযোগ ছিল ২৫তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার। ঘাসের কোর্টে রজার ফেডেরারের আটটি উইম্বলডন জেতার রেকর্ড স্পর্শ করার। অন্য দিকে আলকারাজ় নেমেছিলেন পর পর দু’বার উইম্বলডন জিততে। নিজের চতুর্থ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে। সেন্টার কোর্ট দেখল, কী ভাবে এক সেরাকে দাঁড় করিয়ে হারালেন এক ভবিষ্যতের সেরা। জোকোভিচ বুঝতেই পারলেন না, কী ভাবে খেলা তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে গেল। যত সময় গড়াল তত দাপট দেখালেন আলকারাজ়। গতি ও পাওয়ারের পাশাপাশি সেখানে ছিল শিল্পও। রজার ফেডেরার ও রাফায়েল নাদাল, দু’জনের খেলাই দেখা গেল আলকারাজ়ের র্যাকেটে। মাঝেমধ্যে পুরনো জোকোভিচের ঝলক দু’-এক বার দেখা গেলেও গোচা ম্যাচে নিষ্প্রভ ছিলেন তিনি। হতে পারে হাঁটুর সমস্যা খানিকটা হলেও সমস্যায় ফেলল তাঁকে। হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করিয়ে নেমেছিলেন। ফাইনাল পর্যন্ত কোনও সমস্যা না হলেও ফাইনালে আলকারাজ়ের গতির সামনে কিছুটা হলেও খেই হারালেন তিনি। জোকোভিচকে দেখে মনে হল, দমে পাল্লা দিতে পারছেন না তিনি।
জোকোভিচের সমস্যা ধরা পড়ে প্রথম সেটের প্রথম গেমেই। সার্ভিস করতে গিয়ে বার বার সমস্যায় পড়লেন তিনি। প্রথম গেম চলল ১৪ মিনিট ধরে। আলকারাজ় পাঁচ বার জোকোভিচের সার্ভিস ভাঙার সুযোগ পান। প্রথম চার বার জোকোভিচ ফিরে আসেন। তিনিও সার্ভিস ধরে রাখার সুযোগ পান। শেষ পর্যন্ত পঞ্চম বারে জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে এগিয়ে যান আলকারাজ়। দ্বিতীয় গেম মাত্র ৩ মিনিটে শেষ হয়ে গেল। নিজের সার্ভিস ধরে রাখলেন আলকারাজ়। তৃতীয় গেমে ফিরলেন জোকোভিচ। নিজের সার্ভিস ধরে রাখলেন তিনি। তাতে সমস্যা হয়নি আলকারাজ়ের। কারণ, নিজের সার্ভিস ধরে রাখছিলেন তিনি। দু’টি এস মেরে চতুর্থ গেম জিতে ৩-১ এগিয়ে যান আলকারাজ়। পঞ্চম গেমে আবার জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে দিলেন আলকারাজ়। ডাবল ফল্ট করলেন জোকার। ফলে ৪-১ গেমে এগিয়ে যান আলকারাজ়। ষষ্ঠ গেমে আলকারাজ়ের সার্ভিস ভাঙার সুযোগ পেয়েছিলেন জোকোভিচ। কিন্তু পারেননি। তার ফয়দা তোলেন স্পেনের খেলোয়াড়। নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ৫-১ এগিয়ে যান তিনি। লড়াই ছাড়েননি জোকোভিচ। সপ্তম গেমে নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন তিনি। তাতে অবশ্য সেট বাঁচাতে পারেননি জোকোভিচ। অষ্টম গেমে নিজের সার্ভিস ধরে রেখে প্রথম সেট নিজের নামে করলেন আলকারাজ়। ৪১ মিনিটের লড়াইয়ে প্রথম সেট তিনি জেতেন ৬-২ গেমে।
প্রথম সেটের রিপ্লে দেখা গেল দ্বিতীয় সেটের শুরুতেও। আবার জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে দেন আলকারাজ়। তবে প্রথম সেটের মতো দ্বিতীয় সেটে অতটা সময় নেননি তিনি। দু’টি ব্রেক পয়েন্ট পান। তার মধ্যে একটি কাজে লাগান তিনি। দ্বিতীয় গেমে দু’বার ডাবল ফল্ট করে চাপে পড়ে যান আলকারাজ়। কিন্তু তার পরেও গেম জেতেন তিনি। জোকোভিচ বার বার ভুল করতে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনা বোঝা যাচ্ছিল না। সাধারণত তিনি যে সব শট খেলেন না, সেগুলোই খেলার চেষ্টা করতে থাকেন। তাতে সমস্যা বাড়ে জোকোভিচের। তৃতীয় গেমেও পিছিয়ে পড়েছিলেন জোকোভিচ। কিন্তু নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন তিনি। ড্রপ শট মেরে জেতেন গেম। তবে ছন্দে খেলছিলেন আলকারাজ়। যে ভাবে বেস লাইন থেকে ড্রপ শট খেলছিলেন তা অবাক করে সবাইকে। জোকোভিচও হাততালি দিতে বাধ্য হন। নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ৩-১ এগিয়ে যান আলকারাজ়। পঞ্চম গেমে নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন জোকোভিচ। তবে আলকারাজ়ের সার্ভিস কোনও ভাবেই ভাঙতে পারছিলেন না জোকোভিচ। নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ৪-২ গেমে এগিয়ে স্পেনের খেলোয়াড়। অচেনা দেখাচ্ছিল জোকোভিচকে। বার বার নেটে যাচ্ছিলেন। সেখানে গিয়ে ভুল করছিলেন। তার ফয়দা তুলছিলেন আলকারাজ়। আরও এক বার জোকোভিচের সার্ভিস ভাঙেন তিনি। দ্বিতীয় সেটে ৫-২ গেমে এগিয়ে যান আলকারাজ়। আর ফিরতে পারেননি জোকোভিচ। নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ৩৪ মিনিটের লড়াইয়ে ৬-২ গেমে দ্বিতীয় সেটও জিতে যান আলকারাজ়।
আগের দুই সেটে প্রথম গেমে নিজের সার্ভিস খুইয়েছিলেন জোকোভিচ। তৃতীয় সেটে তা হয়নি। দুই তারকাই নিজেদের সার্ভিস ধরে রাখছিলেন। প্রথম দুই সেটের তুলনায় তৃতীয় সেটে জোকোভিচকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল। অন্তত নিজের সার্ভিসের ক্ষেত্রে। তবে শুধু নিজের সার্ভিস ধরে রাখলেই হত না, আলকারাজ়ের সার্ভিসও ভাঙতে হত। সেটা হচ্ছিল না। একটা সময় পড়ে হতাশ দেখাচ্ছিল জোকোভিচকে। নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন। একটা করে ভুল করে বিরক্ত হচ্ছিলেন। আনফোর্সড এরর করছিলেন জোকোভিচ। ২৫ গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক যে ভাবে গোটা ম্যাচ ধরে বার বার একই ভুল করলেন তা খুব একটা দেখা যায় না। প্রথম দুই সেটের শিক্ষা নিয়ে তৃতীয় সেটে ফিরতে পারলেন না সার্বিয়ার তারকা।
তৃতীয় সেটের ষষ্ঠ গেমও ১১ মিনিটে গড়াল। জোকোভিচ সুযোগ পেয়েছিলেন আলকারাজ়ের সার্ভিস ভাঙার। কিন্তু পারেননি। সার্ভিস ধরে রেখে সেট ৩-৩ করেন আলকারাজ়। জোকোভিচও নিজের সার্ভিস ধরে রাখছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, সেট টাইব্রেকারের দিকে এগোচ্ছে। ঠিক তখনই জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে এগিয়ে যান আলকারাজ়। পরের গেমেই চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য সার্ভিস করছিলেন তিনি। তিনটি ম্যাচ পয়েন্টও পেয়ে যান আলকারাজ়। ঠিক তখনই পর পর ভুল করেন আলকারাজ়। জোকোভিচকে সুযোগ করে দেন তিনি। তিনটি ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়ে আলকারাজ়ের সার্ভিস প্রথম বারের জন্য ভাঙেন তিনি। সেট ৫-৫ করেন নোভাক। খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে আর ভুল করেননি আলকারাজ়। ৭২ মিনিটের লড়াইয়ে স্ট্রেট সেটে জোকোভিচকে উড়িয়ে উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হলেন স্পেনের তারকা। তৈরি করলেন নিজের সাম্রাজ্য।