ফাইনালে ওঠার পর কার্লোস আলকারাজ। ছবি: রয়টার্স
উইম্বলডনের ফাইনালে উঠে গেলেন কার্লোস আলকারাজ। নোভাক জোকোভিচের থেকেও একপেশে লড়াইয়ে ডানিল মেদভেদেভকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে গেলেন তিনি। আলকারাজ জিতলেন ৬-৩, ৬-৩, ৬-৩ গেমে। আগামী রবিবার উইম্বলডনের ফাইনালে জোকোভিচের বিরুদ্ধে খেলবেন আলকারাজ। জোকোভিচ দু’ঘণ্টা ৪৬ মিনিটে হারিয়েছিলেন ইয়ানিক সিনারকে। মেদভেদেভকে হারাতে আলকারাজের সময় লাগল এক ঘণ্টা ৫০ মিনিট।
উইম্বলডনের সেমিফাইনালের মতো ম্যাচ। স্নায়ুর চাপ থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আলকারাজকে দেখে বোঝাই গেল না তাঁর ২০ বছর বয়স। গোটা ম্যাচে এতটাই পরিণত মানসিকতা নিয়ে খেললেন যে উইম্বলডনের ঘাসের কোর্ট তাঁর বহু দিনের চেনা বলে মনে হচ্ছিল। কোর্টের বিভিন্ন প্রান্তে শট মারলেন। মেদভেদেভের মতো সার্কিটে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ও নাজেহাল হয়ে গেলেন রিটার্ন করতে গিয়ে।
মেদভেদেভের বিরুদ্ধে সার্ভিস অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান আলকারাজ। তাঁর শক্তিশালী সার্ভিস রিটার্ন করতেই পারছিলেন না মেদভেদেভ। শুধু সার্ভিস, ড্রপ শট, বেসলাইন, ক্রস কোর্ট ব্যাকহ্যান্ড— টেনিস পয়েন্ট জিততে গেলে যা যা দরকার সবই বেরিয়েছে আলকারাজের র্যাকেট থেকে। দুই খেলোয়াড়ের পার্থক্য এতটাই চোখে পড়ছিল বার বার। আলকারাজের থেকে কিছুটা হলেও বেশি দিন আন্তর্জাতিক টেনিসে কাটিয়েছেন মেদভেদেভ। বেশ কয়েক বার বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় হওয়ার দৌড়ে এসেছিলেন। কিন্তু এক নম্বর হতে গেলে যে আলাদা ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ দরকার, সেটা এখনও রপ্ত করতে পারেননি মেদভেদেভ।
আলকারাজ যাঁর উত্তরসূরি, সেই রাফায়েল নাদাল যে ঘাসের কোর্টে দারুণ খেলতেন এমনটা বলা যাবে না। কিন্তু মনের জোর থাকলে যে সব কোর্টেই ভাল খেলা যায় সেটা তিনি প্রমাণ করেছিলেন ২০০৮ সালে। তত দিনে ফরাসি ওপেনকে কিছুটা কুক্ষিগত করে ফেলা নাদাল এক বছর আগেই ফাইনালে ফেডেরারের কাছে হেরেছিলেন। কিন্তু ২০০৮-এ পাঁচ সেটের লড়াইয়ে যে ভাবে ঘাসের কোর্টে রাজা ফেডেরারকে হারিয়েছিলেন, তাঁকে ‘শতাব্দীর সেরা ম্যাচ’ বলতে দ্বিধা করে না টেনিসবিশ্ব। যদি এই আখ্যা নিয়ে তর্ক রয়েছে। কিন্তু সেই ম্যাচের কথা কেউই ভুলতে পারেননি। আলকারাজও বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী দিনে তাঁরও সে ধরনের ম্যাচ উপহার দেওয়ার দক্ষতা রয়েছে।
আলকারাজ কী মনোভাব নিয়ে খেলতে নেমেছেন সেটা বোঝা গিয়েছিল প্রথম সেটের প্রথম গেমেই। একটিও পয়েন্ট না হারিয়ে নিজের সার্ভ ধরে রাখেন। মেদভেদেভেরও শুরুটা ভাল হয়। আলকারাজের প্রত্যাঘাত সামলেও তিনি সার্ভ ধরে রাখেন। প্রথম তিনটি সার্ভ কেউ কাউকে ব্রেক করতে পারেননি। আলকারাজের সামনে প্রথম ব্রেকের সুযোগ আসে অষ্টম গেমে। স্পেনের খেলোয়াড় সেটি কাজে লাগান। অনেকক্ষণ ধরেই রাশিয়ার খেলোয়াড়ের উপর চাপ বাড়াচ্ছিলেন আলকারাজ। তার সুফল পান। ৩-৩ পর্যন্ত দুই খেলোয়াড়কেই শক্তিশালী মনে হচ্ছিল। কিন্তু সপ্তম গেম থেকে খেলা ঘুরতে শুরু হল। নবম গেমে নিজের সার্ভ ধরে রেখে সেট পকেটে পুরে নেন আলকারাজ।
দ্বিতীয় সেটে আলকারাজ বেশি সময় নেননি। তৃতীয় সেটেই ব্রেক করেন মেদভেদেভকে। দু’বার ব্রেকের সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি। কিন্তু তৃতীয় বার মেদভেদেভের ভুলের সুযোগ নিয়ে জিতে যান তিনি। এগিয়ে যান ২-১ গেমে। এর পর আবার দুই খেলোয়াড় নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন। নবম গেমে আবার মেদভেদেভকে ব্রেক করেন আলকারাজ। নেটের সামনে তাঁর একটি ড্রপ-স্লাইসের উত্তর খুঁজে পাননি মেদভেদেভ। তবু দু’টি সেট পয়েন্টের সুযোগ ছিল রাশিয়ার খেলোয়াড়ের সামনে। তৃতীয় বার তিনি আলকারাজকে আটকাতে পারেননি।
তৃতীয় সেটে দেখা গেল ব্রেক এবং পাল্টা ব্রেকের খেলা। তিন বার মেদভেদেভকে ব্রেক করলেন আলকারাজ। মেদভেদেভ দু’বার সফল হলেও ম্যাচে ঘুরে দাঁড়াতে পারলেন না। প্রথমে তিনি নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন। দ্বিতীয় গেমেই মেদভেদের সার্ভিস কেড়ে নেন। তার পরে নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ৩-০ এগিয়ে যান। তবে এই সেটে প্রথম বার একটু হলেও প্রতিরোধ দেখা গেল মেদভেদেভের র্যাকেটে। পঞ্চম গেমে তিনি আলকারাজকে ব্রেক করেন। তাতেও অবশ্য ম্যাচ হাতে আসেনি। কারণ পরের গেমেই আলকারাজ আবার ব্রেক করেন।
একপেশে লড়াইয়ে ফাইনালে জোকোভিচ
তার আগের ম্যাচেই একপেশে লড়াইয়ে উইম্বলডনের ফাইনালে ওঠেন নোভাক জোকোভিচ। শুক্রবার সেন্টার কোর্টে সেমিফাইনালে অষ্টম বাছাই ইয়ানিক সিনারকে ৬-৩, ৬-৪, ৭-৬ গেমে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যান সার্বিয়ার খেলোয়াড়। রবিবার অষ্টম বার উইম্বলডন হাতে তোলার সুযোগ রয়েছে জোকোভিচের সামনে। উইম্বলডনের ঘাসের কোর্টে টানা ৩৪টি ম্যাচ জিতলেন জোকোভিচ।
এই প্রতিযোগিতায় জোকোভিচকে খুব বেশি প্রতিরোধের সামনে পড়তে হয়নি। প্রথম রাউন্ড থেকে ফাইনাল পর্যন্ত মাত্র দু’টি সেট হারিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেমিফাইনালে সিনারের মতো তরুণ এবং উঠতি প্রতিভার বিরুদ্ধেও তিনি যে সরাসরি সেটে জিতে যাবেন, এটা অনেকেই ভাবতে পারেননি। তবে জোকোভিচ এই ম্যাচ যত না জিতলেন, তার থেকেও বেশি সিনার হারলেন। তৃতীয় সেট ছাড়া প্রথম দুটি সেটে সিনারের খেলা ছন্নছাড়া ছিল। জোকোভিচের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে খেলতে গেলে এত ভুল করলেন জেতা যায় না। সিনারের ক্ষেত্রে সেটাই হল। এই খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধেই গত বার দু’সেট পিছিয়ে থেকে জিততে হয়েছিল জোকোভিচ। এ বারের লড়াই ঠিক ততটাই একপেশে।
সেমিফাইনালে নেমে দ্বিতীয় গেমেই ব্রেক। যে কোনও প্রতিপক্ষের মনোবল তলানিতে ঠেকার জন্যে যথেষ্ট। সিনারের ক্ষেত্রেও কিছুটা সেটাই হল। গোটা ম্যাচে অসংখ্যা ‘আনফোর্সড এরর’ (অনিচ্ছাকৃত ভুল) করেছেন সিনার (৪৪)। সেই ভুলগুলি হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, যা বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে জোকোভিচকে। ফলে ‘উইনার’-এ সিনারের থেকে অনেকটা পিছিয়ে (৪৪-৩৩) থাকা সত্ত্বেও জিততে অসুবিধা হল না তাঁর। সিনারের শক্তিশালী সার্ভ জোকোভিচকে সমস্যায় ফেলতে পারেননি। সার্বিয়ার খেলোয়াড় রিটার্ন খুবই ভাল হচ্ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি ব্রেক পয়েন্ট হলেও কাজে লাগাতে দেননি।
প্রথম সেটের প্রথম গেমেই ব্রেক হতে পারতেন জোকোভিচ। ০-৩০ পিছিয়ে থাকা অবস্থাতেও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন সিনার। দু’টি ব্রেক পয়েন্ট পেয়েছিলেন। কোনওটিই কাজে লাগাতে পারেননি। জোকোভিচ এর পর আর ভুল না করে গেম জিতে নেন। পরের গেমেই তিনি ব্রেক করেন সিনারকে। প্রথম সার্ভে নিজের পয়েন্ট পেলেও জোকোভিচ দ্রুত ৪০-৩০ করে দেন এবং গেমও জেতেন। পরের সার্ভিস ধরে রাখায় জোকোভিচ এগিয়ে যান ৩-০ গেমে। এর পর কেউ নিজের সার্ভিস হারাননি। এমনিতেই সিনারের সার্ভিস অন্যতম শক্তিশালী। কিন্তু জোকোভিচের সামনে তাঁর জারিজুরি খাটছিল না।
দ্বিতীয় সেটে আগের তুলনায় ভাল খেললেন সিনার। কিন্তু তৃতীয় গেমে ব্রেক হওয়া থেকে বাঁচতে পারলেন না। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেই ‘ডাবল ফল্ট’ করলেন তিনি। তিনটি ব্রেক পয়েন্ট পেয়েছিলেন জোকোভিচ। প্রথম দু’টি সিনার কোনও মতে বাঁচিয়ে দিলেও তৃতীয় বার কাজে লাগান জোকোভিচ। পরের সেটে হঠাৎই নাটক। খেলায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্যে সিনারকে একটি পয়েন্ট দিয়ে দেন আম্পায়াররা। জোকোভিচকে সতর্ক করে দেন। সার্বিয়ার খেলোয়াড় মানতে পারেননি। আম্পায়ারের সঙ্গে কিছু ক্ষণ তর্ক হয় তাঁর। তবে সেই গেমটি জিততে অসুবিধা হয়নি। জোকোভিচ ৩-১ এগিয়ে যান। পঞ্চম গেমে একাধিক বার সিনারের কাছে ব্রেক করার সুযোগ এসেছিল। কোনওটাই কাজে লাগাতে পারেননি। জোকোভিচ আর ভুলের সুযোগ না দিয়ে ৬-৪ গেমে সেট জিতে নেন।
তৃতীয় সেটে একটু হলেও দেখা গেল লড়াই। এই সেটে সিনারের কিছু সার্ভের কোনও জবাব ছিল না জোকোভিচের কাছে। এমনও হয়েছে যে দু’-একটি গেমে জোকোভিচকে একটি পয়েন্টও পেতে দেননি সিনার। সেই দাপট বজায় রেখেই সেট জেতার সুযোগ ছিল তাঁর কাছে। তৃতীয় সেটে এক সময় ৫-৪ এবং ৪০-৩০ এগিয়েছিলেন সিনার। অর্থাৎ সেট জেতা থেকে একটি পয়েন্ট দূরে। সেখান থেকেও ডুবলেন ভুল শট খেলে।