Football

ব্রাজিলকে কাঁদিয়ে ইটালীয় মহাকাব্য

১৯৮৬ যদি মারাদোনার বিশ্বকাপ হয়, তা হলে তার আগেরটা, ১৯৮২ ছিল রোসির। সদ্য তখন টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল সরাসরি সম্প্রচার হওয়া শুরু হয়েছে ভারতে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২০ ০৪:৩৮
Share:

ঐতিহাসিক: ১৯৮২ বিশ্বকাপে অনবদ্য হ্যাটট্রিকে ব্রাজিলকে বিধ্বস্ত করার পথে পাওলো রোসি। ফাইল চিত্র

মাত্র দু’সপ্তাহের ব্যবধান। ফুটবলপ্রেমীদের শোকস্তব্ধ করে চলে গেলেন দু’টি বিশ্বকাপের দুই মহানায়ক। দিয়েগো মারাদোনার পরে এ বার পাওলো রোসি। আর্জেন্টিনীয় মারাদোনা চলে গেলেন ৬০ বছর বয়সে। ইটালির কিংবদন্তি পাওলো রোসির বয়স হয়েছিল ৬৪।

Advertisement

১৯৮৬ যদি মারাদোনার বিশ্বকাপ হয়, তা হলে তার আগেরটা, ১৯৮২ ছিল রোসির। সদ্য তখন টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল সরাসরি সম্প্রচার হওয়া শুরু হয়েছে ভারতে। এ দেশের ঘরে-ঘরেও ছড়িয়ে পড়ে রোসির নাম। কলকাতার অসংখ্য ব্রাজিল ভক্তের মন ভেঙে দিয়ে, আজুরিদের উৎসবের রাত উপহার দিয়ে তিনি জিকো, সক্রেটিসদের ছিটকে দেন বিরাশিতে স্পেন বিশ্বকাপ থেকে।

আরও খবর: শীর্ষে বিরাট, দ্বিতীয় রোহিত, প্রকাশিত আইসিসি-র একদিনের র‍্যাঙ্কিং

Advertisement

কিন্তু সেই বিশ্বকাপে কী ভাবে খেলতে গিয়েছিলেন ইটালি ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা কিংবদন্তি, তা রহস্য রোমাঞ্চ গল্পের মতো। তার দু’বছর আগেই ইটালীয় ফুটবলে আছড়ে পড়েছিল টোটেনেরো ম্যাচ গড়াপেটা কেলেঙ্কারি। ইটালির সেরি ‘আ’ ও ‘বি’ লিগে গড়াপেটার ভয়াবহ জাল বিছিয়ে দিয়েছিল একটি চক্র। আর তাতেই জড়িয়ে গিয়েছিল পাওলো রোসির নাম। কয়েক জনকে গ্রেফতারও করা হয়। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে এসি মিলান এবং লাজ়িয়োকে সেরি ‘বি’-তে নামিয়ে দেওয়া হয়। তিন বছরের জন্য নির্বাসিত হন রোসি। পরে সাজা কমিয়ে দু’বছরের নির্বাসন দেওয়া হয়। এক বছর শাস্তি না কমলে বিরাশি বিশ্বকাপে খেলাই হয় না তাঁর।

আরও খবর: ১০ জনের ইস্টবেঙ্গল থামিয়ে দিল জামশেদপুরকে, ১ পয়েন্ট পেল ফাওলারের দল

রোসি নিজে কখনও স্বীকার করেননি তিনি কোনও ভাবে ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িত ছিলেন বলে। কেলেঙ্কারিতে যুক্ত এক অপরাধীও পরে জানান, রোসি কখনও ম্যাচ ছাড়ার জন্য অর্থ নেননি। কিন্তু ইটালীয় ফুটবলে অনেকে বিশ্বাস করেননি। ফুটবলহীন হয়ে থাকার সেই দু’বছরে পরিবারের বাইরে শুধু দু’জন তাঁকে বিশ্বাস করে গিয়েছেন। দুনিয়া মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল, তাঁরা আস্থা হারাননি। জামপিয়েরো বোনিপার্তি, যিনি রোসিকে জুভেন্টাসে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এবং, জাতীয় দলের কোচ এনজ়ো বেয়ারজোত। যাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধে রোসি দেশকে বিশ্বকাপ উপহার দেন এবং নিন্দিত থেকে বন্দিত নায়ক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

শোনা যায়, বেয়ারজোত তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী ঘটেছে গড়াপেটা কেলেঙ্কারিতে, আমাকে সত্যি ঘটনা বলো।’’ রোসি জানান, তিনি নির্দোষ। ইটালীয় ফুটবলে পিতৃসম বেয়ারজোত এর পরে আর কখনও কথা বাড়াননি। পুত্রসম স্নেহে রোসিকে আড়াল করে গিয়েছেন বরাবর। কোচের অনড় মনোভাবের জন্যই বিরাশি বিশ্বকাপ দলে ঠাঁই পেয়েছিলেন রোসি। না হলে বিতর্কিত, কলঙ্কিত, দু’বছর ফুটবল থেকে নির্বাসিত, ফিটনেস হারিয়ে ফেলা এক রোগাপাতলা স্ট্রাইকারকে সকলে ছুড়ে ফেলে দিতেই চেয়েছিল।

স্পেন পৌঁছতেই ফের বিতর্ক। প্রথমেই দেখা গেল, রোসির ওজন কম। পেশিতে কোনও শক্তি বলেই তো কিছু নেই। কী করে বিশ্বের সব বলশালী ডিফেন্ডারদের সঙ্গে লড়াই করবেন তিনি? বেয়ারজোত আরও কোণঠাসা। তবু তিনি অনড়। প্রথম দিকে তেমন কিছু করতে না পারলেও ব্রাজিলের বিরুদ্ধে সেই মহাকাব্যিক হ্যাটট্রিক করে রাতারাতি বিশ্ব ফুটবলে নায়ক হয়ে উঠলেন রোসি। সে বারের ব্রাজিল ছিল এক নম্বর ফেভারিট। জিকো, সক্রেটিসদের ব্রাজিলকে ৩-২ হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিল ইটালি।

পরে রোসি তাঁর একটি বইয়ের নামকরণ পর্যন্ত করেছিলেন সেই বিখ্যাত ম্যাচের স্মৃতিতে— ‘আই মেড ব্রাজিল ক্রাই’। আর বিশ্বাস করতেন, গড়াপেটার কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে স্পেনে উপস্থিত হয়ে বিশ্বকাপ জয় ছিল তাঁর জীবনের রাস্তায় পুনর্বাসন। ব্রাজিলকে পর্যুদস্ত করার পরে সেমিফাইনালে পোলান্ডের বিরুদ্ধে দুই গোল। মাদ্রিদের ফাইনালে তখনকার পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে আরও একটি গোল। তিন ম্যাচে ছয় গোল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সদা উজ্জ্বল তাঁর সেই সোনার দৌড়।

ফ্লোরেন্সের কাছে প্রাটোতে জন্ম তাঁর। সান্টা লুসিয়ায় প্রথম দর্শনেই সুযোগসন্ধানী, ছটফটে স্ট্রাইকার হিসেবে ছাপ ফেলতে শুরু করেন রোসি। সেই সঙ্গে গোল চেনার ধারালো মস্তিষ্ক। বলা হত, গোল তাঁর রক্তে ছিল। আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন ‘গোলমেশিন’। দ্রুতই তিনি নজরে পড়ে যান জুভেন্টাসের স্কাউটদের। তবে ফিটনেসের অভাবে (তিন বার হাঁটু অস্ত্রোপচার হয়) খুব প্রভাব ফেলতে না পারায় তাঁকে দলে নিয়েও লোনে কোমোতে (লম্বার্ডি, যেখানে করোনা অতিমারি সব চেয়ে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল, সেখানকার ক্লাব কোমো) পাঠানো হয়। সেখান থেকে ফের লোনে ভিসেঞ্জাতে। এখানেই রোসির ফুটবল জীবনের সব চেয়ে বড় পরিবর্তনটি ঘটে। উইঙ্গার থেকে তাঁকে স্ট্রাইকারে নিয়ে আসা হয়। সেরি ‘বি’-তে সর্বোচ্চ গোলদাতার সোনালি বুট জেতেন। মূলত তাঁর গোলের ঝড়েই ভিসেঞ্জা উন্নীত হয় সেরি ‘আ’-তে। একশোর বেশি সেরি ‘আ’ গোল তিনি করেছেন পাঁচটি ক্লাবের হয়ে খেলে। ভিসেঞ্জার পরে খেলেছেন জুভেন্টাস, মিলানে। বিরাশি বিশ্বকাপের সাফল্যের ভিত্তিতে তিনি বালঁ দ্যর পেয়েছিলেন, যা সেই সময়ে ইউরোপের সেরা ফুটবলারকে দেওয়া হত।

ভিসেঞ্জার হয়ে খেলার সময়েই তিনি বেয়ারজোতের নজরে পড়েন এবং অমর হয়ে থাকার জন্য তৈরি হয় এক অনবদ্য জুটি। তাঁর স্ত্রীর শ্রদ্ধাঞ্জলির সুরে গোটা ইটালি তাই শোকস্তব্ধ হয়ে গাইছে— পাবলিটো, তুমি অমর!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement