বালাক-পর্ব ভোলেননি জার্মানির বাঙালি কোচ

তবে জন্মদিনে তিনি খাঁটি বাঙালি। বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে বাঙালির প্রিয় পদ খাওয়ান। তিনি— রবিন দত্ত। জার্মানির বাঙালি কোচ।

Advertisement

শুভজিৎ মজুমদার

বোখুম  শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৯ ০৪:১৬
Share:

প্রত্যয়ী: বোখুম ক্লাবে কোচিংয়ের পাশাপাশি মেন্টরও রবিন। নিজস্ব

দমদমে আদি বাড়ি হলেও তাঁর জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা জার্মানির কোলন শহরে। বাংলায় কথা বলতে পারেন না, বুঝতেও পারেন না। তবে জন্মদিনে তিনি খাঁটি বাঙালি। বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে বাঙালির প্রিয় পদ খাওয়ান। তিনি— রবিন দত্ত। জার্মানির বাঙালি কোচ।

ষাটের দশকের শুরুতে কলকাতা ছেড়ে স্টুটগার্টে পাকাপাকি ভাবে চলে আসা সব্যসাচী দত্ত ও তাঁর জার্মান স্ত্রী রোজমেরির একমাত্র ছেলে রবিন। জার্মানির জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন পূরণ হবে না বুঝতে পেরে মাত্র তিরিশ বছর বয়সেই খেলার পাশাপাশি কোচিং শুরু করেন এফসি লিয়নবার্গে। সাত বছর পরে প্রথম বার পেশাদার দল স্টুটগার্ট কিকার্সের দায়িত্ব নেন। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা তাঁকে চিনলেন আরও এগারো বছর পরে। যখন তাঁর কোচিংয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলল বায়ার লেভারকুসেন। তাঁর কোচিংয়ে খেলেছেন জার্মানি জাতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মাইকেল বালাকের মতো তারকা। গ্রুপ পর্বে হারিয়েছেন চেলসিকে। জার্মানি ফুটবল ফেডারেশনের স্পোর্টস ডিরেক্টরও ছিলেন তিনি।

২০১১-’১২ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোয় বার্সেলোনোর বিরুদ্ধে দুই ম্যাচে ১০ গোল খাওয়ার পরেই বরখাস্ত হন তিনি। দায়িত্ব নেন ওয়ের্ডার ব্রেমেনের। সেখানেও একটা মরসুমের বেশি থাকতে পারলেন না। গত মরসুম থেকে বুন্দেশলিগা দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব বোখুম-কে কোচিং করাচ্ছেন। ১৭১ বছরের পুরনো ক্লাবকে ঘিরেই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। বোখুমে কোচিংয়ের পাশাপাশি ফুটবলারদের মেন্টরও তিনি। ছুটির দিনে প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলারদের বাড়ি যান, অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন, কার কী সমস্যা হচ্ছে তা অনুসন্ধান করে মেটানোর চেষ্টা করেন। এই কারণেই বাড়ি ও পরিবার ছেড়ে একা পড়ে রয়েছেন বোখুমে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাইন নদী পেরিয়ে বোখুম স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখা গেল, ক্লাব কর্তাদের সঙ্গে ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় ব্যস্ত রবিন। বলছিলেন, ‘‘শুরু করেছিলাম একদম নীচের সারির লিগের দলের কোচ হিসেবে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কোচিং করিয়েছি। ধাপে ধাপে উঠেছি। জার্মানির অন্য কোনও কোচের আমার মতো বুন্দেশলিগার সব ডিভিশনে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে মনে হয় না।’’ বালাককে সামলানোর কথা বলতে গিয়ে যোগ করেন, ‘‘এসসি ফ্রেইবার্গ থেকে লেভারকুসেনে এসে উপলব্ধি করলাম, সম্পূর্ণ অন্য জায়গায় চলে এসেছি। আগে যেখানেই কোচিং করিয়েছি, আমি শেষ কথা বলতাম। ফুটবলারেরা কখনও আমার নির্দেশ অমান্য করেনি। লেভারকুসেনে অন্য ছবি। আমি ঠিক বলছি কি না তা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিত ফুটবলারেরা।’’

বালাক-কে নিয়ে কী সমস্যা হয়েছিল? ‘‘সব তারকাদেরই সমস্যার ধরনটা এক রকম। ৩৫-৩৬ বছর বয়সে তাদের মস্তিষ্ক যতই সচল থাকুক, শারীরিক সক্ষমতা কমে যায়। এটা ওরা কিছুতেই মানতে চায় না। বালাকও ব্যতিক্রম ছিল না,’’ বলে রবিন যোগ করলেন, ‘‘অবশ্য আমিও ভুল করেছিলাম। বালাকের মতো তারকাকে অন্য ভাবে সামলাতে হত। সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।’’

Advertisement

লেরয় সানের প্রসঙ্গ উঠল। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে জার্মানির ব্যর্থতার জন্য অনেকেই দায়ী করেন কোচ জোয়াকিম লো-কে। কারণ, তিনি শেষ মুহূর্তে বাদ দিয়েছিলেন সানে-কে। রবিনও মনে করেন, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি তারকাকে দলে রাখা উচিত ছিল। বললেন, ‘‘জার্মানি ফুটবলে শৃঙ্খলার খুব কড়াকড়ি। কেউ দশ মিনিট দেরিতে অনুশীলনে এলে, তাকে মাঠে নামতে দেওয়া হয় না। চুল বড় থাকলে বাদ দেওয়া হয়। আমি এতটা কড়াকড়ির বিরুদ্ধে। সব চেয়ে অবাধ্য ছেলেকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’’ যোগ করলেন, ‘‘আইসল্যান্ডের জনসংখ্যা মাত্র কয়েক লক্ষ। এত কড়াকড়ি হলে তো ওদের দেশ থেকে ফুটবলারই উঠে আসবে না।’’

তবে অনেক চেষ্টা করেও কলকাতার কথা খুব একটা মনে করতে পারলেন না রবিন। বললেন, ‘‘বছর তিরিশেক আগে শেষ বার কলকাতায় গিয়েছিলাম। জার্মানিতে ফুটবল কোচের কাজটা খুব কঠিন। ছুটি প্রায় পাওয়াই যায় না। মরসুম শেষ হওয়ার পরেও ফুটবলারেরা ছুটি পায়, কোচেরা নন। তাই কলকাতায় যেতে পারিনি। ইচ্ছে আছে আগামী বছর যাওয়ার।’’ তার পরেই উচ্ছ্বসিত হয়ে যোগ করলেন, ‘‘আমার ঠাকুরদা চিকিৎসক ছিলেন। দমদমে আমাদের সুন্দর বাড়িটার ছবি আবছা মনে রয়েছে। তবে দিল্লির কথা বেশি মনে আছে। আমার কাকা থাকতেন ওখানে। আমার বয়স তখন দশ বা এগারো। দিল্লিতে যাওয়ার পরে প্রথম দিনই কাকা আমাকে ফুটবল উপহার দিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেক ধরে বাড়ির পাশের মাঠটায় প্রায় সারা দিন ফুটবল খেলতাম।’’

Advertisement

তিন দশকের বেশি সময় ধরে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেলেও বাঙালি খাদ্যের প্রতি টানটা এখনও থেকে গিয়েছে জার্মানির বাঙালি কোচের। বললেন, ‘‘সপ্তাহে ছ’দিন আমি জার্মান। তবে রবিবার বাঙালি হয়ে যাই। আমার বাবা আগে রান্না করতেন। বছর দু’য়েক হল প্রয়াত হয়েছেন। আমি যদিও রান্না করতে পারি না। আমার ভরসা এখানকার ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলোই। আমার জন্মদিনে বন্ধু ও ঘনিষ্ঠদের নিমন্ত্রণ করে বাঙালি খাবারই খাওয়াই। ওরা দারুণ খুশি হয়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement