হুঙ্কার: সামর্থকে ফেরালেন আকাশ দীপ (মাঝখানে)। তাঁকে নিেয় উল্লাসে ফেটে পড়লেন অনুষ্টুপ, মুকেশ কুমাররা। সোমবার ইডেনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
গাছের ডালে বসে যদি সেই ডালই কাটা হয়, তা হলে পতন অনিবার্য। সোমবার ইডেনে বাংলার ব্যাটসম্যানেরা সেই ভুল করলেন। আরও একবার। রঞ্জি ট্রফির সেমিফাইনালে যে দল প্রথম ইনিংসে ১৯০ রানে এগিয়ে, তাদের দ্বিতীয় ইনিংস শেষ ১৬১ রানে! কর্নাটকের সামনে লক্ষ্য ৩৫২। দিনের শেষে তিন উইকেট হারিয়ে বিপক্ষের রান ৯৮। পিছিয়ে ২৫৪ রানে। হাতে এখনও দু’দিন সময় রয়েছে। ক্রিজে রয়েছেন মণীশ পাণ্ডে ও বিপক্ষের সব চেয়ে ছন্দে থাকা ব্যাটসম্যান দেবদূত পাড়িক্কাল। বাংলা ও ফাইনালের মধ্যে ব্যবধান সাত উইকেটের। যেখানে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে মণীশ-দেবদূত জুটি।
রবিবাসরীয় ইডেন সাক্ষী ছিল বাংলার উপরের সারির ব্যাটিং ব্যর্থতার। সোমবার সকালে সেই পতন রইল অব্যাহত। দ্বিতীয় ইনিংসেও সেই অনুষ্টুপ মজুমদার (৪১) ও শাহবাজ আহমেদের (৩১) সৌজন্যে দেড়শোর গণ্ডি পার করে বাংলা। বড় ইনিংস খেলে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ নষ্ট করলেন সুদীপ চট্টোপাধ্যায় (৪৫)। রবিবার ৪০ রানে অপরাজিত থাকার পরে এ দিন আর পাঁচ রান যোগ করে ফিরলেন তিনি। এমনকি হিটউইকেট হয়ে নো-বলের জন্য প্রাণ ফিরে পেয়েও লাভ হল না। রনিত মোরে, অভিমন্যু মিঠুন ও প্রসিদ্ধ কৃষ্ণের দাপটে ১৬১ রানে শেষ বাংলার ইনিংস। তৃতীয় দিন শুরুর তিন ঘণ্টার মধ্যে অলআউট হয়ে ফাইনালের রাস্তা কঠিন করে ফেলল বাংলা। শুধুমাত্র পেস-ত্রয়ীর সৌজন্যে প্রতি মুহূর্তে ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে আসছে অরুণ লালের দল। ১৩ বছর পরে বাংলার ফাইনালে ওঠার স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব এখন তাঁদেরই কাঁধে। ঈশান পোড়েল ও আকাশ দীপ বলে গেলেন, ‘‘কাল লাঞ্চের মধ্যে ম্যাচ বার করে দেব। সকালের এক ঘণ্টায় নির্ধারিত হয়ে যাবে ম্যাচের ফল।’’
চতুর্থ ইনিংসের শুরুতেই একটি ঝড় আছড়ে পড়ে কর্নাটক শিবিরে। নাম ঈশান। ইনিংসের দ্বিতীয় বলে বোকা বানিয়ে আউট করেন এই মুহূর্তে সেরা ছন্দে থাকা কে এল রাহুলকে। সাধারণত অফস্টাম্পে ফেলে ডান-হাতি ব্যাটসম্যানের বাইরের দিকে বাঁক নেয় ঈশানের ডেলিভারি। সেই বলের অপেক্ষাতেই ছিলেন রাহুল। ঈশানের বল অফস্টাম্পের বাইরে পড়ে দিক বদলে আছড়ে পড়ে রাহুলের প্যাডে। বল ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় থাকা রাহুল বুঝতেই পারেননি, কী করে দিক পরিবর্তন করল ঈশানের সেই বিস্ময় ডেলিভারি। আম্পায়ারের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ডিআরএস নিতেই ভুলে যান রাহুল। শূন্য রানে ফিরতে হয় কর্নাটকের সেরা অস্ত্রকে। প্যাভিলিয়নে ফিরতে থাকা রাহুল দেখলেন, ঈশান তাঁকে আউট করে তাঁরই উৎসব নকল করছেন। ম্যাচ শুরু হওয়ার আগের দিনই আনন্দবাজারকে ঈশান বলেছিলেন, ‘‘রাহুলের উইকেট চাই। কারণ, ও কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের অধিনায়ক। ওকে আউট করতে পারলে, প্রথম একাদশে খেলার সুযোগ থাকবে।’’ ম্যাচের তৃতীয় দিনে সেই লক্ষ্যে সফল ঈশান।
দলের মূল ব্যাটসম্যান ফিরে যাওয়ার পরে কর্নাটক কিন্তু হাল ছাড়েনি। রঞ্জি ট্রফি মরসুমে ৬৩৭ রান করা দেবদূত পাড়িক্কালকে পাঠানো হয় তিন নম্বরে। সাধারণত তিনি ওপেন করেন। কিন্তু রাহুল আসায় প্রথম ইনিংসে নামতে হয়েছিল ছয় নম্বরে। দ্বিতীয় ইনিংসে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা ঈশান, মুকেশদের সামলানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তিনি। সঙ্গ দেন কর্নাটকের রঞ্জি মরসুমে একমাত্র সেঞ্চুরিপ্রাপ্ত ব্যাটসম্যান রবিকুমার সামর্থ। বঙ্গ পেস ব্যাটারি তাদের চেষ্টায় কোনও ত্রুটি রাখেনি। কিন্তু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল উইকেটের পতন। অধিনায়ক অভিমন্যু ঈশ্বরনের চোখ-মুখে উদ্বেগের ছাপ। পেসারদের কী নির্দেশ দেবেন, কী ফিল্ডিং সাজাবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। প্রথম ইনিংসে বোলারদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক পদক্ষেপে সাহায্য করেছিলেন মনোজ তিওয়ারি। আঙুলে চোট লাগায় চতুর্থ ইনিংসে ফিল্ডিং করতে চাননি। কিন্তু বাংলার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে মাঠে নামেন তিনি।
২৩তম ওভারে আঙুলে ব্যান্ডেজ করে মাঠে আসেন মনোজ। চলে যান মিড-অফে, আকাশ দীপের পাশে। ওভার শুরু করার আগে তরুণ পেসারের কাছে গিয়ে কিছু বললেন। মুহূর্তের মধ্যেই এক অন্য আকাশকে দেখল ইডেন। সেই ওভারের চতুর্থ বল আছড়ে পড়ে সামর্থের প্যাডে। আম্পায়ার আউট দেননি। আংশিক ডিআরএস ব্যবহার করে এলবিডব্লিউ পাওয়া প্রায় মাটি খুঁড়ে সোনা পাওয়ার সমান। মনোজ শুধু শ্রীবৎসকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞাসা করেন, আকাশের বল উইকেটের সোজাসুজি ছিল কি না। শ্রীবৎস ইতিবাচক ইঙ্গিত দিতেই রিভিউয়ের আবেদন করেন অভিমন্যু। ভেঙে যায় ৫৭ রানের জুটি। উদ্বেগে থমথমে ইডেনও প্রাণ ফিরে পেল।
মনোজের নির্দেশে প্যাভিলিয়ন প্রান্তের পরিবর্তে হাই কোর্ট প্রান্ত থেকে আনা হয় মুকেশ কুমারকে। ব্যস, ফের ফল হাতেনাতে। মুকেশের ইনসুইং প্যাডে লাগে করুণ নায়ারের। নির্দ্বিধায় আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার।
তিনি নামার পরে বাংলার আচরণে এতটা পরিবর্তন ঘটল কী করে? কী বললেন পেসারদের? মনোজের উত্তর, ‘‘বল রিভার্স করছিল। প্রভাবিত হয়ে বাইরে বল করছিল মুকেশরা। ওদের উইকেট ঘেষে বল করতে বলি। তারই ফল পাওয়া গেল।’’
দিনের শেষে আরও একটি উইকেট পেলে স্বস্তিতে থাকতে পারত বাংলা। কিন্তু মণীশ পাণ্ডে ও দেবদূত এখনও ক্রিজে। হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেছেন দেবদূত। ১১ রানে ব্যাট করছেন মণীশ। এই জুটিই পারে বাংলার স্বপ্নে জল ঢেলে দিতে। আত্মবিশ্বাসী মনোজ যদিও বলে গেলেন, ‘‘ভরসা রাখুন। জিতব আমরাই।’’