সবুজ-মেরুন সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। —ফাইল চিত্র
১০ জুলাই জুড়ে গিয়েছে দেশের প্রাচীনতম ক্লাব মোহনবাগান ও ছয় বছর আগে তৈরি হওয়া আটলেটিকো দ্য কলকাতা (এটিকে)। কিন্তু ময়দানের প্রশ্ন, দুই দলের সমর্থকরা এক হতে পারবেন তো? এক দিকে লক্ষাধিক সমর্থকের ক্লাব মোহনবাগান। যে সমর্থকদের তৈরি শব্দব্রহ্ম খেলোয়াড়দের কাছে হয়ে ওঠে দ্বাদশ ব্যক্তি। বিপক্ষের বুকের আগুন নিভিয়ে দিতে ওই চিৎকার যে কতটা কাজ করে, তা মোহনবাগানে খেলতে আসা সব খেলোয়াড়রাই বার বার বলেছেন।
অন্য দিকে মাত্র কয়েক বছর আগে কলকাতার বুকে তৈরি হওয়া আর এক ক্লাব এটিকে। আই লিগ খেলা ইস্ট–মোহন সমর্থকরা এক সময় এক হয়ে বার্তা দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এখনও বহু মোহন-সমর্থকই মানতে পারেননি দুই ক্লাবের এক হয়ে যাওয়া। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের থেকে বিদ্রুপও সহ্য করতে হচ্ছে মোহনবাগানীদের। আর এই আবহেই এটিকে ও মোহনবাগান সমর্থকদের এক করতে এ বার বার্তা দেওয়া শুরু হল ‘এটিকে মোহনবাগান ফুটবল ক্লাব’-র ফেসুবক পেজ থেকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ১০ জুলাইয়ের পর থেকে যা চোখে পড়েছে বার বার।
কয়েক বছর আগেও চিত্রটা ছিল একটু আলাদা। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সমর্থকরা এক হয়ে আইএসএল ও এটিকের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিল। সেই সমর্থকদের কী হবে? প্রাক্তন মোহনবাগান অধিনায়ক কম্পটন দত্ত বলছিলেন, “গোঁড়া মোহনবাগান সমর্থকদের পক্ষে দলকে পূর্ণ সমর্থন করা মুশকিল। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এই সংযুক্তিকরণ খুবই দরকার ছিল। লোগো, জার্সি এক রেখে সমর্থকদের আবেগকে সম্মান জানিয়েছেন সঞ্জীব গোয়েন্কা। ধীরে ধীরে ভাল খেললে সকল মোহনবাগান সমর্থককেই পাশে পাবে এটিকে মোহনবাগান এফসি।”
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক, ইস্টবেঙ্গলে আইএসএল-আশা
আশিয়ান জয়ী ইস্টবেঙ্গল দলের তেকাঠি সামলানো সন্দীপ নন্দী যদিও মনে করেন, মোহনবাগান সমর্থকদের সমর্থন ভালই পাবে এটিকে মোহনবাগান। তিনি বলেন, “লোগো, জার্সি এক রাখায় মোহনবাগান সমর্থকরা নিজেদের আবেগকে খুঁজে ঠিকই পাবেন। বরং দুই ক্লাব এক হয়ে যাওয়ায় সুযোগ কমে গেল কোচ, সাপোর্ট স্টাফ ও ফুটবলারদের।” তাঁর মতেও দল ভাল খেললে সব ভুলে মোহন সমর্থকরা আবার যুবভারতী ভরিয়ে দেবেন।
গত বছর এটিকের হয়ে খেলা রয় কৃষ্ণ জানিয়েছেন, দুই চ্যাম্পিয়ন জুটি বেঁধেছে। তিনি এই ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আনন্দিত। যাঁরা এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তিনি দুই দলের সমর্থকদের এক হওয়ার ডাক দিয়েছেন।
‘এটিকে মোহনবাগান ফুটবল ক্লাব’-র ফেসুবক পেজ থেকে সমর্থকদের এক হওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। ফেসবুকের কভারে লোগো-র নীচে লেখা ‘এক’। সেই পেজের লিঙ্কে দেওয়া হয়েছে নতুন ওয়েবসাইটের লিঙ্ক। যদিও এখনও তা শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। দুই দিন আগেই দলে সই করেছেন প্রবীর দাস। মোহনবাগান এবং এটিকে দুই দলেই খেলা এই রাইট ব্যাকের গলাতেও ধরা পড়েছে উচ্ছ্বাস। ক্লাবের সঙ্গে তিন বছরের জন্য যুক্ত হয়ে তিনি জানিয়েছেন, এটিকে-মোহনবাগান এফসি-র হয়ে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
ডার্বিতে মোহনবাগান সমর্থকদের দলের জন্য চিৎকার, আবেগ দেখে এটিকে কর্তারা বুঝে গিয়েছিলেন মোহনবাগান সমর্থকদের পেতে রং, লোগো, জার্সি বদলানো যাবে না। বদলানো হয়েওনি। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল তৈরি করবেন বলে জানিয়েছেন এটিকে-মোহনবাগানের অন্যতম কর্তা সঞ্জীব গোয়েন্কা। প্রাক্তন মোহনবাগান ফুটবলার হোসে রামিরেজ ব্যারেটো চিন্তায় ছিলেন নতুন ক্লাবের জার্সি নিয়ে। ম্যানেজমেন্টের জার্সি বদল না করার সিদ্ধান্তে সবুজ তোতা খুশি। সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “দুই দলের মিলে যাওয়া এক ধরনের এগিয়ে যাওয়া। এই যুক্ত হওয়া দরকার ছিল।” তাঁর এক সময়ের সতীর্থ ভাইচুং ভুটিয়াও মনে করেন সমর্থকের জন্য দলের জার্সির রং এবং লোগো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে-মোহনবাগানের ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনিও। তাঁর সঙ্গে এক মত রেনেডি সিংহও। তিনি চান ইস্টবেঙ্গলও যেন আইএসএলে খেলে। কারণ সমর্থকরা ডার্বি দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন: বিশ্বকাপের ম্যাচে কেন বঞ্চিত বাংলা, উঠছে প্রশ্ন
ডার্বি দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন সমর্থকরাও। ভারতীয় ফুটবলে যুগ যুগ ধরে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল এক সঙ্গেই উচ্চারিত হয়ে এসেছে। তাই এক দল আইএসএল খেললে অন্য দলও চেষ্টায় থাকবে সেই লিগে খেলার জন্য। আর সেই ডার্বিতে এটিকে ও মোহনবাগান সমর্থকরা যাতে এক হয়ে চিৎকার করেন, সেই চেষ্টাই করছেন ক্লাব কর্তপক্ষ। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত এটিকে-মোহনবাগান এফসি ম্যানেজমেন্ট ভালই জানে ফুটবলপ্রেমী বাঙালির একাংশ এখন অপেক্ষায় সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে প্রিয় দলকে মাঠে নামতে দেখতে। করোনা পরিস্থিতি পেরিয়ে ভারতবর্ষে ফুটবল মরসুম শুরু হওয়ার অপেক্ষায় তাঁরা।
প্রাক্তন মোহনবাগান অধিনায়ক কম্পটন দত্তের স্মৃতিতে আজও তাজা হয়ে রয়েছে, ম্যাচ হারার পর মোহনবাগান সমর্থকদের কংক্রিট পিলারে মাথা ঠুকে রক্ত বার করে ফেলার দৃশ্য। সুব্রত ভট্টাচার্যরা আজও ভুলতে পারেন না পাঁচ গোলে ইস্টবেঙ্গলের কাছে হারার পর সমর্থকদের ভয়ে নৌকায় রাত কাটানো বা মোহন সমর্থক উমাকান্ত পালোধির আত্মহত্যা এবং লিখে রেখে যাওয়া পরের জন্মে পাঁচ গোলের বদলা নেওয়া দেখার ইচ্ছা। এই সব কী আর ফিরবে সবুজ-মেরুন গ্যালারিতে? উত্তর খুঁজছে ময়দান।