অভিমন্যু ঈশ্বরনের দলের মানসিক কাঠিন্য অবাক করেছে অশোক মলহোত্রকে। —ফাইল ছবি।
মানসিক দৃঢ়তা। খাদের কিনারা থেকে বার বার ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই উজাড় করে দেওয়ার মতো ইস্পাত-কঠিন স্নায়ু...
রাজকোটে সোমবার থেকে শুরু হওয়া রঞ্জি ফাইনালে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাংলার এক্স-ফ্যাক্টর এটাই। মনে করছেন রঞ্জিজয়ী বাংলা দলের অপরিহার্য মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান অশোক মলহোত্র।
কয়েক বছর আগেও কোচ ছিলেন এই দলের। দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ক্রিকেটের সঙ্গে। আর সেই কারণেই অভিমন্যু ঈশ্বরনের দলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অচেনা ঠেকছে। এমন বাংলা তো একেবারেই পরিচিত নয় তাঁর!
আনন্দবাজার ডিজিটালকে মলহোত্র স্পষ্ট বললেন, “দলটা এমন সব পরিস্থিতি থেকে বার বার ফিরে আসছে যে সবাই অবাক হয়ে পড়ছি। প্রায় অসম্ভব সব অবস্থা থেকেও কামব্যাক করছে। যা চমকে দিচ্ছে। আর দলটার বড় গুণ হল কোনও এক জনের উপর নির্ভর করছে না। সবাই একটা দল হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে ড্রেসিংরুমের আবহাওয়া দারুণ।”
আরও পড়ুন: ‘বার বার কঠিন পরিস্থিতি থেকে ফিরে আসছে, এমন বাংলা দল আগে দেখিনি’
আরও পড়ুন: ফাইনালে বাংলার দুই ওপেনারকে কী করতে হবে? টিপস দিলেন দুই রঞ্জিজয়ী বঙ্গসন্তান
কিন্তু তার মধ্যেও ওপেনিংয়ে রান না ওঠা যে ফাইনালে উদ্বেগ ডেকে আনছে, তা মেনে নিচ্ছেন অশোক। তবে তাঁকে ভরসা জোগাচ্ছে লোয়ার অর্ডার। বললেন, “টপ অর্ডার না চললেও অসুবিধা হচ্ছে না। পরের দিকের ব্যাটসম্যানরা রান করে দিচ্ছে। লোয়ার অর্ডারও রান করছে। যেমন আকাশদীপও রান করে দিল কর্নাটকের বিরুদ্ধে। ইডেনে শেষ উইকেটে অনুষ্টুপ-ঈশান পোড়েলও ফিফটি প্লাস পার্টনারশিপ করেছে। দরকারের সময় কেউ না কেউ ঠিক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এটা বড় ব্যাপার। এই দলের মধ্যে সবাই সবার জন্য খেলছে। সে জন্যই মনে হচ্ছে রঞ্জি ট্রফি জিততে পারি। আমার তো মনে হচ্ছে ফাইনালে বাংলাই ফেভারিট। কর্নাটককে যেমন হারিয়েছি সেমিফাইনালে তাতে ট্রফি অভিমন্যুর হাতেই উঠছে।”
ঈশান পোড়েল, মুকেশ কুমার, আকাশ দীপদের নিয়ে গড়া বাংলার বোলিং লাইন আপকে দেশের সেরা বোলিং আক্রমণ বলেছেন কোচ অরুণ লাল ও অধিনায়ক অভিমন্যু ঈশ্বরন। স্পিন কোচ উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের ভরসা রয়েছে দুই স্পিনার শাহবাজ আহমেদ ও অর্ণব নন্দীর উপরে। অশোক মলহোত্রও প্রশংসা করছেন বাংলার বোলিং আক্রমণের। তাঁর মতে, বাংলার আক্রমণ রীতিমতো ‘ব্যালান্সড’।
কয়েক বছর আগেও বাংলার কোচ থাকা মলহোত্রকে অবাক করছে দলের লড়াকু মানসিকতা। —ফাইল চিত্র।
নায়ক বাছার ক্ষেত্রে আলাদা করে তাঁর মুখে উঠে এল শাহবাজের নাম। বললেন, “আমরা অনুষ্টুপ মজুমদারের নাম বার বার বলছি। অনুষ্টুপ সত্যিই অসাধারণ খেলেছে। কিন্তু একটা নাম আমরা ভুলে যাচ্ছি। শাহবাজ। বোলিং হোক বা ব্যাটিং, ও জিতিয়েছে দলকে। পাটিয়ালায় যেমন বোলিং করে জিতিয়েছে, তেমনই ওড়িশার বিরুদ্ধে ব্যাটিং করে জিতিয়েছে। যখন দরকার ও ঠিক কাজে আসছে। ক্রাইসিস ম্যান বলাই যায়।”
দলে না থাকা অশোক ডিন্ডার নামও উঠে আসছে বাংলার প্রাক্তন কোচের মুখে। বললেন, “গত ১০ বছরের মধ্যে আট বার ও রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছে। কিন্তু, বাংলা যখন রঞ্জি ট্রফি জেতার সামনে দাঁড়িয়ে, তখন ও দলে নেই। ডিন্ডা নিশ্চয়ই হতাশ। ঈশান পোড়েল, মুকেশ কুমার, আকাশ দীপদের কৃতিত্ব অবশ্যই প্রাপ্য, তবে ডিন্ডার কথাও ভুললে চলবে না।”
ডিন্ডার প্রসঙ্গ উঠলেই আসছে শূঙ্খলার কথা। যা নিয়ে মরসুমের শুরু থেকে আপসহীন থেকেছেন কোচ অরুণ। মলহোত্র বললেন, “দলে দারুণ স্পিরিট। ড্রেসিংরুমে এই মনোভাব আনার জন্য কোচেরই প্রশংসা প্রাপ্য।”
এ বারের রঞ্জি মরসুমে সব রকমের পরিবেশেই অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছে বাংলাকে। সাফল্যের রেসিপি কী শুধুই টিম স্পিরিট? বাংলার রঞ্জি জয়ী দলের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান বললেন, “ক্রিকেটে এমন সময় আসে, যখন দলের সব কিছুই ক্লিক করে যায়। বাংলার এখন সেটাই ঘটছে। দেখুন, অভিমন্যু ঈশ্বরন রান না করলেও দল জিতছে। মনোজ তিওয়ারি ট্রিপল সেঞ্চুরি করার পর বড় রান করেনি। অভিষেক রামন শুরুতে দুটো সেঞ্চুরির পর রান করেনি। সুবিধা হল, এই দলের সবাই চাপের মুখে কিন্তু বড় রান করার ক্ষমতা ধরে। সুদীপ চট্টোপাধ্যায় যেমন ফেরত চলে এসেছে। ও টপ ক্লাস ব্যাটসম্যান। দেখুন, টপ অর্ডার চলছে না, তার পরও আমরা এগিয়ে চলেছি। এর মানে হল, দলের মধ্যে একটা শক্তি রয়েছে। যে কোনও পরিস্থিতিতে আমরা জেতার ক্ষমতা ধরি। আমার ধারণা, ৩০ বছরের অপেক্ষার পর এই বাংলা দল রঞ্জি ট্রফি নিয়ে আসবে।”
আরও পড়ুন: এই দলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মশলা রয়েছে, বলছেন সম্বরণ
আরও পড়ুন: টেল এন্ডারদের সঙ্গে ব্যাট করাও একটা শিল্প, বলছেন ম্যাচের সেরা অনুষ্টুপ
তিন দশক আগে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রঞ্জি জয়ী দলের সঙ্গে ঈশ্বরনদের কী মিল? অশোক মলহোত্র তুলে ধরছেন মানসিকতাকে। বললেন, “সেই দলে অরুণ লাল ছিল, স্নেহাশিস ছিল, সৌরভ ছিল, উৎপল চট্টোপাধ্যায় ছিল। একের পর এক টপ ক্লাস ক্রিকেটাররা ছিল। কিন্তু এই বাংলা দলে যে স্পিরিট দেখছি, তা হয়তো আমাদের রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন দলেও ছিল না। আমাদের সেই দলে প্রত্যেকে জানতাম যে কাকে কী করতে হবে। এই বাংলা দলেও সবাই নিজের কাজটা জানে। জানে, কী করে কাজটা করতে হবে। টিম স্পিরিট তো আছেই। আছে যে কোনও পরিস্থিতিতে সফল হওয়ার মতো ক্রিকেটারও। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কেউ না কেউ ঠিক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কোনও একজন দলকে টানছে না। এগারো জন মিলে লড়ছে। এটা সত্যিই দুর্দান্ত দল।”
যে কোনও পরিস্থিতি বলতে ক্রিকেটমহলের মনে পড়ছে রাজস্থানের বিরুদ্ধে গ্রিন টপ ও পাটিয়ালায় পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ঘূর্ণি পিচে আসা জয়। সেটাই মনে করিয়ে দিলেন প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক। বললেন, “টার্নিং পিচে হয়তো আক্রমণ ততটা জোরদার নয়, তবু আমাদের কাছে অর্ণব নন্দী ও শাহবাজ রয়েছে। আর দু’জনই অলরাউন্ডার। আট-নয় নম্বর পর্যন্ত আমাদের ব্যাটসম্যান রয়েছে। আটে নামছে শাহবাজ, নয়ে নামছে আকাশ দীপ। আমাদের বোলার, ব্যাটসম্যানরা সবাই দরকারের সময় অবদান রাখছে। এটা জরুরি। ফলে, পিচ যেমনই হোক না কেন, অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছে।”
স্মৃতির সরণি বেয়ে মলহোত্র ফিরছেন তিন দশক আগে। বললেন, “আমাদের তখন কেউ পাত্তা দেয়নি। আমরা মুম্বইকে হারিয়েছিলাম। হায়দরাবাদকে সেমিফাইনালে হারিয়েছিলাম। ফাইনালে দিল্লি দলে তখন সাত-আটজন ইন্ডিয়া প্লেয়ার। কিন্তু তার পরও জিতেছি। জেতার জন্য প্রচণ্ড তাগিদ ছিল দলে। আমরা যখন জিতেছিলাম তখন মাঠে থাকা ৫০ হাজার ক্রিকেটপ্রেমীর অবদানও অনেক। গ্যালারি থেকে আসা উৎসাহ আমাদের অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল। আর দিল্লিকে চাপে ফেলে দিয়েছিল। দত্তাত্রেয়-রাজীব শেঠরা ফাইনালে খুব ভাল বল করেছিল। আমাদের সেই দলে অবশ্য অভিজ্ঞতা বেশি ছিল। এই দলটা কিন্তু একেবারেই তরুণ।”
সে বার সেমিফাইনালে ২৫৮ রানের ম্যারাথন ইনিংস খেলেছিলেন তিনি নিজে। কিন্তু, তা নিয়ে মুখ খুলতে চান না একেবারেই। হেসে বললেন, “ওটা হয়ে গিয়েছে। দ্যাট ইজ হিস্ট্রি। ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। আমি আর কী বলব! এটাই শুধু বলব যে এ বার বাংলা ফাইনালে ওঠায় খুব খুশি। ভাল লাগছে। বিদর্ভের বিরুদ্ধে যে ভাবে হেরে গিয়েছিল দলটা, তাতে কেউ ভাবেওনি এটা হতে পারে। বাংলা দারুণ খেলে ফাইনালে উঠেছে। অবিশ্বাস্য কামব্যাক করেছে। এ বার ট্রফিটা জিতে আসুক।”
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যেন আগাম দেখতেই পাচ্ছেন মলহোত্র!