আলোচনা: রাজকোটে অনুশীলনের ফাঁকে মনোজ এবং অরুণ। —নিজস্ব চিত্র
প্রশ্ন: ছেলেদের মানসিক ভাবে কী ভাবে চাঙ্গা করেছেন?
অরুণ লাল: প্রত্যেক দিন প্র্যাক্টিসে আমি নায়কদের গল্প শুনিয়েছি। কখনও জেসি ওয়েন্স, কখনও মহম্মদ আলি। যাঁরা জীবনের রাস্তায় অবিশ্বাস্য সব চ্যালেঞ্জ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। যাঁরা আমাদের সকলের অনুপ্রেরণা। আমার কাছে একটা বই আছে। নানা খেলার সব চ্যাম্পিয়নদের জীবনকাহিনি রয়েছে তাতে। এমিল জ়েটোপেক। চেকোস্লোভাকিয়ার লং ডিসট্যান্স রানার। জুতোর দোকানে কাজ করা ছেলে হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। হেলসিঙ্কি অলিম্পিক্সে তিনটি সোনা জেতেন। অথবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া চার্লস প্যাডক। যিনি প্রথম ‘বিশ্বের দ্রুততম মানব’ আখ্যা পান। জেসি ওয়েন্স। হ্যারিসন ডিলার্ড। অথবা মামো ওল্ড। ইথিয়োপিয়ার সেই ম্যারাথন রানার। দশ বছর জেলে ছিলেন। প্রাসাদের দ্বাররক্ষীর কাজ করতেন। ইথিয়োপিয়ার কিংবদন্তি আবিবি বিকিলার অনুপ্রেরণায় দৌড় শুরু করেন। ১৯৫৬-তে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে প্রথম নামেন মামো। ৮০০ এবং ১৫০০ মিটার হিট্সে সবার শেষ হন। ১৯৬৪-তে টোকিয়োতে ১০,০০০ মিটার এবং ম্যারাথনে নেমে ব্যর্থ হন। তাতেও দমে যাননি মামো। ফিরে আসেন ১৯৬৮ মেক্সিকো অলিম্পিক্সে এবং সোনা জেতেন। দ্বিতীয় স্থানাধিকারী যখন স্টেডিয়ামে ঢুকছেন, মামো প্রথম হয়ে গোটা স্টেডিয়ামে এক চক্কর ভিকট্রি ল্যাপ দিয়ে ফেলেছেন। গায়ে কাঁটা দেওয়া কী সব কাহিনি। বইটা এখন ছেলেদের কাছে ঘুরছে।
প্র: রঞ্জি ট্রফি ফাইনালে ওঠাটা বড় অনুপ্রেরণার কাজ করবে নিশ্চয়ই?
অরুণ: বিরাট অনুপ্রেরণা। বাংলার ক্রিকেটে জোয়ার আসতে চলেছে। অপেক্ষা করে দেখুন, ওয়ান ডে ক্রিকেটেও আমরা দারুণ করব। আমার তো মনে হয়, এই দলটা ওয়ান ডে ক্রিকেটের জন্য আরও ভাল। পরের বছর দেখবেন, এই ছেলেগুলো ওয়ান ডে টুর্নামেন্টে কী রকম খেলে। এখন ওরা বুঝতে পেরেছে, সাফল্য ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। ওরা বুঝতে পেরেছে, দেশের সেরা টিম হওয়ার ক্ষমতা ওদের রয়েছে। এই বিশ্বাসটাই আসল প্রাপ্তি। নীলকণ্ঠ দাসের কথা ভাবুন। একত্রিশ বছর বয়সে ওর অভিষেক ঘটাচ্ছি বলে কত কথা শুনতে হয়েছে। কত লোকে বলেছে, তা হলে তোমাদের ভাঁড়ার শূন্য যে, একত্রিশ বছরের লোককে টেনে এনে নামাতে হচ্ছে। অথচ, রাজস্থান ম্যাচে আমাদের ১৩০ রান মতো ‘লিড’ ছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে নীলকণ্ঠ এসে ২৬ রানে চার উইকেট নিয়ে গেল। আমরা দুর্দান্ত ভাবে ম্যাচে ফিরে এসেছিলাম। ওই স্পেলটা না থাকলে হয়তো আজ এই ফাইনাল খেলার জায়গাটাই তৈরি হত না। এটাই ‘টিম সংস্কৃতি’। এটাই বোঝাতে চেয়েছি মরসুমের শুরু থেকে। অনুষ্টুপ মজুমদারকে দেখুন। আমার মতে, বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা দু’টো ইনিংস অনুষ্টুপের কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনাল সেঞ্চুরি।
প্র: বলছেন, অনুষ্টুপের দু’টো ইনিংস বাংলার ইতিহাসেই সেরা?
অরুণ: বলছি মানে? চিৎকার করে বলছি। কারও কাছে অন্য কোনও নাম থাকলে এসে বলুন ভাই। কেউ এ রকম কোণঠাসা অবস্থা থেকে বাংলাকে টেনে তোলেনি এ ভাবে।
আরও পড়ুন: মন্ধানাদের নিয়ে গর্বিত সচিন, পাশে কোহালিরা
প্র: শাহবাজ আহমেদ? তাকে নিয়ে কী বলবেন?
অরুণ: দুর্ধর্ষ। কী অসাধারণ মানসিকতা। কী অনমনীয় মনোভাব! কেউ কেউ বলছে, শাহবাজ ভারতীয় ‘এ’ দলে খেলার জন্য তৈরি কি না। আমি তাদের বলব, ভাই শুনুন, ‘এ’ দলে তো ও তুড়ি মেরে ঢোকার যোগ্য। অক্ষর পটেল বা ক্রুণাল পাণ্ড্য যদি ভারতের হয়ে খেলতে পারে, তা হলে আমাদের শাহবাজও খুব পারে। অপ্রতিরোধ্য। দেখনা ইসকো অভি। জাস্ট ওয়াচ হিম। পরের বছর ওয়ান ডে ক্রিকেটে দেখবেন শাহবাজকে। উড়া দেগা সব কো!
প্র: আপনাদের সেই ১৯৮৯-৯০ রঞ্জি জয়ী দলের পাশে কোথায় রাখবেন এ বারের ছেলেদের?
অরুণ: প্রথমত, দু’টো প্রজন্মের দলের মধ্যে তুলনায় আমি বিশ্বাসী নই। তবু যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি বলব, এই ছেলেরা টিম হিসেবে আরও ভাল। স্পিরিটে এগিয়ে। আমাদের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ বেশি ফিট। এই টিমের বোলিং আক্রমণ আমাদের চেয়ে অনেক, অনেক ভাল। একটাই জায়গায় হয়তো ১৯৮৯-৯০ মরসুমের বাংলা টিম এগিয়ে থাকবে— ব্যাটিং। কিন্তু একটা কথা, এই টিমের যা ব্যাটিং দক্ষতা, তার পঞ্চাশ শতাংশও আমরা দেখতে পাইনি এই মরসুমে। যখন ওরা পূর্ণ যোগ্যতা অনুযায়ী খেলবে, এই টিমকে কেউ থামাতে পারবে না। তরুণ রক্তে টগবগ করছে এই দল।
প্র: বাংলার কোচ হিসেবে রঞ্জি ট্রফির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিশেষ কোনও পর্যবেক্ষণ আছে আপনার?
অরুণ: অন্তত তিরিশ-চল্লিশটা পয়েন্ট নোট করে রেখেছি। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে যখন বসব, ওদের বলব। যেমন এই কোয়ালিফাইং প্রক্রিয়াটা একটা কেলেঙ্কারি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার মতে, ‘এ’ এবং ‘বি’ গ্রুপ থেকে ৯টা টিমের মধ্যে চারটের নক-আউটে যাওয়া উচিত। ‘সি’ থেকে দু’টো টিম, ‘ডি’ গ্রুপ থেকে একটা। এই তিনটে দল ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম দল হিসেবে কোয়ালিফাই করা দলের সঙ্গে প্রি-কোয়ার্টার খেলে আসবে। তা হলে সেখান থেকে এল তিনটে টিম। আর প্রথম পাঁচটা টিম সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে খেলবে। আমি কোনও দলকেই ছোট করছি না। কিন্তু এখন যে সিস্টেমে রঞ্জি হচ্ছে, তাতে ‘সি’ বা ‘ডি’ গ্রুপ থেকে টিম নক-আউটে চলে যাচ্ছে কিন্তু মুম্বই, দিল্লি, বিদর্ভ, তামিলনাড়ুর মতো দল ছিটকে যাচ্ছে। পয়েন্ট সিস্টেমটা নিয়েও আমার আপত্তি আছে। ৭ পয়েন্ট আবার কী? ইনিংসে বা ১০ উইকেটে জিতলে নাও আরও ১ পয়েন্ট রাখো তুমি। বাজারে গিয়ে পয়েন্ট বিলি করছ নাকি? প্রথম ইনিংসের জন্য ৩ পয়েন্ট, সরাসরি জেতার জন্য ৫ পয়েন্ট। ব্যস, আর কোনও পয়েন্ট থাকাই উচিত নয়। আমি আরও মনে করি, আইপিএলের মতোই দেশের প্রিমিয়ার টুর্নামেন্ট করে তোলা উচিত রঞ্জি ট্রফিকে। ইডেনে রঞ্জি সেমিফাইনাল দেখতে কত লোক এসেছিল! রাজ্য সংস্থাদের উচিত, সব স্কুলকে আমন্ত্রণ জানানো। চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানাও যে, বাংলার খেলা দেখতে আসুন। আমরা ফ্রি লাঞ্চের ব্যবস্থা করব। আরে, শুধু মাঠ ভরানো নয়, ওই স্কুলের ছাত্রদের ভিড়েই তো বসে আছে তোমার আগামী দিনের তারকা। বাংলার ম্যাচ দেখতে দেখতে কোনও কিশোরের মনে হয়তো জন্ম নেবে প্রতি়জ্ঞা যে, আমিও এক দিন দাদাদের মতো ইডেনে বাংলার হয়ে খেলব। শুধু ক্রিকেট কেন, যে কোনও খেলায় যোগ দেওয়ার স্বপ্ন তৈরি হতে পারে।
প্র: সৌরাষ্ট্রের সঙ্গে ফাইনাল। কর্নাটক ম্যাচের মতোই অনেকে বলছে, বড় টিম, বড় বড় সব নাম!
অরুণ: বড় টিম বলতে কী! আমরা কি ছোট টিম নাকি! কর্নাটক ম্যাচের আগে প্রেস কনফারেন্সে এসে আমি বলেছিলাম, আমরা ফেভারিট, ওরা নয়। কারণ, আমরা বেশি ভাল ক্রিকেট খেলছি। আর শুনুন, মরসুমের শুরুতে আমি ছেলেদের বলেছি, রঞ্জি ট্রফি জেতার স্বপ্ন যদি তোমরা দ্যাখো, তা হলে ভাবতে শুরু করো যে, তোমরা সব বড় বড় টিমকে হারাচ্ছ। মুম্বই, দিল্লি এবং বিদর্ভ। মানসিকতা সে রকমই হওয়া উচিত। সেরা দলগুলোকে না হারাতে পারলে রঞ্জি ট্রফি জেতা যায় না। আমরা যে বছর রঞ্জি জিতেছিলাম, সে বারও মুম্বই, দিল্লি, হায়দরাবাদকে হারিয়েছিলাম।
প্র: অরুণ লাল ভোকাল টনিক। অনেকের জীবন দর্শনই যা পাল্টে দিয়েছে। কিছু টোটকা পেতে চাই।
অরুণ: একটা জিনিস এত দিনে বুঝেছি যে, আমি মোটামুটি ভাল কথা বলতে পারি। আর কিছু ক্ষণ বকবক করে যাওয়ার পরে লোকে বুঝতে পারে, এ খুব একটা বাজে বকছে না। তাই বোঝানোর চেষ্টা করি, দ্যাখ, একটাই জীবন। এর পর আর সুযোগ পাবি না। তোর মধ্যে যে দক্ষতা আছে, সেটাকে কাজে লাগা। অন্তত নব্বই শতাংশ প্রতিভা তো কাজে লাগা। শুধু ক্রিকেট কেন, আমি সবাইকেই বলি, যখন বন্ধুত্ব করবি, সেরা বন্ধু হওয়ার চেষ্টা কর। যখন স্বামী হবি, সেরা স্বামী হওয়ার চেষ্টা কর। সেরা স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা কর। সেরা বাবা হওয়ার চেষ্টা কর। বি অ্যান অ্যাচিভার। আর তার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হবে। এমনি-এমনি তো কিছু হয় না। আমার মনে হয়, বেশির ভাগ মানুষ তিরিশ শতাংশ জীবন উপভোগ করে। আরে, পুরো জীবনটার তো আস্বাদ নে! একটা কথা নিজেকে সব সময় বলতে হবে যে, আমি নিজের চোখে সেরা হব। নিজের চোখে কখনও যেন আমার পতন না হয়। অন্যের চোখে আমার পতন ঘটতে পারে, আমার নিজের চোখে নয়।