শত্রুতার মেজাজের মাঝে সৌহার্দ্য। ইডেনে প্র্যাকটিসের ফাঁকে শোয়েব মালিক ও সুরেশ রায়না। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
শনিবার কী হবে হাফিজ ভাই?
‘‘ইনশাল্লাহ্ জিতেঙ্গে।’’
কিন্তু ভারতকে ইডেনে হারানো অত সোজা নাকি?
‘‘কেন, ইডেনে ভারতকে আমরা কি হারাইনি? আর ইডেনে তো আমরা খেললাম। জানি কী ভাবে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে জিততে হবে!’’
বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্য কলকাতার টিম হোটেল। লবির মাঝামাঝি যে মহম্মদ হাফিজকে এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি সমর্থক-পরিবেষ্টিত। অটোগ্রাফের খাতা এগিয়ে আসছে একের পর এক, ভক্তদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে একই সঙ্গে। আর পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘প্রোফেসর’ মোটেও তাতে বিরক্ত হচ্ছেন না। শরিফ মেজাজে ঘুরছেন। ভক্তদের আবদার মেটাচ্ছেন। প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন সহাস্যে।
যা দেখলে ঝট করে মনে পড়ে যাবে এর ঘণ্টাদুয়েক আগের দৃশ্যাবলী। টিম হোটেল নয়, প্রেক্ষাপট একটু দূরের ইডেন। ভাল করে বললে, সিএবি যুগ্ম সচিব সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘর। যেখানে প্র্যাকটিস সেরে এই মাত্র ঢুকলেন সুরেশ রায়না। এবং দু’জনের কথোপকথনের সারমর্ম মোটামুটি এ রকম।
প্লিজ, শনিবার আমাদের জন্য প্রার্থনা করবেন। যদি আমরা এই ম্যাচটা বার করতে পারি, বিশ্বকাপও নিয়ে যাব!
রায়না সিএবি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর যা শোনা গেল। আর এই দুই ছবিকে পাশাপাশি রাখলে দু’টো টিমের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আন্দাজ করা মোটেও দুঃসাধ্য নয়। ভারত মার্চেও ডিসেম্বরের শীত টের পাচ্ছে। বুঝতে পারছে শনিবারের ম্যাচটাই আসল মরণ-বাঁচন যুদ্ধ। পয়েন্ট টেবলের অঙ্ক যতই বলুক টুর্নামেন্টে বেঁচে থাকতে হলে জিততে হবে পরের তিনটেতেই, আসল যুদ্ধ তো ওই একটা। কে না জানে, পাকিস্তান ম্যাচ একবার বার করে ফেললে টিমকে দেখে আবার মনে হবে মসৃণ রোলস রয়েস। ওয়াঘা-যুদ্ধ জিতে রাখা গেলে আত্মবিশ্বাস এমনই উঁচু শৃঙ্গ ছোঁবে যে, অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ কাউকেই আর অবধ্য মনে হবে না। এল ক্লাসিকো জিতে ফেললে কেউ লিগ ম্যাচ নিয়ে ভাবে নাকি?
কিন্তু সেটা তো আগে জিততে হবে। ভারতকে এ দিন বেশ টেনশনাক্রান্ত দেখিয়েছে। দৃশ্যত কিছুটা, বাকিটা শোনা। ভারতীয় টিমের নেট সেশন বলতে এ দিন যেটা ছিল, তা আদতে অপশনাল প্র্যাকটিস সেশন। মাত্র তিন জন এলেন। সুরেশ রায়না বাদে বাকি দুইয়ের আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে মাঠে নামার সম্ভাবনা বেশ কম। ঘণ্টাখানেকের সেশনের মধ্যে রায়নাকে দেখা গেল, থ্রো ডাউনের নামে আদতে যেটা চালাচ্ছেন তা শর্ট বলের বিরুদ্ধে প্র্যাকটিস। যা কেন, বোঝা যায়। শাহিদ আফ্রিদি ভারতে এসে এ দেশের প্রতি নিজের ভালবাসার কথা বলতে পারেন। কিন্তু শনিবারের ম্যাচে তাঁর টিমের পেসাররা মোটেও রায়নাকে ‘ভালবাসা’ দেখাবেন না। আমেররা পেলে শর্টই করবেন। এবং আমের কিন্তু মাঠে না এলেও তাঁর প্রস্তুতি চালিয়ে গিয়েছেন হোটেলের ঘরে বসে। জানা গিয়েছে, আমের নাকি ইউটিউবে ১৯৯৯-এ ইডেনে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে শোয়েব আখতারের সেই বিধ্বংসী স্পেলটা দেখেছেন। যে স্পেলে পরপর দু’বলে শোয়েব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন দ্রাবিড়-সচিনকে।
শাড়ির দোকানে ডিজাইনে ডুব মহম্মদ হাফিজের। —নিজস্ব চিত্র।
সন্ধেয় টিম হোটেলের কফিশপে আবার সিএবির একজন গিয়েছিলেন। টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী এবং ভরত অরুণের সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে দেখেন, শাস্ত্রী কিছুটা গুম হয়ে বসে। ভারত-পাক যুদ্ধের কথা উঠতে নাকি এক বার বলেও ফেলেন যে, টিম হিসেবে ভারত অনেক ভাল। কিন্তু পরিস্থিতিতে পাকিস্তান এগিয়ে। আফ্রিদিরা জিতে ইডেনে নামবেন। ধোনিরা হেরে। খুব সতর্ক হয়ে নামতে হবে ম্যাচটায়। কোনও ওলটপালট হতে দেওয়া যাবে না। সুনীল মনোহর গাওস্কর— তিনিও পাকিস্তানকে পরিষ্কার ফেভারিট দেখছেন। ভারতীয় ক্রিকেটারদের এ দিন খুব বেশি লবিতে নামতে দেখা যায়নি। যে যার ঘরেই নাকি ছিলেন। শুধু রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে একবার দেখা গেল। টিমের বোলিং কোচ ভরত অরুণের সঙ্গে। ল্যাপটপ সমেত যাঁরা ঢুকে গেলেন অসম্ভব সিরিয়াস আলোচনায়।
পাকিস্তানে আবার এই সিরিয়াস ব্যাপারটাই নেই। উল্টে প্রায় দু’লক্ষ টাকার শাড়ি কেনা আছে। ভারতকে ‘মেহমান’ বলে ডাকা আছে। মার্চের গরমেও সেখানে বসন্তের ফুরফুরে হাওয়া। ইডেনে দু’টো টিমের প্র্যাকটিস নিয়ে এ দিন আবার একপ্রস্ত নাটক হয়েছিল। পাকিস্তানের নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ন’টা। ভারতের দুপুর বারোটা থেকে। কিন্তু এ দিন সকালে নাকি পাকিস্তান ম্যানেজমেন্টের কাছে সিএবি থেকে খবর যায়, মাঠ এখনও তৈরি নয়। গত রাতে জল দেওয়ার ফলে জায়গায়-জায়গায় ভেজা। ঘণ্টাখানেক এখনও লাগবে। টিম বাস ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মাঠ থেকে ফোনে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ব্রেকফাস্ট প্রস্তুত, টিম কখন আসছে? পাকিস্তানের স্থানীয় ম্যানেজার মইন বিন মকসুদ তখনই দৌড়োন শাহিদ আফ্রিদির কাছে। বলা হয়, এখনই ইডেন যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরে আবার ভারতের প্র্যাকটিসও আছে। কী করা যায়? শুনে-টুনে আফ্রিদি নাকি বলে দেন, অত ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ভারত এখন তাঁদের ‘মেহমান’! ভারত যা চাইবে, তাই হবে। মানে? নতুন প্রশ্নে আফ্রিদি নাকি আরও খোলসা করে বলেন, পাকিস্তান কলকাতায় আছে প্রায় দিন সাতেক। ভারত সেখানে ঢুকল গতকাল। তা হলে কে কার অতিথি? ভারত মেহমানই তো হল!
ইডেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, দু’টো টিমের প্র্যাকটিসের কথা তাঁকে বলাই হয়নি। বললেন, ‘‘আমাকে গত রাতে যখন বলা হয়, ততক্ষণে মাঠে জল দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। আর সকাল ন’টায় প্র্যাকটিস ছিল, প্রথম শুনছি। আমি জানতাম সাড়ে এগারোটা থেকে। পাকিস্তান তো তখন থেকেই করল।’’ ত্রুটি যারই হোক, এ ঘটনা নতুন নয়। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ক’দিন আগে প্রস্তুতি ম্যাচ শেষে ইডেনে প্র্যাকটিস করতে চেয়েছিলেন আফ্রিদিরা। কিন্তু যোগাযোগের অভাবে মাঠে জল দেওয়া চালু হয়ে যায়। নিভিয়ে দেওয়া হয় অর্ধেক ফ্লাডলাইট। যা নিয়ে তখন প্রবল অসন্তুষ্টি দেখিয়েছিল পাকিস্তান।
প্রশ্ন হল, বারবার এ জিনিস ঘটবে কেন? সিএবি ফের বিতর্কের হাত থেকে বেঁচে যায় একটাই কারণে। পুরোদমে প্র্যাকটিস সেশন করবে ভেবেও পাকিস্তান সেটা শেষ পর্যন্ত করেনি। আফ্রিদি-আমের-হাফিজ-ইরফান সহ অনেক তারকা আসেননি। হাফিজ তো পরে পার্ক স্ট্রিটে চলে গেলেন শাড়ি কিনতে। আর নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা পর নামলেও শোনা গেল, ভারত বেশি গাঁইগুঁই করেনি। গত রাতেই তারা জেনে গিয়েছিল, দিনের একমাত্র সম্পূর্ণ প্র্যাকটিস স্লট পাকিস্তান নিয়ে ফেলেছে। রায়নারা তিন জনের বেশি তাই আসেনওনি। মাঠে বরং শোয়েব মালিক-সুরেশ রায়নার যে ছবিটা তৈরি হল, সম্পূর্ণ সম্প্রীতির। ফোটো অব দ্য ডে!
সব ঠিক আছে। শুধু একটা ব্যাপারই ভারতবাসীকে কষ্ট দেবে। দুই শিবিরের ছবিগুলো উল্টোলে বড় ভাল হত। আফ্রিদি ‘মেহমান নওয়াজি’ নিয়ে ব্যস্ত। সে দিনের স্পিনার ইমাদ ওয়াসিম পাক সাংবাদিকদের বলে দিচ্ছেন, স্পিনের বিরুদ্ধে ভারতীয় ব্যাটিং ভাল, তিনি জানেন। কিন্তু এটাও জানেন যে খেললে সফল হবেন। পাক শিবির আবার ঘনিষ্ঠমহলে হুঙ্কার দিচ্ছে, তাদের টিমে সে ভাবে কিছু নেই। ভাল ভিডিও অ্যানালিস্ট থেকে দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান— কিছু নেই। কিন্তু ‘খুন্নস’ আছে। যেটা অনেকেরই নেই! এক-এক সময় তো ধন্ধ লাগবে, পরশু কে কার ঘরের মাঠে নামছে?
অবশ্য লেগে লাভ নেই। পরশু তো ভারত বনাম পাকিস্তান, ফল কোন জ্যোতিষী আর কবে মিলিয়েছে!