ডোমকল থানার মেহেদিপাড়া গ্রামে আমার জন্ম। মেহেদিপাড়া খুব পিছিয়ে পড়া একটি গ্রাম। প্রত্যন্ত ওই গ্রামের শতকরা একশো ভাগ মানুষই মুসলিম সম্প্রদায়ের। সেই সময় ওই গ্রামের শিক্ষিতের হার ছিল খুবই নগন্য। মেয়েদের ক্ষেত্রে তো তুলনা-ই টানা যায় না।
কোনও ভাই নেই। ফলে প্রাথমিক শিক্ষক বাবা লেখাপড়া শেখাতে চাইলেন। মাধ্যমিক পাশ করার পর অভিভাবকেরা বিয়ে দিতে চাইলেন। ওটাই তখন ওই তল্লাটের রেওয়াজ। আমি চাইলাম আরও লেখাপড়া করতে। প্রথা ভাঙার সেই কাজটি করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। তখন জেলায় মেয়েদের লেখাপড়া করার মতো কলেজ বলতে ছিল ‘বহরমপুর গার্লস কলেজ’। মেহেদিপুর গ্রামের বাড়ি ছাড়াও বহরমপুর শহরেও আমাদের একটি বাড়ি ছিল। ফলে ‘বহরমপুর গার্লস কলেজ’ থেকে লেখাপড়া করার মোক্ষম যুক্তি দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।
কলেজ জীবনেই সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেছিলাম। আমি তখন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। একে মেয়ে, তার উপরে মুসলিম পারিবারের মেয়ে। ফলে অভিভাবকরা মানবেন কেন! তাঁদের কাছে তো এটা ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়নো’র শামিল। ফলে সুকৌশলে আমাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।গ্রামে আমি তখন গৃহবন্দি। বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। সালটা ১৯৭৫। দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা। দেশ জুড়ে খোলা হাওয়ার উত্তাল রাজনীতিও তখন আমার মতোই গৃহবন্দি। অবশেষে গ্রামের চাষির ছদ্মবেশ বাড়ি ছাড়লাম। তার পর আর ঘরমুখো হতে পারিনি। আশ্রয় নিলাম বহরমপুর শহরের এক বিশিষ্ট আইনজীবীর বাড়িতে। তিনি আমার আত্মীয়ও বটে। সেখান থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে বিএড প্রশিক্ষণ নিই। বছর খানেক একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছি। কিন্তু সমাজসেবার তাগিদে শিক্ষকতা ছেড়ে পথেই নেমে পড়ি। অসহায় তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে মৌলবাদীদের বাধা পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায়।