অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
মেয়েদের সঙ্গে তো রোজই দেখা হয়, আয়নার বাইরের মেয়েদের সঙ্গে। অসম্ভব শক্তিময়ী আমার পরিচিত মেয়েদের মধ্যে অনেকেই। নিজেদের শক্তি দিয়ে অসাধ্যসাধন করতে পারে। তাদের সামনে আয়নার লোকটাকে ভারি অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে ওদের ছদ্মবেশে থাকার ক্ষমতা দেখে, যেন কিছুই তেমন করেনি। রাশিয়ান রূপকথার সেই যে ছিল যাদুকরী ভাসিলিসা যে কেবল পুরো হাতা জামা পরা হাতটা দোলালেই সামনে হয়ে যেত প্রকান্ড সরোবর ভর্তি টলটলে নীল জল, তাতে সাঁতার দিত রাজহাঁসের ঝাঁক, অথচ তারপরই ভাসিলিসা হয়তো উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে, তার মতোই মনে হয় এদের। দু’-এক জনের কথা বলি। নামধাম পালটে দিচ্ছি না হলে তারা বড্ড রাগ করবে। বলবে, এটা আবার ফলাও করে বলার কী আছে? এটাই তো করার কথা, তা ছাড়া এ ভাবে কাটাতে ভাল লাগে বলেই তো করি। তোমার খবরের কাগজের গল্প হবার জন্য নাকি? বলতে পারব না যে আমারও শুধু তোমাদের কথা অন্যদের বলতে খুব ইচ্ছে করছে বলেই বললাম, তোমাদের হিরো বানানো কিংবা কাউকে জ্ঞান দেবার জন্য নয় একেবারেই। মোটে দু’জনের কথাই বলি না হয়।
তার বয়েস কুড়ির কোঠায়। নাম ধরা যাক সরস্বতী। বই পড়তে পাগলের মত ভালোবাসে বলে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। পড়াশোনার বিষয় আর ধরণ নিয়ে রাগী বাবার সঙ্গে জোরালো মতভেদ হয়। বাবা নিজের অভ্যস্ত অধিকারবোধে এমন কিছু বলেছিলেন যাতে তার সম্মানে লেগেছিল। চলে এল বাড়ি ছেড়ে। প্রায় খালি হাতে। এক-দু’দিন বন্ধুদের বাড়িতে থেকে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে। কষ্ট করেই থাকে, তাই তো থাকার কথা। এম এ পরীক্ষার রেজাল্ট তবু ভালই হল। সারাদিন পর ঘরে ফিরে নিজের আগের দিনের রাখা বাসন মাজতে মাজতে তাকে গান গাইতে শুনে ওপরের বাড়িওয়ালি গৃহিণী অবাকও হন। পিএইচ ডি-র জন্য তৈরি হওয়া চলছে। ঠিক করেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতার স্থাপত্যের এক বিশেষ ধরণ নিয়ে কাজ করবে। শিক্ষকেরা ওর ভাবনার ধরণ শুনে উত্সাহিত হয়ে পরামর্শ দিয়েছেন সারা বাংলা ঘুরে কাজটা করতে। এদিকে মহামান্য কেন্দ্রীয় সরকার এই সব কাজের ওপর থেকে ফেলোশিপের দাক্ষিণ্য গুটিয়ে নিচ্ছেন। হতে পারে, ‘বড় শিল্পপতি’রা এত টাকা নিয়ে চলে গেছেন যে মানবকল্যাণ বা বিদ্যাচর্চার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকট হচ্ছে। সে যাই হোক, আমার সরস্বতীর সমস্যা সামান্যই- এই সব ঘোরাঘুরির জন্য ন্যূনতম খরচ তাকে নিজেই জোগাড় করতে হবে। ‘না হয় আরও দুটো টিউশানি বাড়িয়ে নেব’- বলল সে। ওটাই ওর জীবিকা গত তিন বছর।
কেমন করে কাটে ওর এই সকাল-বিকেল-সন্ধে টিউশানি, দুপুরে ক্লাস-লাইব্রেরি, এর ফাঁকফোকরে কিছু রান্নাখাওয়া কাপড়কাচা ঘর পরিষ্কারের জীবন?পরিশ্রমে কালি দিনরাত? নাঃ তেমন নয়। গল্প করছিল ওর এক ক্লাস নাইনের ছাত্রীর। সেই মেয়েটি জন্মাবার মাসদুই পর তার বাবা মারা গেলে বাড়ির লোকেরা ‘অপয়া মেয়ে’ আর তার তরুণী মাকে বার করে দেন। সেই মা-হারা মা-টি মেয়েকে নিয়ে থাকত নিজের বাবার কাছে। আর, তাদের সংসারের সব কাজকর্ম সামলাত আরেকটি বালিকা যার নাম লেখা। এই লেখার মা-বাবা-কাকা তাকে ‘কাজ করতে’ পাঠিয়েছিল যাতে সংসার কোনও মতে চলে। খুব ছোটবেলাতেই লেখা এসেছিল এ বাড়ি। এরা তাকে ভালোই বাসে কিন্তু সব ছোটদের মত তারও মন খারাপ করত বাড়ির জন্য। মনখারাপ করত পূজাকে স্কুল যেতে দেখে।
আরও পড়ুন, আমি মনে করি, নারী আগে, পুরুষ তার পরে
সরস্বতী এল পূজার ক্লাস নাইনের টিচার হয়ে। কাজকর্মে চৌখস লেখা দু-তিনদিনে বুঝে ফেলল এই ‘বাচ্চা দিদিমণি’ খেয়ে আসে না। কোনও দিন মুড়িমাখা, কোনও দিন রুটি কি পাঁউরুটি এগিয়ে দিতে তার একটুও দেরি হত না। সরস্বতীরও চোখ এড়ায়নি লেখার মন দিয়ে পূজার পড়া শোনার আগ্রহ। কয়েক দিন পর থেকে সে নিয়ে আসে লেখার জন্যও বই- তোত্তো চান, পুরোন দাদুর দস্তানা আরও যা তার হাতের কাছে পায়। ছাত্রীর ক্লাসের পড়া শেষ হলে শুরু হত তাদের দশ মিনিটের অন্য ক্লাস। দিদিমণি পড়ে শোনায়, ছাত্রীরা শোনে। এক একদিন বইটা লেখার কাছে রেখে আসে সরস্বতী। ক্লাস ওয়ানের ভুলে যাওয়া অক্ষরগুলোকে আবার একটু একটু করে ফিরে পায় লেখা।
লেখা কোনও দিন নদী দেখেনি। এক দুর্লভ ছুটির দিনে সরস্বতী দুজনকে নিয়ে যায় গঙ্গার ধারে। নদী দেখা, ঝালমুড়ি খাওয়ার উত্সব হয়েছিল সে দিন। পূজা স্কুল শেষ করে এখন কলেজে পড়ে। লেখার জীবন বয়ে গেছে আপন রাস্তায়, লেখা কিন্তু পড়তে শিখে গেছে। আর ভালোবাসতেও।
ঝিনুক আবার সরস্বতীর মায়ের চেয়েও বড়ো হতে পারত, যদিও কোনও পরিচয়ই নেই দুজনের মধ্যে। ভারি সুন্দর গান গাইতে পারত ঝিনুক, পুরোদস্তুর রাজনীতি করার দিনে। ভুল চিকিত্সাজনিত হাঁপানিতে সেটা ঘুচেছে আগেই। শরীর ঘিরে ধরেছে চিনি, ব্লাডপ্রেশার, থাইরয়েড, হাড়ের সমস্যা। সন্তানধারণ করা হয়নি। কিন্তু মা-হওয়া কি নির্ভর করে শুধু একটা শারীর-বৃত্তীয় নিয়মের ওপর? এই হল ঝিনুকের ভাবনা। সুতরাং এক ছেলের পর এক মেয়ে তার। মেয়েটিকে ঘরে আনার আগে চার মাস ধরে তারা স্বামী-স্ত্রী সেই হোমে গিয়ে একটু একটু করে পরিচয় করেছে এক বছরের শিশুটির সঙ্গে। তার পর নিয়ে আসবার ঠিক আগে একটা ফাইনাল স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল সে শিশুর আছে সিকল সেল আনিমিয়া। থ্যালাসেমিয়ার এক প্রকারভেদ। অপ্রস্তুত হোম কর্তৃপক্ষ প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘অন্য বাচ্চা নিতে পারেন আপনারা’। ঝিনুক ভেবেও দেখেনি প্রস্তাবটা, ‘একি দোকানে গিয়ে আলু কেনা নাকি, যে একটায় দাগ আছে পালটে দাও? যদি আমার শরীর থেকেই কেউ জন্মাত এ রকম অসুখ নিয়ে, কী করতাম?’
আরও পড়ুন, এখনও এ সমাজে মেয়েরা শুধুই ‘মেয়ে’!
ঝিনুকের মেয়ের বয়েস এখন বারো। ধরা পড়েছে তার অন্য রকম তীব্র জটিল মানসিক রোগ। অনেক কষ্টে সে রকম একটা স্কুল খুঁজে পাওয়া গেছে যেখানে টিচার তাকে জিজ্ঞেস করেন না, তুমি কতোবার ওষুধ খাও? ওষুধ না খেলে তোমার ঠিক কী হয়? অন্যরা যখন স্পষ্ট করে কথা বলে তোমার ইচ্ছে হয় না ওদের মত হতে? সে পড়া বুঝতে না পারলে তাকে বার করে দেন না ক্লাস থেকে। সে এখন নাচে। নাচতে খুব ভাল লাগে তার। এই স্কুলে অন্য বাচ্চাদের এক একদিন নাচ শেখায় সে। ঝিনুকের ছেলেমেয়ের সংখ্যা আরও অনেক বেড়েছে। সেই ‘কোলে পো কাঁখে পো’ পুতুলের মত। যার যেখানে ক্ষত, শুশ্রূষার জন্য তারা আসে তার কাছে। কিংবা মাঝে মাঝে ঝিনুক নিজেই শরীর টেনে হাজির হয় তাদের কাছে। কে ক্যান্সারে ভুগছে, কার মা চলে গিয়েছে সংসার ছেড়ে, কার পড়াশোনা চালিয়ে যাবার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছে কোনওটাই নেই- ঝিনুক এদের মা হয়ে থাকে। সত্যিকারের মা। তার মধ্যেই একটু একটু করে লেখে ঝিনুক। ইতালিয়ান শিখেছে যাতে সেই ভাষা থেকে সুন্দর লেখাগুলো বাংলায় নিয়ে আসা যায়। নিজের ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে নানা রকম কাজে। মেয়েকে শেখায় ভয় পাবার, লজ্জা পাবার মত কিচ্ছু হয়নি তোমার। আমার যেমন কয়েকটা অসুখ, তোমারও অন্য আরেকটা অসুখ। কত জনের আরও কত রকমের অসুখ থাকে। কী করা যাবে? অসুখ নিয়েও যাতে সব সময়ে খুশ থাকতে হয়, সেটাই তো শেখার।
কাল ঝিনুক আমায় নিয়ে গিয়েছিল নিজের এক শিক্ষিকা, পরে সহকর্মিণীর কাছে। কয়েক মাস হল ক্যানসারের অপারেশন হয়েছে তাঁর। ক্যানসারে মৃত স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, ‘আমার সতেরো আর ওর কুড়ি, তখন থেকে প্রেম ছিল আমাদের। শিখিয়ে পড়িয়ে বর মানুষ করে তবে বিয়ে করতে বেশ কয়েক বছর লেগেছিল তো, অভ্যেস হয়ে গেছিল...’। কৌতুকের স্বরেই বলছিলেন। দুই ছেলে দূরে দূরে থাকে, তাদের কথা, পুরোন ছাত্রীদের আর সহকর্মীদের নিয়ে নানান মজার স্মৃতি আর সবচেয়ে বেশি করে বইয়ের কথা। ওঠাচলা প্রায় বন্ধ। স্নিগ্ধ স্মিত উপস্থিতির আলো।
অন্ধকারেও দীপ্যমান আমার আরও অনেক শক্তিময়ীরা, যাঁরা জীবনকে সহজ খাতে প্রবাহিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।