দিল্লি চিড়িয়াখানায় ঘুরে বেড়াচ্ছে রানি। নিজস্ব চিত্র
সাত বছরে প্রথম মানুষের রক্তের স্বাদ! আর তাতেই পাল্টে গিয়েছে বিজয়ের জীবন।
আগেই দিল্লি চিড়িয়াখানার অন্যতম আকর্ষণ ছিল সে। আর কালকের পর? ঘাতক পরিচয়ে আরও বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এই সাদা বাঘটি।
সাল ১৯৬২। মধ্যপ্রদেশের রেওয়া থেকে দিল্লিতে পা দেয় বিজয়ের পূর্বপুরুষেরা। তার বাবা লক্ষ্মণ, আর মা যমুনা। বিজয়ের জন্ম ২০০৭ সালে। ২১৫ কেজি ওজনের অন্যতম আকর্ষণটিকে নিয়ে আজ অবশ্য কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। গত কাল আংশিক মানসিক ভারসাম্যহীন বছর কুড়ি-একুশের যুবক মকসুদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে। আজ সকাল থেকেই তাই খাঁচাবন্দি সে। পরিখা ঘেরা চৌহদ্দিতেও ঘোরার অনুমতি দেওয়া হয়নি তাকে। শুধু আজই নয়, আগামী চার-পাঁচ দিন কড়া নজরে রাখা হবে বিজয়কে।
ঘাতক বন্দি। তাই দর্শকদের জন্য হাজিরা দিয়েছে বিজয়েরই স্ত্রী রানি। দূর থেকে ফারাক বোঝার উপায় নেই। ফলে রানিকেই আজ ঘাতক বদনাম কুড়োতে হয়েছে দিনভর। কাজের দিনে দিল্লি চিড়িয়াখানার লোক হয় গড়ে পাঁচ-ছয় হাজার। কিন্তু আজ সংখ্যাটি বেড়েছে বলেই দাবি কর্তৃপক্ষের। এমনিতেই বাঘ দেখতে ভিড় বেশি হয়। আর আজ গিয়ে দেখা যায়, চিড়িয়াখানায় আসা গোটা ভিড়টা জমে গিয়েছে রানির সামনে। ছবি উঠছে ঘনঘন। মাইকে অনবরত ঘোষণা হচ্ছে: ‘হিংস্র প্রাণীর বেশি কাছে যাবেন না। বিপদ হতে পারে।’ বাঘের পরিখার সামনে ভিড় বাড়লেই তড়িঘড়ি সরিয়ে দিচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। ঘাতক বাঘকে দেখতে করোলবাগ থেকে স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন সমীর। রানিকেই দেখিয়ে সমীর বললেন, “ওই দেখ বিজয়! মানুষখেকো বাঘ।”
বিজয় কি এখন তবে মানুষখেকো?
রে রে করে উঠলেন দিল্লি চিড়িয়াখানার কিউরেটর আর এ খান। বললেন, “আরে বিজয় তো কেবল টুঁটি চেপে ধরেছিল। মুখে রক্ত লেগে যায়। কিন্তু মাংস খায়নি।” খান এ কথা বললেও চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের একাংশ মনে করছেন, এক বার মকসুদের রক্তের স্বাদ যখন পেয়েছে বিজয়, তখন আর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। বিজয়কে আগামী আরও ক’দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। দেখা হবে তার খাদ্যাভাসে কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না। যদিও খান দাবি করেছেন, “গত কাল রাতে ও আজ দিনভর নিয়মমাফিক দশ কেজি বাছুরের মাংস খেয়েছে সে।”
গোটা ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক। আজ দফায় দফায় পুলিশ ও মন্ত্রকের শীর্ষ কর্তারা চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখেন। গত কাল অভিযোগ ওঠে, বাঘের এনক্লোজারের সামনে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সামনে যে পাঁচিলটি রয়েছে, তা-ও যথেষ্ট নিচু। আজও দেখা গিয়েছে, সামনে নাম-কা ওয়াস্তে তিন ফুটের রেলিং। যে কেউ সেটি টপকালেই সামনে জলশূন্য পরিখার দেওয়াল। অনায়াসে লাফিয়ে পড়া যায় সেখানে। যেমনটি পড়ে গিয়েছিলেন মকসুদ। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই এই যুক্তি অবশ্য খারিজ করে খান বলেন, “মকসুদ দু’বার নিরাপত্তাবেষ্টনী ভাঙার চেষ্টা করেন। দু’বার তাঁকে আটকান নিরাপত্তারক্ষী। এর পরে স্কুল পড়ুয়াদের একটি দল এসে যাওয়ায় তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই ফাঁকে মকসুদ নীচে লাফ দেন। অসতর্ক ভাবে মকসুদ পড়ে যাওয়ার কথাও ঠিক নয়। ইচ্ছাকৃত ভাবেই লাফ দেন মকসুদ।” তাঁর দাবি, কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের নিয়ম মেনে এনক্লোজার বানানো হয়েছে। আর পরিখায় জল থাকলে ওই ব্যক্তি ডুবেও মারা যেতে পারতেন। অথবা সাঁতারে পটু বিজয় চাইলে অনায়াসে মকসুদকে ধরে ফেলতে পারত। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মকসুদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখনও আসেনি। সেটা পেলেই বোঝা যাবে, তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন কি না। তবে পুলিশের অনুমান, দুর্ঘটনার পিছনে মানসিক অসুস্থতাও অনেকাংশে দায়ী।
কিন্তু ঘুমপাড়ানি গুলি ব্যবহারের কথা ভাবা হয়নি কেন?
খানের দাবি, “বাঘের ওজন বুঝে তবেই ঘুমপাড়ানি ওষুধ ব্যবহার হয়। তা না হলে মুশকিল হতে পারে।ওই সময়ে ওজন বুঝে গুলি ছোড়ার মতো সময় আদৌও ছিল না। তা ছাড়া ওই গুলি ছুড়লেও বাঘ নিস্তেজ হতে সময় নেয় প্রায় পনেরো মিনিট। সেখানে বিজয়ের মকসুদকে কাবু করতে সময় লেগেছে মাত্র দু’-চার মিনিট।” খান মনে করেন, দর্শকদের মানসিকতা পাল্টানো অনেক বেশি জরুরি। দেশের অধিকাংশ চিড়িয়খানার পশুরা দর্শকদেরই অত্যাচারের শিকার হয়। দিল্লিওব্যতিক্রম নয়। এখানে পশুদের নিজস্ব চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়া নতুন নয়। বছর সাত-আট আগে এক ব্যক্তি দেওয়াল টপকে ঢোকেন সিংহের খাঁচায়। বাঘের চেয়ে সিংহ প্রকৃতিতে অলস হওয়ায় সে যাত্রা বেঁচে যান তিনি। ১৯৮৯ সালে বাঘের খাঁচায় ছেলের হাত ঢুকিয়ে ছবি তুলছিলেন এক শিখ দম্পতি। নীচে বসা বাঘ বাচ্চার হাত ছিঁড়ে নেয়।
সামনে উৎসবের মরসুম। বিজয়কে নিয়ে উৎসাহ যে আরও বাড়বে, সে আভাস আজই পেয়েছেন কর্তৃপক্ষ। আপাতত তাঁরা চান, পাঁচ দিন পর স্বমহিমায় নিজের চৌহদ্দিতে ফিরে আসুক বিজয়।