—প্রতীকী ছবি।
ভ্রম শুধু মানুষ নয়, যন্ত্রেরও হয়। বলা ভাল, যন্ত্রমাত্রই হয়। কিন্তু সংশোধনের উপায় জানা না থাকলে সমস্যা। ঠিক এই গেরোতেই আটকে রয়েছে ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটার’। এই অতি শক্তিশালী কম্পিউটার তৈরিতে বিশ্ব জুড়ে একাধিক গবেষণা চলছে। ভারতের একাধিক প্রতিষ্ঠানও কোয়ান্টাম গবেষণায় যুক্ত। লক্ষকোটি ডলারের বিনিয়োগ। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এখন যে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়, তার থেকে হাজার হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার। বর্তমান কম্পিউটারে যা কল্পনাও করা যায় না, সেই কাজ চোখের পলকে করে ফেলতে পারে অত্যাধুনিক যন্ত্রটি। তবু বাণিজ্যিক ভাবে এটি কবে সাধারণ মানুষের দরবারে আসবে, তার উত্তর জানা নেই কারও। কারণ— খুব সহজে নিজের ভুল সংশোধন করতে জানে না সে।
ধরা যাক, আপনাকে কেউ কোনও কথা বলল। আপনি শুনতে পেলেন না। ফের তাঁকে বলতে বললেন। এ বারে তিনি স্পষ্ট করে বললেন, আপনিও শুনতে পেলেন। এই রকম সংশোধনের পথটুকু জানা নেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের। এখনের ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার যে ভাবে নিজের ভুল ঠিক করতে পারে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সে ভাবে এনকোডেড ডেটা বারবার কপি করেও ভুলগুলো সংশোধন করতে পারে না। কারণ নো-ক্লোনিং থিওরেম (এই তত্ত্ব বলে কোয়ান্টাম স্টেটের স্বাধীন ও সদৃশ প্রতিলিপি তৈরি অসম্ভব) কোয়ান্টাম ডেটার কপি করাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানীদের ভাষায় এই সমস্যার সমাধান হল ‘কোয়ান্টাম এরর কারেকশন’। পরীক্ষাগারে কী ভাবে সহজ উপায়ে ‘কোয়ান্টাম এরর কারেকশন’ করা যায়, তারই উত্তর খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ এ সমস্যার সমাধান মিললেই হাতে চলে আসতে পারে আলাদিনের প্রদীপ ও তার মধ্যে থাকা জিন।
এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার’ পত্রিকায়। তাতে দাবি করা হয়েছে, অবশেষে ‘কোয়ান্টাম এরর কারেকশন’-এ সাফল্য এনে দেবে হার্ভার্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্ম। হার্ভার্ডের এই দলে রয়েছেন কোয়ান্টাম অপটিকস বিশেষজ্ঞ মিখাইল লুকিন। তিনি জোশুয়া অ্যান্ড বেথ ফ্রেডম্যান ইউনিভার্সিটি-র পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ‘হার্ভার্ড কোয়ান্টাম ইনিশিয়েটিভ’-এর কো-ডিরেক্টরও। নেচার পত্রিকায় যে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটি হার্ভার্ড, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এবং বস্টনে অবস্থিত কিউএরা কম্পিউটিং-এর সম্মিলিত কাজ। এই দলে মার্কাস গ্রেনারও রয়েছেন। তিনি জর্জ ভাসমার লেভেরেট প্রফেসর অব ফিজিক্স।
বেশ কয়েক বছর ধরে এই গবেষণা চলছে। প্রবল ঠান্ডা, লেজ়ার-ট্র্যাপড রুবিডিয়াম পরমাণু নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। এক-একটি পরমাণু একটি বিট বা কোয়ান্টামবিট (কিউবিট)। কোয়ান্টাম দুনিয়ায় এই নামেই ডাকা হয়। এগুলি অতি দ্রুত হিসেবনিকেশ করতে পারে। হার্ভার্ডের বিজ্ঞানী দলটি মূল যে কাজটি করেছে, সেটি হল পরমাণুর অবস্থান ও বিন্যাসের অদলবদলের মাধ্যমে পরমাণুদের মধ্যে বিশেষ সংযোগ স্থাপন করা। পদার্থবিদ্যায় একে বলা হয় ‘এনট্যাঙ্গলিং’। এ ভাবে পরমাণু জোড়ার সংযোগ স্থাপনের উপায়কে বলা হয় ‘টু-কিউবিট লজিক গেট’। এটি কম্পিউটিং পাওয়ারের একটি একক। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জটিল অ্যালগরিদম সামলাতে এমন বহু ‘গেট’ প্রয়োজন হয়। এই ‘গেট-অপারেশন’-এ ভুল হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। আর ভুল হলে পুরোটাই মাটি। নতুন গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, এই প্রথম এত নির্ভুল ভাবে পরমাণুর সংযোগ স্থাপন করে দেখিয়েছেন তাঁরা (মাত্র ০.৫ শতাংশ ভুল)।
হার্ভার্ড গ্রিফিন গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড সায়েন্সের গবেষক ছাত্র, এই গবেষণার ‘প্রথম তদন্তকারী’ (ফার্স্ট অথর) সিমন এভেরেড বলেন, ‘‘আমরা প্রমাণ করে দেখিয়েছি, যে এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে কম ভুল হচ্ছে, যেটার ভ্রম সংশোধন করা সম্ভব।’’ লুকিন বলেন, ‘‘কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বড় মাপে ব্যবহারের পথ দেখাচ্ছে এই গবেষণা। সম্পূর্ণ গবেষণা ক্ষেত্রটির জন্য এটা দারুণ খবর।’’
কোয়ান্টাম ইনফরমেশন এবং কমিউনিকেশন তত্ত্বের উপর গবেষণা চলছে কলকাতার ‘এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস’-এও। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী মানিক বনিক বলেন, ‘‘শুধু এরর কারেকশন নয়, আরও কিছু বাধা টপকাতে হবে আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম কম্পিউটার হাতে পাওয়ার জন্য। তার মধ্যে অন্যতম হল স্থিতিশীল কিউবিট তৈরি করা (যা কোয়ান্টাম সুপারপজ়িশনকে ধরে রাখে), বহু কিউবিটের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা এবং কিউবিটগুলোকে নিজেদের প্রয়োজন মতো নিয়ন্ত্রণ করা। হার্ভার্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সাফল্য এ ক্ষেত্রে আমাদের নতুন দিশা দেখাবে। এ ছাড়াও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাজের জন্য খুবই কম তাপমাত্রার পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। সেটাও এক প্রকার বাধা।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সবচেয়ে বড় বাধা হল, অর্থ। সীমিত খরচে সাধারণ মানুষের জন্য কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি রীতিমতো চ্যালেঞ্জের বিষয়। ইউনিভার্সাল কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ এখন থেকেই ধারণা করা সম্ভব নয়, তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম ইনফরমেশন এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের প্রয়োগ আমরা খুব শীঘ্রই দেখতে পাব।’’