আমরা যদি সত্যি সত্যি নিজেদের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে গণ্য করি, তা হলে আমাদের কাছে সব রকম প্রত্যাশিত প্রাণঘাতী হুমকির মোকাবিলা করার ক্ষমতা বা প্রস্তুতি থাকা দরকার। বিগত ২০ বছরে একটার পর একটা প্রাণঘাতী জীবাণুর যে ভাবে উত্থান ঘটেছে, আর আমাদের তাদের হাতে অসহায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, এবং এখনও হচ্ছে, তাতে একটা অপ্রীতিকর প্রশ্ন বার বার উঠে আসছে— মনুষ্যজাতি কি তার আধিপত্য হারাতে চলেছে?
বর্তমান অতিমারিটি নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থতা আর প্রস্তুতির অভাব ঢাকতে গিয়ে অনেকে বলছেন, একটা অদৃশ্য ভাইরাস এসে আমাদের এ রকম একটা প্রাণঘাতী শিক্ষা দিয়ে যাবে, কখনও আন্দাজ করা যায়নি। কিন্তু বাস্তবে এ রকম ঘটনার আশঙ্কা রোগ বিশেষজ্ঞদের অনেক আগে থেকেই ছিল। বলা বাহুল্য, এ রকম ভাইরাস বা জীবাণু প্রতিরোধ বা দমন করার অস্ত্র একটাই— বিজ্ঞান। তাই এই ভাইরাসটি দমনের ব্যর্থতা এবং তার সঙ্গে জড়িত বৈজ্ঞানিক হতাশা যতই প্রকট হয়ে উঠছে, আর একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্থাপন অনিবার্য হয়ে পড়ছে— আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা এবং তার প্রয়োগের পদ্ধতি বা প্রস্তুতি কি বর্তমান সময়ের ক্ষেত্রে সত্যিই প্রাসঙ্গিক? এর উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই বিশ্লেষণ করা দরকার আমাদের বর্তমান বিজ্ঞান শিক্ষার পদ্ধতি এবং তার এই প্রকার অতিমারি মোকাবিলা করার ক্ষমতা গঠনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে।
আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হয় স্কুল থেকে। তাই সেখান থেকেই শুরু করা যাক। একটা সময় ছিল যখন প্রধানত বইয়ের মাধ্যমে ছাত্রদের তথ্য প্রদান করার দায়িত্ব শুধু শিক্ষকেরাই পালন করতেন। স্কুল লাইব্রেরি ছিল সেই তথ্যের ভান্ডার। পড়াশোনার জগতে মেধা বা প্রতিভা তাই মাপা হত মানুষের সমস্যার সমাধানে জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষমতার থেকে বেশি সেই জ্ঞানকে মস্তিষ্কে ধরে রাখার স্মৃতিশক্তির উপর। পরীক্ষাও হত অনেকটাই সেই নিয়মে। কোনও তথ্য জোগাড় করা ছিল সেই সময় কষ্টকর। তাই তথ্যের মূল্যায়নের হিসেবটাও ছিল আজকের থেকে ভিন্ন। আজ যে কোনও তথ্য ঘরে বসে নিজের কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাওয়া যায়, যা সেই সময় ছিল অকল্পনীয়। আগের শতকের পড়াশোনার সেই পদ্ধতি বর্তমান সময়েও ফের প্রাসঙ্গিক।
একুশ শতকের প্রথম থেকেই ইন্টারনেটের ব্যাপক হারে প্রয়োগ শুরু হওয়ার ফলে মানুষের যোগাযোগ ক্ষমতা আর তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই শতকের প্রথমে আর একটি চমৎকার তথ্য সন্ধানের যন্ত্রের আবির্ভাব হয়, যার নাম ‘গুগল’। এই সন্ধান যন্ত্রের সাহায্যে যে কোনও তথ্য বা প্রশ্নের উত্তর নিমেষে পাওয়া যায়, যা দ্রুত গতিতে পৃথিবীর অনেক সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে গুগল এবং তার মতো অসংখ্য তথ্য-সন্ধান যন্ত্র আজ আমাদের তথ্য জোগাড়ের দৈনন্দিন সঙ্গী হয়ে উঠেছে। কারণ, তাদের সাহায্যে যে কোনও তথ্য প্রায় বিনা খরচায় আর নির্ঝঞ্ঝাটে পাওয়া যায়। সে পড়াশোনার কোনও বিষয় হোক, বা বিনোদনের জন্য গল্প হোক।
নব্বইয়ের দশক ও তার আগে শিক্ষকরা যে তথ্য দিতেন, তা-ই ছিল আমাদের জন্য বেদবাক্য। কারণ, বই ছাড়া সেটা যাচাই করার কোনও সহজ উপায় আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু, আজকে ছাত্ররা শিক্ষকদের দেওয়া সব তথ্য ইন্টারনেটের সাহায্যে বিভিন্ন সূত্র থেকে শুধুমাত্র যাচাই করতে পারে না, সেই বিষয়ের যাবতীয় তথ্য জোগাড়ও করতে পারে, যা হয়তো ক্লাসে পড়ানো হয় না। তার ফলে কিছু ছাত্র শিক্ষকদের তুলনায় অধিক তথ্যগত জ্ঞান অর্জন করে মাঝে মাঝে স্কুলে শিক্ষকদের কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলছে। কিন্তু যেটা প্রাথমিক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার সবচেয়ে ক্ষতি করছে, তা হল বেশ কিছু স্কুলে এখনও ক্লাসে শুধু ‘মুখস্থ বিদ্যা’র উপর জোর দিয়ে ক্লাস-নোট দেওয়া হচ্ছে এবং সেগুলির সঠিক প্রয়োগ শেখানো হচ্ছে না। অনেক সময় এমন অভিযোগও আসছে যে, ক্লাসে শিক্ষক বইয়ের বাইরে কোনও বিষয় বা প্রশ্ন আলোচনা করতে অনিচ্ছা বা বিরক্তি প্রকাশ করছেন। এর ফলে বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী শেখার কৌতূহল হারাচ্ছে এবং কিছুটা অভিমানবশত বিজ্ঞান শিক্ষার সবচেয়ে বড় অঙ্গ, ক্লাসে প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিচ্ছে।
এর চেয়েও বড় চিন্তার বিষয় হল, সার্বিক ভাবে অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুলের পঠনপাঠন পদ্ধতির উপর ক্রমশ বিশ্বাস হারাচ্ছে। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট— যে তথ্য বা জ্ঞান আমি বাড়িতে বসে বিনা খরচায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে পেতে পারি, সেটা অর্জন করার জন্য মাইনে দিয়ে স্কুলে যাওয়ার কী দরকার? এবং এই যুক্তি একেবারে ক্লাসের নীচের দিকের ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে আসছে না, আসছে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে, যারা স্কুলের পড়াশোনাটা বৌদ্ধিক বিকাশের একটা অনুশীলন হিসেবে পেতে চায়, শুধু মুখস্থ বিদ্যা বিতরণের ক্ষেত্র হিসেবে নয়। সাধারণত এ রকম ছাত্র-ছাত্রীরা, উচ্চশিক্ষার স্তরে গিয়ে ‘আউট অব দ্য বক্স’ কিংবা ‘ইনোভেটিভ’ বা উদ্ভাবনী আখ্যা পাওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং পরবর্তী কালে গবেষণা করে নতুন বা অজানা তথ্যের সন্ধান দিতে বাকিদের থেকে বেশি সক্ষম হয়। এ রকম ছাত্র-ছাত্রীরাই হয়ে ওঠে আমাদের বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ— কারণ এদের সেই প্রয়োজনীয় মানসিকতা আর আবেগ আছে, যা দিয়ে তারা পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যা ডিঙিয়ে অজানা জ্ঞান খনন করতে পারে। আর সেই অজানা তথ্যের সন্ধানেই আছে আমাদের বেঁচে থাকার মন্ত্র— এই করোনাভাইরাসকে দমন করার পদ্ধতিটি, যা আজও আমাদের জানা নেই, তারই একটা ছোট্ট অংশ।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই মুখস্থ বিদ্যার বিস্তৃত জালে পড়ে অনেক প্রতিভাশালী ছেলে-মেয়ে সেই অজানাকে সন্ধানের উপায় শিখছে না, আর তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বিজ্ঞান পড়ার ও শেখার উৎসাহ হারাচ্ছে। আর যারা উচ্চশিক্ষার জন্য প্রায় সব বিষয়ে ‘ফুল মার্কস’ পেয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে, তাদের মধ্যেও প্রত্যাশিত সৃজনশীলতার অভাব প্রকট ভাবে দেখা যাচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষার এই সমস্যা শুধু আমাদের ভাবলে ভুল হবে। এই সঙ্কট পৃথিবী জুড়ে। তাই সময়ের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ আজ অনুভব করছে। যে হেতু বিজ্ঞান শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য, মানুষের সমস্যার সমাধান করা, তাই অনেক দেশ পুঁথিগত বা মুখস্থ বিদ্যা বর্জন করে ইতিমধ্যে স্কুল থেকেই ‘সমস্যা-ভিত্তিক’ বা ‘প্রবলেম-বেসড’ পড়াশোনা আরম্ভ করেছে। এই প্রথায় ছেলেমেয়েদের তথ্য মুখস্থ বা মনে রাখার বদলে মানুষের বিভিন্ন সমস্যায় তার প্রয়োগের অনুশীলন দেওয়া হয়। তাই তার সঙ্গে পরীক্ষাও হয় ‘বই খুলে’ বা ‘ওপেন-বুক’ প্রথায়। এই ‘ওপেন বুক টেস্ট’-এ ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের জানা বিজ্ঞানের সাহায্যে অপরিচিত বা অজানা সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হয়। এবং এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় যেখান থেকে খুশি তথ্য জোগাড় করার। এই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য, তথ্য দিয়ে অযথা ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্ক ভরাট না করা, কারণ সেটা আজ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজেই পাওয়া যায়। বরং, তাদের মস্তিষ্ককে চাপমুক্ত রেখে নির্বিঘ্নে সমস্যা সমাধানের চিন্তার সুযোগ দেওয়া এবং ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। এর পাশাপাশি আর একটি পদ্ধতি বিজ্ঞান শিক্ষায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে— ‘প্রজেক্ট-বেসড লার্নিং’, অর্থাৎ অনুশীলন বা প্রকল্প-ভিত্তিক শিক্ষা। যে হেতু বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের সাফল্য অনেকটা তাদের ব্যবহারিক দক্ষতা দিয়ে নির্ণয় করা হয়ে থাকে, তাই এই শিক্ষা পদ্ধতিতে তাদের তত্ত্বের পর্যায়ে শেখানো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কৌশল নিজের হাতে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করার সুযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে, তাদের শেখার উৎসাহ এবং আত্মবিশ্বাস উভয়ই দৃঢ় হয় এবং তার সঙ্গে মেলে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ। তাই ক্লাসের বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে এই ‘বেঞ্চ-ওয়ার্ক’ অনুশীলনের উপর জোর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও পৃথিবী আজ বুঝতে পারছে।
আজকে বিজ্ঞান শিক্ষার এই সঙ্কটের নেপথ্যে স্কুলের বিজ্ঞান পড়ানোর পদ্ধতি শুধুমাত্র দায়ী বললে অন্যায় হবে, যদিও সেখান থেকেই এই সমস্যার শুরু। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের বিজ্ঞান শিক্ষাও পুরোপুরি মুখস্থ বিদ্যার উপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই উচ্চশিক্ষার পড়াশোনা সম্বন্ধেও একই রকম অভিযোগ ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে মাঝে মাঝে শোনা যায়। কিন্তু, যে ছাত্র বা ছাত্রী কোনও দিনও সমস্যাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে ভাবতেই শেখেনি, বা যাদের ব্যবহারিক ভাবে কোনও বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান করার অভিজ্ঞতা নেই, তাদের কাছ থেকে হঠাৎ করে গবেষণামূলক পড়াশোনা বা কাজ আশা করা বৃথা। বিজ্ঞানের অধ্যাপকদের কাছেও তাদের সঙ্গে নিয়ে কোনও গবেষণা প্রকল্প চালানো কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও এটা স্বীকার করা প্রয়োজন যে, আমাদের উচ্চশিক্ষা স্তরেও অনেক জায়গায় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে।
এই তথ্যভিত্তিক বা মুখস্থভিত্তিক বিদ্যা অর্জনের আর একটি গভীর সমস্যা রয়েছে, বিশেষ করে ভারতের মতো দেশের জন্য— কর্মসংস্থান। বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৩৯ কোটি এবং তার মধ্যে ৬৫ শতাংশের (৯০ কোটি) গড় বয়স ৩৫ বছরের কম। এরা অনেকেই বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী, যারা আগামী দিনে কর্মসংস্থানের সন্ধানে বেরোবে। কিন্তু, এত সংখ্যক বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আপাতত এ দেশে নেই। তা হলে এদের ভবিষ্যৎ কী? সোজা কথায়, এই সঙ্কট এড়াতে আমাদের আরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা একমাত্র সম্ভব, যদি বেশ কিছু বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী, যারা চাকরি চাইছে, তাদের চাকরিদাতায় পরিণত করা হয়। এটা বলা যত সহজ, করা তত নয়। এই কাজ রূপায়ণে প্রয়োজন বিজ্ঞান শিক্ষার আমূল পরিবর্তন। শুধুমাত্র আমরা যদি বিজ্ঞান শিক্ষাকে আরও সমস্যাভিত্তিক এবং অনুশীলন বা প্রকল্পভিত্তিক করে তুলতে পারি, তা হলে বেশ কিছু সংখ্যক ‘ইনোভেটিভ’ ছেলে-মেয়ে খুঁজে বার করা সম্ভব হবে। এরা নিজেদের স্বতন্ত্র চিন্তা ও প্রচেষ্টায় অভিনব প্রযুক্তির সাহায্যে নতুন শিল্পের সূচনা করার প্রশিক্ষণ এবং প্রেরণা পাবে।
ঠিক এই ভাবেই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক শিল্প। সেই দেশগুলোর শক্তিশালী অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি বিজ্ঞান। এদের এই সাফল্যের পাশাপাশি তৈরি হবে আরও কর্মসংস্থান। যত সংখ্যায় ছেলে-মেয়ে এই প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসবে, তত বেশি সমৃদ্ধ হবে আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক শিল্প আর তার সঙ্গে জড়িত কর্মসংস্থান। এবং এই ভাবেই কোটি কোটি বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের আসন্ন বেকারত্বের হাত থেকে রেহাই দেওয়া সম্ভব হবে। এটা নিছক স্বপ্ন মনে হতে পারে। তবে এই স্বপ্ন দেখা এবং তাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা ছাড়া আমাদের হাতে সম্ভবত আর কোনও উপায় নেই।
বিভাগীয় প্রধান, বি সি গুহ সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনলজি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়