ISRO

উপগ্রহের মাধ্যমে প্রতিরক্ষার গোপনীয়তা রক্ষা, বঙ্গতনয়ার লড়াই সফল ইসরো-র পরীক্ষায়

পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা এ দেশে প্রথম বোঝাতে শুরু করেছিলেন বঙ্গতনয়া উর্বশীই।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২১ ০০:৩৬
Share:

ইসরো-র সোমবারের পরীক্ষা। আমদাবাদে। ইনসেটে, অধ্যাপক উর্বশী সিনহা। গ্রাফিক- নিরূপম পাল।

এক বঙ্গতনয়ার দেখানো পথে হেঁটেই শেষ পর্যন্ত ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় সফল হল ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’। হাজার চেষ্টা চালিয়েও গোপনে কেউ জেনে ফেলতে পারবে না এমন ভাবে বার্তা চালাচালি করে। লেসার রশ্মির মাধ্যমে। ভারতে এই প্রথম।

Advertisement

প্রতিবেশী ও শত্রু দেশগুলির গোপন হানাদারির হাত থেকে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত ভাবে রক্ষা করার উপায়টা এ দেশে প্রথম বোঝাতে শুরু করেছিলেন বঙ্গতনয়া উর্বশী সিনহা। বেঙ্গালুরুর ‘রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আরআরআই)’-এর অধ্যাপক উর্বশী। ৮ বছর আগে। ২০১৩-য়। সেই সময় থেকেই ইসরো ও ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা উন্নয়ন সংস্থা (‘ডিআরডিও’)-র কর্তাদের উর্বশী বোঝাতে শুরু করেন, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলতে মহাকাশকে ব্যবহার করতেই হবে। এ ব্যাপারে উপগ্রহের সহায়তার কোনও আদর্শ বিকল্প নেই। হওয়া সম্ভবই নয়। সেটা হবে ফ্রি স্পেস কোয়ান্টাম কমিউনিকশন।

এ কথা বোঝাতে যে উর্বশী সফল হয়েছেন তা প্রমাণ হল সোমবার আমদাবাদে ইসরোর সফল পরীক্ষায়। ইসরোর ‘স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার (এসএসি)’-এ দু’টি বাড়ির মধ্যে ওই বার্তা চালাচালির মাধ্যমে। ৩০০ মিটার দূরত্বে। লেসার রশ্মি ব্যবহার করে। ভারতে এই প্রথম।

Advertisement

এর দু’মাস আগেই (জানুয়ারি) অবশ্য পরীক্ষাটা একটু অন্য ভাবে করে দেখিয়েছিলেন উর্বশী। বেঙ্গালুরুর আরআরআই-এ ৫০ মিটার দূরত্বে থাকা দু’টি বাড়ির মধ্যে।

আমদাবাদে ইসরো-র ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি (পিআরএল)’-র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর গৌতম সামন্ত বলছেন, ‘‘এই সাফল্যের পর ইসরো এমন পরীক্ষা চালাবে আরও বেশি দূরত্বে। ১ থেকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত। এই সব পরীক্ষানিরীক্ষার সাফল্যের ভিত্তিতেই আর ৫-৬ বছরের মধ্যে মহাকাশে উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ইসরো-র। যাতে প্রতিবেশী ও শত্রু দেশগুলির গোপন হানাদারির হাত থেকে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত ভাবে রক্ষা করা যায়। এই পদ্ধতিতে।’’

উদ্দেশ্য, একই হলেও ইসরো-র সোমবারের পরীক্ষার (একলা ফোটন নিয়ে। ফোটন আলোর কণা।) সঙ্গে উর্বশীর জানুয়ারির পরীক্ষার পদ্ধতিগত (এনট্যাঙ্গলড ফোটনকে ব্যবহার করে, যেখানে একজোড়া ফোটন রয়েছে) ভিন্নতা রয়েছে, জানিয়েছেন গৌতম।

তাঁর কথায়, ‘‘বলা ভাল, ইসরো-র পরীক্ষা পদ্ধতিটি প্রাথমিক ধাপ। উর্বশী যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা করেছেন জানুয়ারিতে সেই পদ্ধতি নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার ব্যাপারে আরও বেশি কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে। ধাপে ধাপে সেই পদ্ধতিতেও পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে ইসরো ও কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক (ডিএসটি)-এর। এই ভাবে তথ্যের সুরক্ষাকে নিশ্চিত করা সম্ভব হলে আগামী দিনে কোনও কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করেও হ্যাকাররা গোপনে তার হালহদিশ জেনে ফেলতে পারবে না।’’

এর আগে মহাকাশ থেকে উপগ্রহের মাধ্যমে এমন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছে আর মাত্র একটি দেশ। চিন। ২০১৬-র অগস্টে।

উর্বশী জানালেন, ২০১৩ থেকেই তিনি ইসরো, ডিআরডিও-র কর্তাদের বোঝাতে শুরু করেন যে ভাবে হ্যাকারদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে দিন কে দিন, তাতে চালু পদ্ধতিতে দেশের প্রতিরক্ষার যাবতীয় তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা খুবই মুশকিল। যে কোনও শত্রু দেশ চাইলে যে কোনও মুহূর্তে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চালাচালির ভিতরে গোপনে ঢুকে পড়তে পারে। তাতে দেশের নিরাপত্তা দারুণ ভাবে বিঘ্নিত হবে।

উর্বশীর কথায়, ‘‘গোড়ার দিকে আমার কথাটা কেউ সে ভাবে মেনে নিতে চাননি। কিন্তু ২০১৬-য় চিন মহাকাশ থেকে সফল ভাবে পরীক্ষা চালানোর পর থেকেই আমি ইসরো, ডিআরডিও-র কর্তাদের বিষয়টি বোঝাতে আরও উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেই সময় ইসরোর ‘চন্দ্রযান-১’ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অধুনা অবসরপ্রাপ্ত জে নাগেশের সঙ্গে প্রথম আমার সবিস্তারে কথা হয়েছিল এ ব্যাপারে।

বেঙ্গালুরুর রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারে উর্বশী।

লন্ডনে জন্ম উর্বশীর। তার পর মা, বাবার সঙ্গে ফিরে আসেন ভারতে। বাবার বদলির চাকরি। প্রথমে মুম্বই, পরে পশ্চিমবঙ্গের সিউড়ি, কলকাতা হয়ে বেঙ্গালুরু, দিল্লি ঘুরে আবার কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বি এসসি করে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যাচারাল সায়েন্সে ট্রাইপস করতে। মাস্টার্সের পর কেম্ব্রিজেই পিএইচডি উর্বশীর। প্রথম পোস্ট ডক্টরালও কেম্ব্রিজেই। কানাডার ওয়াটার্লু বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরাল। তার পর দেশে ফেরেন ২০১২-য়। আরআরআই-এর অধ্যাপক হয়ে। সেখানেই দেশের প্রথম ফোটনিক্স বেস্ড‌ কোয়ান্টাম টেকনোলজির গবেষণাগার নিজের হাতে গড়ে তোলেন উর্বশী। ২০১৭ থেকে ইসরোর সঙ্গে যৌথ ভাবে দেশের প্রথম উপগ্রহভিত্তিক কোয়ান্টাম টেলিযোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রকল্পেরও গোড়াপত্তন করেন তিনি। উর্বশী এখন জাতীয় কোয়ান্টাম মিশনের ড্রাফটিং কমিটিরও এক জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

তবে ইসরো যে পদ্ধতিতে সোমবার পরীক্ষা চালিয়েছে, তাতে কিছু সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছেন উর্বশী। কারণ, ওই পদ্ধতিতে একক ফোটন (বা একলা ফোটন) নিয়ে কাজ করতে হয়। উর্বশী বলছেন, ‘‘অনেক সময়ই সঙ্গে থেকে যায় আরও কিছু ফোটন। তাতে নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার প্রযুক্তির ফাঁকফোকড় গলে হ্যাকারদের ঢুকে পড়ার আশঙ্কা থাকে। যা আমার ব্যবহার করা এনট্যাঙ্গলড ফোটন পদ্ধতির নেই। তবে ইসরো-র পরীক্ষা মানতেই হবে এ দেশে একটি মাইলফলক হয়ে থাকল।’’

উর্বশী খুশি তাঁর টানা ৮ বছরের লড়াইও ইসরো-র পরীক্ষায় স্বীকৃতি পেল বলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement