মহাসাগরে ভাসমান তেল। -ফাইল ছবি।
জাহাজ থেকে পড়া রাশি রাশি অপরিশোধিত তেলের দূষণ থেকে কি এ বার বাঁচানো যাবে সাগর, মহাসাগরগুলিকে? সেই বিষের হাত থেকে বাঁচানো যাবে সামুদ্রিক প্রাণী বা উপকূলবর্তী প্রাণকে? বাঁচানো যাবে পরিবেশ, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র?
সেই আশাকেই জোরালো করে তুলল সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ফলাফল। জানাল, সাগরে, মহাসাগরে দীর্ঘ দিন ধরে ভেসে থাকা অপরিশোধিত বিষাক্ত তেলকে জলে মিশে যেতে সাহায্য করে সূর্যালোকই। সেই তেলকে ভেঙে তৈরি করে নানা ধরনের রাসায়নিক যৌগ। যেগুলি সহজেই জলে দ্রবীভূত হয়। মিশে যেতে পারে জলে।
ফলে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তেলে, জলে মিশ খায় না বলে সাগর, মহাসাগরের বাস্তুতন্ত্র উত্তরোত্তর নষ্ট হয়ে যাওয়ার যে বিপদ বাড়ছে দিন কে দিন তার থেকে রেহাই পাওয়া বা তাকে কিছুটা কমিয়ে আনার পথ হয়তো খুলে যেতে পারে আগামী দিনে।
আমেরিকার ‘উড্স হোল ওশ্নোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশন (হুয়াই)’-এর বিজ্ঞানীদের এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এ। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম— ‘সানলাইট ড্রিভ্ন ডিসলিউশন ইজ আ মেজর ফেট অব অয়েল অ্যাট সি’।
আমেরিকার ইতিহাসে জাহাজ থেকে মহাসাগরে তেল পড়ার সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ১২ বছর আগে। ২০১০-এ। সেই ঘটনার নাম ‘ডিপওয়াটার হরাইজ্ন অয়েল স্পিল’। আটলাান্টিক মহাসাগর লাগোয়া মেক্সিকো উপসাগরে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয়েছিল ডিপওয়াটার হরাইজ্ন অয়েল রিগ-এ। কম করে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল সরকারি হিসাবে। তার জেরে মেক্সিকো উপসাগরে ছড়িয়ে পড়েছিল ২১ কোটি গ্যালন অপরিশোধিত বিষাক্ত তেল। সেই ছড়িয়ে পড়া তেলের বিষাক্ত ছোবল সামুদ্রিক প্রাণী ও জলজ বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচাতে ১২ বছর ধরে কোটি কোটি ডলার ব্যয় খরচ করেছে আমেরিকা ও মেক্সিকো সরকার।
সাগরে, মহাসাগরে জাহাজ থেকে পড়া অপরিশোধিত তেলের পরিণতি কী, তা এখনও সঠিক ভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি সমুদ্রবিজ্ঞানীদের পক্ষে।
এত দিন তিনটি সম্ভাব্য পরিণতি নিয়েই আলোচনা করতেন বিজ্ঞানীরা। প্রথমত, সমুদ্রে থাকা অণুজীব সেই তেল খেয়ে তাদের বিপাকক্রিয়ার মাধ্যমে তেলকে ভেঙে ফেলে তাদের বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ তৈরি করে নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, তেল বাষ্পীভূত হয়ে গ্যাস হয়ে উবে যেতে পারে সাগর, মহাসাগরের জলের উপরিতল থেকে। তৃতীয়ত, ঢেউয়ের সঙ্গে মাঝসাগরে ভেসে থাকা সেই তেল সরতে সরতে এসে পৌঁছয় উপকূলে।
কিন্তু হুয়াই-এর গবেষকরা দেখেছেন, মেক্সিকো উপসাগরে ১২ বছর আগেকার দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ তেল ছড়িয়ে পড়েছিল তার ১০ শতাংশই জলে দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছে সূর্যালোকের দৌলতে। যে পদ্ধতির নাম— ‘ফোটো-ডিসলিউশন’।
এই পদ্ধতিতে যে সাগরের তেল জলে মিশতে পারে তার আঁচ আগেই মিলেছিল।
এ বার গবেষকদের কৃতিত্ব, তাঁরা দেখাতে পেরেছেন, কোন কোন আলোকতরঙ্গে বছরের কোন কোন সময়ে মহাসাগরে ভাসা তেলের স্তর কতটা পুরু বা পাতলা হলে জলে কী পরিমাণে মিশে যেতে পারে সেই ভাসমান বিষ।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এর ফলে, বোঝা গেল, মহাসাগরে ভাসমান তেলের সম্ভাব্য পরিণতিগুলি সম্পর্কে আগের ধারণা বদলাতে হবে। সূর্যালোকের দৌলতে ভাসমান তেলের অংশ যে হেতু সেই পরিমাণে ঢেউয়ের সঙ্গে এসে উপকূলে পৌঁছয় না, তাই সেই তেল থেকে উপকূলবর্তী প্রাণের বিপদ কমানোর পথ হয়তো খুলবে আগামী দিনে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা এ কথা জানিয়েও সতর্ক করেছেন, এখানেই সব কিছু জানা হয়ে যায়নি। ভাসমান তেল থেকে উপকূলবর্তী প্রাণের বিপদ কমানো যাবে কি না তা বুঝতে গেলে জানতে হবে সূর্যালোকের দৌলতে জলে মিশে গিয়ে সাগরে, মহাসাগরে ভাসমান তেল যে রাসায়নিক যৌগগুলি তৈরি করে সেগুলি উপকূলবর্তী প্রাণ বা বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে উপযোগী নাকি ক্ষতিকর।