aspirin

বাস্তবের মিরাকিউরল অ্যাসপিরিন

বাজারে আসামাত্র অ্যাসপিরিন সবাইকে মাইলখানেক পিছিয়ে দিল। তিন বছরের মধ্যে এর ব্যবহার আর উপযোগিতা নিয়ে লেখা হল ১৬০-এর বেশি পেপার।

Advertisement

কৌশিক মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:৪০
Share:

তখন প্রায় শেষের মুখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধক্লান্ত পৃথিবী চাইছে নতুন ভাবে বেঁচে থাকার রাস্তা খুঁজে নিতে। এর মধ্যেই স্পেন থেকে অদ্ভুত এক খবর এল। নতুন ধরনের এক জ্বর এসেছে। মাথাব্যথা, কাশি, ফুসফুসে সংক্রমণ আর তার পরেই মৃত্যু। শুনতে অবাক লাগলেও ইউরোপ আর আমেরিকা তার অনেক দিন আগে থেকেই এই জ্বরের কবলে কাঁপছে। শুধু জানায়নি এই ভয়ে, পাছে শত্রুরা বুঝে যায় তারা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলাফল মারাত্মক। যুদ্ধ শেষ হতে না হতে এই অজানা জ্বরের প্রভাবে মরতে লাগল হাজার হাজার মানুষ। যে সব সৈন্য যুদ্ধের বোমার আঘাতকেও সয়ে নিয়েছিলেন, তাঁরা এই নতুন রোগের আক্রমণে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই খতম হয়ে গেলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধও এত সৈন্যকে মারতে পারেনি। করোনা কালের ঠিক একশো বছর আগে পৃথিবীকে গ্রাস করা এই জ্বরের পোশাকি নাম স্প্যানিশ ফ্লু। এ বারের মতো তখনও ভ্যাকসিনের কোনও দেখা নেই। কেউ জানে না কবে আসবে। এ দিকে রোগীদের জ্বর বেড়ে ১০৪ ডিগ্রি হয়ে যাচ্ছে প্রায়ই। বিপন্ন ডাক্তাররা রোগীদের সাময়িক স্বস্তি দিতে বেছে নিলেন বছর কুড়ি আগে আবিষ্কার হওয়া এক অদ্ভুত ওষুধ, নাম অ্যাসপিরিন।

Advertisement

অ্যাসপিরিন আবিষ্কারের ঘটনা থ্রিলারকে হার মানায়। ১৮৬২ সালে এডউইন স্মিথ নামে অ্যান্টিক ব্যবসায়ী কায়রো শহরে এক বৃদ্ধের কাছ থেকে বহু পুরনো এক পুঁথি খুঁজে পান। এই পুঁথি জিশুর জন্মের প্রায় ১৫০০ বছর আগে হায়রোগ্লিফিক্স-এ লেখা। বিষয় অদ্ভুত। গোটা পুঁথি জুড়েই প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন অসুখ আর তাদের নিদান বলে দেওয়া। সেখান থেকেই জানা গেল, নানা ভেষজ ওষুধের মধ্যে উইলো গাছের ছালের রসকে যে কোনও রকম ফোলা, ব্যথা আর জ্বরের উপশমে ব্যবহারের নিদান দেওয়া হয়েছে। এই জ্ঞান মিশর থেকে গ্রিসে গেল। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রিটাস, যাঁর নামে শপথ করে ডাক্তাররা আজও জীবন শুরু করেন, তিনিও গর্ভবতী মহিলাদের উইলো গাছের পাতার চা খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। এতে নাকি গর্ভযন্ত্রণা কমে। স্মিথ যখন এবারস প্যাপিরাস খুঁজে পাচ্ছেন, তার আগেই ইউরোপ জুড়ে উইলো গাছের ছাল নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে।

১৭৬৩-তেই অক্সফোর্ডশায়ারের পাদ্রি এডওয়ার্ড স্টোন ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমাতে সিঙ্কোনা গাছের ছাল ছাড়া অন্য কিছু কাজ দেয় কি না, দেখতে গিয়ে উইলো গাছের ছাল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেন। পাঁচ বছর গবেষণা শেষে তিনি রয়্যাল সোসাইটিতে যে চিঠিটা লিখেছিলেন, সেটা আজও যত্ন করে রাখা আছে। তিনি লিখলেন, “এই ইংরেজ গাছটির (উইলো) ছালের রসের উদ্দীপনা সৃষ্টির ক্ষমতা মারাত্মক। শুধু তা-ই না, এটা জ্বর ও জ্বরের শারীরিক কষ্ট কমিয়ে এক অদ্ভুত প্রসন্নতা দিতে সক্ষম।” সেই প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানীরা উইলো কাঠকে ক্রিকেট খেলার বাইরে অন্য কিছু ভাবতে শুরু করলেন। কী সেই যৌগ, যার ফলে উইলো গাছের ছালে এমন অদ্ভুত গুণ রয়েছে? গোটা ইউরোপ জুড়ে শুরু হল এই অজানা ওষুধের সন্ধান।

Advertisement

প্রথম সাফল্য পেলেন জার্মান বিজ্ঞানী জোহান আন্দ্রিয়াস বুকনার। উইলো গাছের ছালের রসকে ক্রমাগত পরিশুদ্ধ করতে করতে তিনি এক হলুদ রঙের কেলাস খুঁজে পেলেন। উইলোর ল্যাটিন নাম স্যালিক্স থেকে এই নতুন যৌগের নাম দিলেন স্যালিসিন। জার্মানদের চিরশত্রু ফরাসিরাও বসে ছিল না। পরের বছরই ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের লেরু এই যৌগকে আরও পরিশুদ্ধ রূপ দিলেন। সেই কাজকে এক ধাপ এগিয়ে দিলেন বিজ্ঞানী পিরিয়া। খুঁজে পেলেন স্যালিসিনের থেকেও বেশি কার্যকর যৌগ স্যালিসাইলিক অ্যাসিড আর দাবি করলেন, এই যৌগই সেই অমৃতভান্ড, যার সন্ধানে প্রায় একশো বছর বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন।

দাবি তো করলেন। কিন্তু প্রমাণ হবে কী ভাবে? জার্মান, ফরাসিদের পরে ব্যাটন তুলে নিলেন স্কটিশরা। স্কট চিকিৎসক টমাস ম্যাকলাগান এই যৌগের কথা শুনেছিলেন। আর এটাও শুনেছিলেন, ভয়ে কেউ এটা খেতে চাইছে না। অগত্যা তিনি যে সিদ্ধান্ত নিলেন, তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঠিক করলেন, প্রথম হিউম্যান ট্রায়াল তাঁর উপরেই হবে, আর করবেন তিনি নিজে। প্রথমে পাঁচ, তার পর দশ, তার পর বাড়াতে বাড়াতে তিরিশ গ্রেন ওজন অবধি এই যৌগ খেয়ে নিলেন ম্যাকলাগান। প্রতি বার নিজের রক্তচাপ, হৃদ্স্পন্দন পরীক্ষা করতেন। যখন দেখলেন দিব্যি ভালই আছেন, তখনই ডান্ডির রয়্যাল ইনফার্মারির জ্বর আর বাতের রোগীদের উপরে ১২ গ্রেন করে এই যৌগ প্রয়োগ করলেন তিনি। ফল খুব ভাল হলেও রোগীদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দিল। ম্যাকলাগান হাল ছেড়ে দিলেন।

বিজ্ঞানীরা প্রায় দশ বছর এটার কথা ভুলে রইলেন। ১৮৯০ নাগাদ জার্মান রঙের কোম্পানি বায়ার ভাবল, রঙের সঙ্গে কিছু নতুন ওষুধের ব্যবসাও করা যাক। প্রথমেই তারা জ্বর আর ব্যথা কমানোর ভাল কোনও ওষুধের সন্ধান করছিল। বাজারে সেটারই সবচেয়ে বেশি চাহিদা। তাদের ফার্মাসিউটিক্যাল বিভাগের প্রধান আর্থার ইসেনগ্রুন ম্যাকলাগানের পরীক্ষার কথা জানতেন। তিনি রসায়ন বিভাগের বিজ্ঞানী ফেলিক্স হফমানকে দায়িত্ব দিয়ে বললেন, “স্যালিসাইলিক অ্যাসিডকে নিয়ে এমন কিছু করো, যাতে তার ক্ষমতা একই থাকে, কিন্তু গ্যাস্ট্রিক না হয়।” ১৮৯৭ সালে হফমান মিডোসউইড নামের আগাছা থেকে আগের এক বিজ্ঞানী গেরহার্টের পদ্ধতি মেনে এক নতুন যৌগ বানালেন। নাম, অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিড। হফমান রিপোর্টে লেখেন, তাঁর তৈরি যৌগ থেকে গ্যাস্ট্রিক হয় না। কিন্তু সেই বিশ্বাসকে নস্যাৎ করলেন বায়ারের ডাক্তার হাইনরিখ ড্রেসার। তিনি রিপোর্টে লিখলেন “গ্যাস্ট্রিক না হলেও আমার বিশ্বাস, এই ওষুধে রোগীদের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক বেড়ে যাবে। বরং রোগীর ব্যথা কমাতে হফমানেরই আবিষ্কার করা অন্য যৌগটাকে বাজারজাত করতে বলব।” এই অন্য যৌগটার নাম? হেরোয়িন।

ড্রেসারের রিপোর্ট পেয়ে বেজায় চটে গেলেন ইসেনগ্রুন। রিপোর্টের উত্তরে লিখলেন,“যা-ই হোক, এটাকে বাজারে আনতেই হবে।” ড্রেসার পাল্টা উত্তর দিলেন “বার্লিনে বসে লেকচার দেবেন না। এটা ফালতু একটা যৌগ।” তর্ক এমন জায়গায় উঠল, স্বয়ং বায়ারের মালিক তিন জনকে নিয়ে মিটিং-এ বসলেন। ঠিক হল, ইসেনগ্রুনের দায়িত্বে এটাকে বাজারে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু নাম কী হবে? চন্দ্রবিন্দুর ‘চ’, বেড়ালের তালব্য শ-র মতো অ্যাসিটাইল-এর অ্যা, মিডোসউইডের ল্যাটিন নাম স্পিরিয়া থেকে স্পির আর শেষে বায়ারের সব ওষুধের মতো এটাতেও ইন। অ্যাসপিরিন। ট্যাবলেট আকারে বিক্রি হত টিউবে। একেবারে ঠিক ধরেছেন। টিনটিনের ‘কালো সোনার দেশে’ অভিযানে এই রকম একটা অ্যাসপিরিনের টিউবের মধ্যে রাখা অন্য ট্যাবলেট খেয়ে বেচারি জনসন রনসনের দুর্দশার কথা তো সবাই জানে।

বাজারে আসামাত্র অ্যাসপিরিন সবাইকে মাইলখানেক পিছিয়ে দিল। তিন বছরের মধ্যে এর ব্যবহার আর উপযোগিতা নিয়ে লেখা হল ১৬০-এর বেশি পেপার। ১৯১৫ সাল পর্যন্ত কোনও চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই কেনা যেত। ফলে দেদার বিক্রি হত অ্যাসপিরিন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই বায়ার-এর অ্যাসপিরিনের পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে একাধিক সংস্থা অ্যাসপিরিন তৈরি করতে শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধ ও ফ্লু-তে একমাত্র হাতিয়ার ছিল এই ওষুধ। তবে আমেরিকান ও ব্রিটিশ সেনাদের কাছে যাতে অ্যাসপিরিন না পৌঁছোয়, তার ব্যবস্থা করতে কসুর করেনি জার্মানরা। অ্যাসপিরিনের সমস্ত স্বত্ব দখল করে জার্মান মিলিটারি অনুমোদিত সংস্থা ইগ ফারবেন। সে সময় বায়ারের টিকে থাকা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আমেরিকায় নতুন করে ব্যবসা শুরু করে বায়ার। ১৯৫০ সালে গিনেস বুক অব রেকর্ডস-এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ওষুধের তকমা পেল সে। তার পরেই ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ অবধি অ্যাসপিরিনের দুঃখের দিন। ধীরে ধীরে অন্যান্য আরও বেশি কার্যকর ওষুধ এসে গেল বাজারে। অ্যাসপিরিনের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা শোনা গেল। হারিয়ে যেতে লাগল অ্যাসপিরিন।

আচমকা ১৯৭১ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জন ভার্ন অ্যাসপিরিন ঠিক কী ভাবে কাজ করে, তা খুঁজে বার করে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন। তার পরেই যত দিন যেতে লাগল, এই যৌগের নতুন নতুন সম্ভাবনার দিক খুলে যাতে লাগল। বিজ্ঞানীরা এখন জানেন, কম মাত্রার অ্যাসপিরিন হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমায়, ক্যানসারের সম্ভাবনা কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, এমনকি বুড়ো মানুষদের বেশি দিন বাঁচিয়েও রাখে। “এই ওষুধকে অমৃতভান্ড না বললে আর কাকে বলা যাবে”— বলেছিলেন আর্থার ইসেনগ্রুন। তিনিই প্রথম বায়ারকে এই যৌগের কথা জানান। সবার মত উপেক্ষা করে প্রায় জোর করে একে বাজারজাত করেন। বায়ারে প্রথম হিউম্যান ট্রায়াল তাঁর উপরেই হয়। তবুও এই যৌগের জন্য এক পয়সা রয়্যালটি পাননি। কারণ তিনি ইহুদি। গোটা টাকাটাই পেতেন একা হফমান। অ্যাসপিরিন আবিষ্কারের পুরস্কার হিসেবে ১৯৪৪ সালে হিটলার ইসেনগ্রুনকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেও পাঠিয়েছিলেন। সে তো অনেক পরের কথা। যখন ১৯০০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, অ্যাসপিরিনের পেটেন্ট নেওয়া হল, মানে জন্ম নিল অ্যাসপিরিন, সেই কাগজে কোথাও ইসেনগ্রুনের নামের উল্লেখটুকু ছিল না।

বিজ্ঞানী, ধান্য গবেষণাকেন্দ্র, চুঁচুড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement