প্রতীকী ছবি।
পর্যায়সারণি নিয়ে পর্যালোচনা করার দিন এসেছে আবার। ২০১৯ সালটি ছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব পিরিয়ডিক টেব্ল’। দেমিত্রি মেন্ডেলিভের পর্যায়সারণি বা পিরিয়ডিক টেব্ল আবিষ্কারের দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে ইউনেসকো তাকে এই স্বীকৃতি দিয়েছিল। মৌলের আধার হিসেবে সে এত দিন দিব্যি ছিল। কিন্তু মানুষ ঠগিদের মতো বিজ্ঞানের বাহুবলে প্রকৃতিকে জানার আগ্রহ দেখিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদকেই তছনছ করছে নির্বিচারে। এর ফলে পিরিয়ডিক টেব্লের কিছু মৌলের কী ভাবে নাভিশ্বাস উঠছে, সেই গল্পই আমাদের শুনতে হবে।
আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে যেমন জলের মতো অনেক কিছুই প্রায় উধাও হয়ে যাবে, তেমনই চুপিসাড়ে হারিয়ে যাবে অনেকগুলি মৌল-ও। অন্য সব অবলুপ্তির কথা প্রচারের আলো পেলেও, এই বিষয়টি এখনও অনেকটা ব্রাত্য। মুষ্টিমেয় কিছু বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের গণ্ডি পেরিয়ে সে এখনও স্থান করে নিতে পারেনি সাধারণ মানুষের মনে। অথচ আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা ইলেকট্রনিক গ্যাজেট— যার অন্যতম হচ্ছে স্মার্টফোন— সেগুলি তৈরি করতে গিয়ে কত মৌল যে অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে আজ বিলুপ্তির মুখে, সেই নিয়ে আমাদের কোনও ধারণাই নেই। যেমন, ইন্ডিয়াম এবং ট্যান্টালাম।
টাচস্ক্রিন তৈরিতে ব্যবহৃত ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইড (যেটি আবার সোলার প্যানেলেও কার্যকরী), তার মূল ধাতুটি হচ্ছে ইন্ডিয়াম। ধাতু হলেও সে এতই নরম যে তার গায়ে নখের আঁচড় পড়ে, তাকে ইচ্ছেমতো বাঁকিয়ে যে কোন আকার দেওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতি থেকে সামান্য কিছু মিলিগ্রাম ইন্ডিয়াম পেতে হলে প্রায় কিলোখানেক আকরিক প্রয়োজন। খনিতে মূলত দস্তা আর সীসার সঙ্গেই মিশে থাকে ইন্ডিয়াম। অন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় ধাতু হচ্ছে ট্যান্টালাম। এর তীব্র ক্ষয়রোধী ক্ষমতার জন্য এই ধাতুটি ফোন, পেসমেকার, হিয়ারিং এড বানানোর জন্য বেশ উপযোগী।
একটি স্মার্টফোনের মধ্যে আছে প্রায় তিরিশ রকমের মৌল। তার মধ্যে অনেকগুলি আবার বিরল প্রজাতির! এমনকি সাধারণ ধাতু তামাও প্রচুর মাত্রায় সঞ্চিত নেই প্রকৃতির ভাণ্ডারে।
আর কী কী ধাতু আজ বিপন্ন? উত্তর হচ্ছে, গ্যালিয়াম, আর্সেনিক, ইট্রিয়াম। এমনকি আমাদের চেনা মক্কেল রুপোও জায়গা পেয়েছে এই তালিকায়। মেডিক্যাল থার্মোমিটার, এলইডি, টেলিস্কোপ, সোলার প্যানেল, মাইক্রোচিপ, ট্রানজ়িস্টর, ক্যামেরা লেন্স, আয়না, আতসবাজি ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে রয়েছে এদের ব্যবহার।
সভ্যতা যত এগোবে, ততই আরও বেশি চাহিদা বাড়বে এদের। সেই দাবি মেটাতে গিয়ে প্রকৃতি ক্রমাগত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। তাই অ্যালকেমিস্টরা যেমন ল্যাবরেটরিতে সোনা তৈরি করতে চাইতেন, তেমনই বিজ্ঞানীরাও খুঁজছেন কৃত্রিম উপায়ে এদের তৈরি করার পদ্ধতি। কিংবা অন্য কোনও মৌল দিয়ে কী ভাবে এদের প্রতিস্থাপিত করা যায়, সেই পথ। কিন্তু সে সব অনেকটাই দূরের দিগন্ত।
তা হলে উপায়? ‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম’ গোছের কিছু একটা করতে হবে। ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের রিসাইক্লিং। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি আর বিবিসির যৌথ উদ্যোগে ও দেশে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার, অমন উন্নত দেশেও ৮২ শতাংশ বাড়িতেই রিসাইক্লিংয়ের কোন চিন্তাভাবনা নেই। আমাদের দেশের ছবিটিও একদমই আলাদা নয়। নতুন কিছু কেনার পরে পুরনো ফোন কিংবা ল্যাপটপটি সেই যে তোরঙ্গে গিয়ে ঢোকে, প্রাণে ধরে বেশির ভাগ সময়েই সেটা ফেলা হয় না। অনেক সময় পুরনো ব্যক্তিগত তথ্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেও এমনটা করা হয়ে থাকে। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা জানি না যখন কোনও নতুন গ্যাজেট আমরা কিনি, তখন বিক্রেতা দায়বদ্ধ থাকেন পুরনো গ্যাজেটটি ফেরত নেওয়ার জন্য এবং যথাযথ ভাবে সেটিকে সরকার দ্বারা স্বীকৃত রিসাইক্লিং সংস্থায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
এই প্রসঙ্গে জানানো যেতে পারে যে, দায়িত্ববান বিক্রেতা কিন্তু রিসাইক্লিং করানোর সময় ‘পার্সোনাল ডেটা’ সুরক্ষার ব্যাপারেও যথেষ্ট সচেতন থাকেন। ভারতে এই নিয়ে আইন এসেছে। আশা করা যায়, আরও সুসংবদ্ধ ভাবে এগোবে ই-বর্জ্য ম্যানেজমেন্ট । তা ছাড়া এই রিসাইক্লিং শিল্প কিন্তু আগামী দিনে চাকরি জোগানোর ক্ষেত্রে একটি আশাপ্রদ জায়গা।
একটু বিশদে জানতে গেলে একটা বইয়ের কথা উল্লেখ করতে হয়। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-এর ‘ওয়েস্ট অব আ নেশন’। বইটিতে বেশ ভাল ভাবে ধরা আছে ভারতের বর্তমান হাল। দিল্লির কাছে সিলামপুরের অবস্থা ভয়াবহ। আবার মোরাদাবাদকে বলা যেতে পারে ইন্ডিয়ার ই-বর্জ্যর অলিখিত ‘রিসাইক্ল বিন’। ২০০৮ সালের মন্দার ক্ষতচিহ্ন মেখে ভারতের ‘পিতল রাজধানী’ এখন এই ‘ই-ওয়েস্ট’ প্রক্রিয়াকরণের ব্যবসায় নেমেছে। দৈনিক একশো থেকে তিনশো টাকার বিনিময়ে শ্রমিকরা এখানে প্রতিদিন নয় মেট্রিক টনের বেশি যে ইলেকট্রনিক বর্জ্য এসে জমা হয়, সেগুলির পুনরুজ্জীবনে নিযুক্ত হন। প্রসেসিং পদ্ধতিও খুবই নিম্ন মানের। সার্কিট বোর্ডের ধাতুকে প্লাস্টিক থেকে আলাদা করার পরেই মূলত পোড়ানো, গুঁড়ো করা, ধোয়া আর অ্যাসিডে ডুবিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে নিষ্কাশন করা হয় তামা এবং স্বল্প পরিমাণে সোনা, প্ল্যাটিনাম ইত্যাদি মূল্যবান ধাতু। তার পর বাকি যেটুকু যা পড়ে রইল, তারা ভেসে যায় নদী অথবা ড্রেনের জলে, জমা হয়ে থাকে মাটিতে। বছরের পর বছর সে সব জন্ম দেয় নতুন বর্জ্যের। দূষিত করে জল আর মাটিকে। বিষাক্ত বর্জ্য নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতার যে সব আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি রয়েছে, সেগুলোর কিছুই এখানে মেনে চলা হয় না। যে সব শ্রমিক কাজ করেন, তাঁদের স্নায়বিক রোগ, চর্মরোগ, জিনগত সমস্যা এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।
তা ছাড়া ‘ই -ওয়েস্ট’ শিল্পের পুরো অর্থনীতিটা দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত নিয়মের উপর। যেখানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রায় নেই। স্থানীয় নিজস্ব মূল্যনীতির ওপর নির্ভরশীল পুরো প্রক্রিয়াটি। রয়েছে যথেচ্ছ চোরাচালানের প্রকোপ। বিশাল জনসংখ্যার দেশে ই-বর্জ্য যেমন অফুরন্ত, তেমনই টাকার বিনিময়ে প্রথম বিশ্বের ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ হয়ে ওঠার সুযোগও চোখে পড়ার মতোই।
যাই হোক, বিশাল জটিলতার দিকে না চেয়ে বরং রয়্যাল সোসাইটির কথায় ফিরে আসি। আপাতত বরং তিনটি ‘আর’-এর কেরামতিতেই আমরা নিজেদের মতো করে জব্দ করতে পারি বিরল মৌলের বিলুপ্তির সঙ্কটকে। ‘রিডিউস, রিইউজ় আর রিসাইক্ল’। যে ফোনটি এক বছর আগে কিনেছেন, সেটি পরের বছরেই বদলে না ফেলে একটু অপেক্ষা করুন। কোম্পানি তো ব্যবসার ফাঁদে নতুন মডেল আনবেই। আপনি যদি একটু সমঝে চলেন, ক্ষতি কী? হয়ে গেল ডাউনসাইজ়িং অথবা রিডিউস করা। আপনার পুরনো ফোনটিকে বাক্সে বন্দি না রেখে চ্যারিটিতে দিয়ে দিন, কিংবা ছোট বোনটির বায়না মেটাতে ধরিয়ে দিন তার হাতেই। বিক্রি করে দিন পুরনো ফোন যারা কেনেন, তাঁদের কাছে কিংবা অনলাইন ওয়েবসাইটে। দোকানে এক্সচেঞ্জও করতে পারেন। সেটাও কিন্তু রিইউজ়!
সব শেষে আছে রিসাইক্ল। বিদেশের মতো যেখানে সেখানে হয়তো রিসাইক্লিং পয়েন্ট পাবেন না এখনই। সে ক্ষেত্রে যেখান থেকে কিনেছেন, তাদের শোরুমে গিয়ে একটু খোঁজ নিন কী ভাবে আপনার গ্যাজেটটিকে রিসাইক্ল-এ দিতে পারবেন। ছ’কোটি ষাট লক্ষ যাদের জনসংখ্যা, সেই ব্রিটেনের বাড়িগুলোতে প্রায় চার কোটি অব্যবহৃত গ্যাজেটস রয়েছে। তা হলেই ভাবুন, ১৩৩ কোটি ভারতবাসীর বাড়ি থেকে কত গ্যাজেট উদ্ধার হওয়া বাকি!
লুপ্তপ্রায় মৌলেরা সমস্বরে একদিন ‘হারিয়ে গেছি আমি’ বলার আগে মানবজাতিকেই সচেতন উদ্যোগ নিতে হবে। আপনি বছরে দু’বার ফোন, দু’বছরে একবার ল্যাপটপ বদলে ফেলেন, আপনার বাবা পেসমেকার বুকে নিয়ে দিব্যি আরামে থাকেন। সেই আপনিই যদি এক দিন দেখেন বাজারে আর সেই সব পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ সব প্রয়োজনীয় মৌল নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে, সে দিন কিন্তু সভ্যতারই সঙ্কট। পর্যায়সারণি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বাস্তব। সেটি যেন আগামীতে নিছক ইতিহাসে পরিণত না হয়, চলুন আজ সবাই মেন্ডেলিভের কাছে সেই প্রতিজ্ঞাই রাখি।