চিলির সেই আটাকামা মরুভূমি। যেখানে মিলেছে রহস্যে মোড়া রাশি রাশি কাচের টুকরো -ফাইল ছবি।
মরুভূমির মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে পুরু বালির স্তরের উপর ছোট, বড়, মাঝারি আকারের রাশি রাশি কাচের টুকরো এল কোথা থেকে? কারা নিয়ে এল? এত রাশি রাশি কাচ তৈরি হল কী ভাবে ধূধূ মরুভূমিতে?
প্রায় এক দশকেরও বেশি সময়ের এই সব কৌতূহলের কিছুটা অবসান ঘটালেন এ বার বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় জানা গেল, মরুভূমির মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই রাশি রাশি কাচে রয়েছে এমন সব পদার্থ, যা পৃথিবীর বাইরে কোন ভিন্ মুলুক থেকে আসা। এই কাচ পৃথিবীতে তৈরি হতে পারে না।
আমেরিকার রোড আইল্যান্ডে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘জিওলজি’-তে। ৩ নভেম্বর।
পৃথিবীর বাইরে ভিন্ মুলুক থেকে আসা রাশি রাশি কাচ ছড়িয়ে থাকার সেই রহস্যে মোড়া মুলুকটির নাম চিলির আটাকামা মরুভূমি। এক দশকেরও কিছু সময় আগে যে মরুভূমির ৭৫ কিলোমিটার (প্রায় ৫০ মাইল) এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রাশি রাশি কাচের টুকরোর প্রথম হদিশ মিলেছিল। আর সেই সময় থেকেই যাবতীয় কৌতূহলের সূত্রপাত। কোথা থেকে এল, কারা নিয়ে এল এই রাশি রাশি কাচের টুকরো। অদ্ভুত আকারের সেই কাচের টুকরোগুলি। বিভিন্ন আকারের। একটার সঙ্গে অন্যটার মিল নেই কোনও। মরুভূমির বিভিন্ন জায়গায় অনেকটা এলাকা জুড়ে সেগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যেন কাচের টুকরোর বিশাল আবর্জনা।
কোনওটা খুব ছোট, কোনওটা মাঝারি আকারের। কোনওটা আবার কাচের বড় বড় চাঙরও। দৈর্ঘ্যে ৫০ সেন্টিমিটার (বা, ২০ ইঞ্চি)। প্রায় দু’ফুট।
সেই কাচের টুকরো যাতে মিলেছে পৃথিবীর বাইরের ভিন্ মুলুকের পদার্থ। ছবি- ‘জিওলজি’ জার্নালের সৌজন্যে।
কাচের টুকরো থেকে মিলেছে পৃথিবীর বাইরের ভিন্ মুলুকের এই সব পদার্থ। ছবি- ‘জিওলজি’ জার্নালের সৌজন্যে।
‘‘সেই রাশি রাশি কাচের টুকরোগুলির কোনওটা খুব এবড়োখেবড়ো, কোনওটা আবার একেবারেই মসৃণ, আবার কোনও কোনও কাচের টুকরো দেখে মনে হতে পারে, সেগুলিকে কোনও ভাবে ভাঁজ করা হয়েছে বা দোমড়ানো মোচড়ানো হয়েছে। পেরেকের নীচের দিকটার মতো। আর সেগুলি হয়েছে অন্তত ১২ হাজার বছর আগের কোনও ঘটনায়’’, বলেছেন প্রধান গবেষক ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভূতত্ত্ববিদ পিটার শ্যুল্জ।
আগের গবেষণাগুলি জানিয়েছিল, ১২ হাজার বছর আগে হয়তো কোনও সুবিশাল উল্কাখণ্ড আছড়ে পড়েছিল আটাকামা মরুভূমির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। পৃথিবীতে ঢোকার সময় বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে জ্বলে উঠেছিল উল্কাখণ্ডটি। তখনই তার থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে থাকে অত্যন্ত উত্তপ্ত পাথরের রাশি রাশি টুকরো। সেগুলি এসে পড়ে মরুভূমির উপর। সেই তাপে গলে যায় মরুভূমির বালি ও মাটি। তার থেকেই সম্ভবত তৈরি হয়েছিল এই রাশি রাশি কাচ। কাচের টুকরো।
বিভিন্ন গবেষণা এর আগে আরও একটি কারণ দেখিয়েছিল। সেই সব গবেষণার বক্তব্য ছিল, পৃথিবী যখন ভয়ঙ্কর উষ্ণ ছিল কয়েক লক্ষ বা কয়েক কোটি বছর আগে তখনও তৈরি হতে পারে এই কাচ, ভূগর্ভের অত্যধিক তাপে।
এ বারের গবেষণায় অধ্যাপক শ্যুল্জ ও তাঁর সতীর্থরা মরুভূমির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়ানো কাচের টুকরোর ৩০০টি নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলিকে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নীচে রেখে পরীক্ষা করেন। সেই কাচ কোন কোন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি, তা জানার চেষ্টা করেন স্পেকট্রোস্কোপি পদ্ধতিতে।
মিলেছে পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা এই সব পদার্থও। ছবি- ‘জিওলজি’ জার্নালের সৌজন্যে।
ভূতত্ত্ববিদ শ্যুল্জ বলেছেন, ‘‘পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে এই প্রথম প্রমাণ মিলল এই কাচ পৃথিবীতে তৈরি হয়নি। তৈরি হতে পারে না। তা পৃথিবীর বাইরে কোনও ভিন্ মুলুক থেকেই এসেছিল আটাকামা মরুভূমিতে। আর সেগুলি নিয়ে এসেছিল কোনও সুবিশাল উল্কাখণ্ড। তাপ বিকিরণ আর বাতাসের জন্যই তৈরি হয়েছে এই রাশি রাশি কাচ আর তাদের বিভিন্ন আকার, আকৃতি। ওই কাচে মিলেছে জারকন্স-এর মতো পদার্থ। যা প্রচণ্ড তাপে রূপান্তরিত হয়ে গিয়ে হয়েছিল খনিজ পদার্থ ‘ব্যাডেলেইট’। যা হওয়ার জন্য ১ হাজার ৬৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। পৃথিবীতে কোনও দাবানল বা ভূপৃষ্ঠের কোনও প্রাকৃতিক ঘটনায় যে তাপমাত্রায় পৌঁছনো সম্ভব হয়নি এখনও।
আটাকামা মরুভূমির সংখ্য়া দিয়ে চিহ্নিত জায়গাগুলিতে এই সব পদার্থের হদিশ মিলেছে বেশি পরিমাণে। ছবি- ‘জিওলজি’ জার্নালের সৌজন্যে।
শুধু তাই নয়, এই রাশি রাশি কাচের টুকরোর রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে যে খুব মিহি খনিজের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে, সেগুলি পৃথিবীতে বিরলতম। বরং সেগুলি পাওয়া যা উল্কাখণ্ডেই। তার মধ্যে অন্যতম পদার্থটি হল ‘কিউবানাইট’। পৃথিবীতে এই পদার্থটি বিরলতম। নেই বললেই হয়। ২০০৪ সালে নাসার ‘স্টারডাস্ট’ মিশন ‘ধূমকেতু ওয়াইল্ড-২’ থেকে প্রথম এই পদার্থটির হদিশ পায়। এটি পৃথিবীর বাইরের ভিন্ মুলুকেরই পদার্থ।
তাই এই কাচের টুকরোগুলি পৃথিবীর বাইরে থেকেই এসেছিল আটাকামা মরুভূমিতে, এই ধারণায় পৌঁছলেন বিজ্ঞানীরা।