পথিকৃৎ: আমেরিকায় এক্স-রে নিয়ে গবেষণারত মেয়েরা
১৮৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অ্যানা বার্থা লুডভিগ যখন তাঁর বিয়ের আংটি-পরানো হাতের হাড়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘‘আই হ্যাভ সিন মাই ডেথ!’’— সেই বিস্ময় দিনকয়েকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল অসংখ্য সাধারণ মানুষের মধ্যেও। যা চোখেই দেখা যায় না, সে রকম জিনিসেরও ছবি তা হলে তোলা সম্ভব! আর এই সদ্য আবিষ্কৃত এক্স রশ্মিই ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী জায়গা করে দিল অ্যানার স্বামী উইলহেলম রয়েন্টগেনকে।
তড়িৎমোক্ষণ নলের সাহায্যে শক্তিশালী অদৃশ্য বিকিরণ তৈরি করে তা দিয়ে ছবি তোলার এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই বিশ্বের অনেক জায়গায় বিজ্ঞানীরা মেতে উঠলেন এই পরীক্ষা নিজেরাও করে দেখার উৎসাহে। আমেরিকাও পিছিয়ে ছিল না। রয়েন্টগেনের আবিষ্কারের তিন মাসের মধ্যে আমেরিকার একাধিক প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েক জন অধ্যাপক-গবেষক তৈরি করলেন এক্স রশ্মি। ম্যাসাচুসেটসের ওয়েলেসলি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগও এই দলে শামিল হল। তবে এই প্রতিষ্ঠানের কৃতিত্বে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেই হয়; কারণ এখানে যাঁরা কাজটা করলেন, সেই অধ্যাপক বা ছাত্রদের সকলেই ছিলেন মহিলা!
মেয়েরা পরীক্ষাগারে কাজ করছেন— এটা বললে আমাদের প্রথমেই মনে আসে মারি কুরির কথা। দু’বারের নোবেলজয়ী মারি কুরি সেই সময়কালের প্রতিনিধি, যখন বিজ্ঞানচর্চার দরজা সবে খুলতে শুরু করেছে মহিলাদের জন্য। ইউরোপ হোক বা আমেরিকা, উনিশ শতকের শেষ লগ্নে বেশ কিছু কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষালাভ আর বিজ্ঞান-গবেষণার সুযোগ দিতে শুরু করে মেয়েদেরও।
প্রথম দিকে মেয়েরা গবেষণা করতেন মূলত সহকারী হিসেবে, সে স্বামীর সঙ্গে হোক, বা পরিবারের অন্য কারও সঙ্গে। পরিবারের সাহায্য পেয়েছিলেন বলেই ফ্রান্সের ডরোথি রবার্টস বা আমেরিকার মারিয়া মিশেল কাজ করার সুযোগ পেলেন মহাকাশ-পর্যবেক্ষণের; রসায়ন পেল সোয়ালো রিচার্ডস বা র্যাচেল লয়েড-কে, জীববিদ্যা আর ভূতত্ত্বও মেয়েদের কাছে অগম্য রইল না। ইউরোপ-আমেরিকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আস্তে আস্তে মেয়েদের কাছে উন্মুক্ত হতে লাগল।
যদিও একেবারে প্রথম দিকে মেয়েরা বিজ্ঞান পড়তে এলেও তাঁদের মধ্যে অনেকেই কোর্স শেষ করে উঠতে পারতেন না অনেক রকম বাধাবিপত্তির জন্য। ওয়েলেসলি কলেজেই যেমন ১৮৭৫ সালে যে ২৪৬ জন ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে চার বছর পর মাত্র ১৮ জন গ্র্যাজুয়েট হন। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে এই কলেজে ১৮৭৬ সালে পড়াতে আসেন সারা ফ্রান্সিস হোয়াইটিং।
মাত্র আঠেরো বছর বয়সে বিএ পাশ করার পর একটা স্থানীয় স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক হলেন তিনি। বছরকয়েক বাদে সুযোগ পেলেন সদ্য তৈরি হওয়া ওয়েলেসলি কলেজে শিক্ষকতা করার। কলেজের কর্মকর্তাদের আনুকূল্যে সুযোগ মিলে যায় এমআইটি-তে বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ এডওয়ার্ড পিকারিং-এর ক্লাস করার। তিনিই প্রথম মহিলা, যাঁকে এই প্রতিষ্ঠান ক্লাস করার সুযোগ দেয়।
পিকারিং-এর পরীক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করতেন সারা হোয়াইটিং। মেয়েরা যেন গবেষণার সব কাজ হাতেকলমেই শেখে, চাইতেন তিনি। এই মানসিকতায় সমর্থন ছিল কলেজ-কর্তৃপক্ষেরও। তাঁদের আগ্রহেই শারীরবিদ্যার মতো বিভাগেও তৈরি হয় হাতেকলমে কাজ করার মতো পরীক্ষাগার। আমেরিকার দ্বিতীয় (আর মেয়েদের জন্য প্রথম) স্নাতক স্তরের ছাত্রীদের জন্য গবেষণাগারও, স্বাভাবিক ভাবেই গড়ে উঠল এই কলেজেই।
কলেজে মূলত জ্যোতির্বিদ্যা পড়াতেন সারা। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্রী জ্যোতির্বিদ অ্যানি জাম্প ক্যানন বহু বার এই শিক্ষিকার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। মারি কুরির মতো প্রচার পাননি হোয়াইটিং। তাঁর কোনও জীবনীও লেখা হয়নি। কিন্তু সহকর্মী বা ছাত্রীদের স্মৃতিচারণেই ফুটে ওঠে বিজ্ঞানচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ এই মহীয়সীর জীবনচিত্র।
১৮৯৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখে খবরের কাগজের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই কলেজের পরীক্ষাগারে সারা আর তাঁর সহকর্মী ম্যাবেল অগাস্টা চেজ় তৈরি করে ফেললেন এক্স রশ্মি, যার গুরুত্বের কথা শুরুতেই বলেছি। এই কলেজের অবজ়ারভেটরিটিও তাঁরই তৈরি। নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানশিক্ষায় কী ভাবে আরও আরও উৎসাহিত করে তোলা যায়, সে চেষ্টাই জীবনভর করে গিয়েছেন এই মানুষটি। লিখেছেন কলেজছাত্রদের পাঠ্য জ্যোতির্বিদ্যার বই, আর প্রচুর সাধারণবোধ্য নিবন্ধ।
সারা ফ্রান্সিসের সেই সময়কার এক্স রশ্মি নিয়ে পরীক্ষার মূল কাচের প্লেটগুলো পাওয়া যায় না। তবে সদ্য খুঁজে পাওয়া গেল সেই পরীক্ষার ফলাফলের ১৫টি মুদ্রিত ছবি যা সাড়া জাগিয়েছে বিজ্ঞান-ইতিহাসবিদদের কাছে। এক্স রশ্মি নিয়ে উন্মাদনা শুরু হওয়ার একেবারে আদিযুগে মেয়েদের হাতে কী ভাবে এই রশ্মিজাত ছবি ফুটে উঠেছিল ফটোগ্রাফিক ফিল্মের গায়ে, তার ছবি নতুন করে দেখতে পাওয়া আনন্দের, অবশ্যই।