চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্রের এই গবেষণাগার থেকেই তেজস্ক্রিয় বর্জ্য চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ। -ফাইল ছবি।
চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে!
‘রাজকোষ’ বলতে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র। তাই এ যে সে ‘চুরি’ নয়। ফলে, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইউরোপে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, রুশ আগ্রাসনের অব্যবহিত পরেই প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ চুরি হয়ে গিয়েছে রাজধানী কিভের অদূরে ইউক্রেনের চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে। প্রচলিত বিস্ফোরকের সঙ্গে মিশিয়ে যা দিয়ে অনায়াসেই বানিয়ে ফেলা যায় ‘ডার্টি বম্ব’।
রুশ সেনারা বৃহস্পতিবার চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্র ও তার লাগোয়া এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে এলেও বিজ্ঞানীদের একাংশের আশঙ্কা, রাশিয়া এ বার সেই ডার্টি বম্ব ব্যবহার করতে পারে ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকদের উপর। যুদ্ধে জেতার মরিয়া চেষ্টায়। ইউক্রেনে ঢোকার পরের দিনই চেরনোবিলের দখল নেয় রুশ সেনারা।
কিভে ‘ইনস্টিটিউট ফর সেফ্টি প্রবলেমস অব নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টস (আইএসপিএনপিপি)’-এর অধিকর্তা আনাতোলি নোসোভস্কি এই খবর দিয়েছেন। জানিয়েছেন, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পরপরই লুটেরারা চেরনোবিলের পরমাণু চুল্লিগুলির আশপাশের একটি গবেষণাগারে থাকা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিয়ে উধাও হয়েছে। যার পরিমাণ খুব কম নয়। লুটেরারা ওই গবেষণাগার থেকে কয়েকটি তেজস্ক্রিয় মৌলের আইসোটোপ (কোনও মৌলের পরমাণুর কেন্দ্রে নিউট্রনের সংখ্যার তারতম্যের কারণে সেই মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপ তৈরি হয়। কার্বন পরমাণুর যেমন তিনটি আইসোটোপ রয়েছে, ১২, ১৩ এবং ১৪ নিউট্রন সংখ্যার)। চেরনোবিল ও তার আশপাশের কয়েক হাজার কিলোমিটার এলাকায় বিকিরণের বাড়া-কমার মাত্রা নির্দিষ্ট সময় অন্তর মাপা হয় ওই সব তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে।
তিনি অবশ্য এও জানিয়েছেন, চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্রের ওই গবেষণাগার থেকে কতটা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ও নানা ধরনের তেজস্ক্রিয় মৌলের আইসোটোপ চুরি হয়েছে রুশ আগ্রাসনের পর তার সঠিক পরিমাণ জানা সম্ভব হয়নি এলাকাটি রুশ সেনাদের দখলে থাকায়। তবে চুরি যে হয়েছে, তা জানা গিয়েছে ওই গবেষণাগারে থাকা বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্ম ও কম্পিউটার সিগন্যালের সূত্রে।
ব্রিটেনের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু বিজ্ঞানী ব্রুনো মার্ক যদিও বলেছেন, ‘‘এই সব তেজস্ক্রিয় বর্জ্য দিয়ে কোনও পরমাণু বোমা বানানো যাবে না। কারণ, এই বর্জ্যগুলির মধ্যে কোনও প্লুটোনিয়াম বা ইউরেনিয়াম নেই। পরমাণু বোমা বানানোর জন্য এই দু’টি তেজস্ক্রিয় মৌলই প্রধান উপাদান। তবে সে সব দিয়ে ডার্টি বম্ব বানানো যেতেই পারে।’’
সেই ডার্টি বম্বগুলি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে আমজনতার ক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তা নির্ভর করছে সেগুলি কী পরিমাণে খোওয়া গিয়েছে আর তা কী পরিমাণে ডার্টি বম্ব বানাতে ব্যবহৃত হতে পারে তার উপর।
পরমাণু বিজ্ঞানী এডউইন লিম্যান বলেছেন, ‘‘যে তেজস্ক্রিয় মৌলগুলির আইসোটোপ চুরি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে সেগুলির তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সেগুলির তেজস্ক্রিয়তা খুব বেশি হলে সেগুলিকে চুরি করার সময়েও খুব শক্তপোক্ত আবরণীর মধ্যে রাখার প্রয়োজন হত। যা লুটেরাদের প্রয়োজন হয়নি বলেই এখনও পর্যন্ত মনে হচ্ছে।’’
তেজস্ক্রিয় বর্জ্যে মরে গিয়ে শুকনো কাঠ হয়ে গিয়েছে চেরনোবিলের আশপাশের গাছপালা। -ফাইল ছবি।
তবে সেগুলি দিয়ে ডার্টি বম্ব বানানো যেতেই পারে। যার আর এক নাম— ‘রেডিয়োলজিক্যাল ডিসপার্সাল ডিভাইস' (আরডিডি)। আমেরিকার নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি কমিশন যদিও জানিয়েছে ওই ডার্টি বম্বগুলি এমন পর্যায়ের বিকিরণ ছড়াতে পারবে না, যা মানুষ মারবে বা তাঁদের সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দেবে। সেই বিকিরণের খুব বেশি দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা কম।
১৯৮৬ সালে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে চেরনোবিলের দু’টি পরমাণু চুল্লি উড়ে যাওয়ার পর থেকেই ওই কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে সেই চুল্লি দু’টির লাগোয়া বিস্তীর্ণ এলাকা আগামী ২১ হাজার বছর মানুষ বা কোনও প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য থাকবে বলে আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন পরমাণু বিজ্ঞানীরা।