মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমে কলোরাডো নদীর গিরিখাত জুড়ে নাভাজো জনজাতির বাস। তাঁদের সঙ্গে গল্প করতে বসলে দুই ধরনের হলুদ ধুলোর কথা উঠে আসবেই। একটা ঈশ্বরের দান, পৃথিবীতে সমস্ত জীবনের প্রতীকই সেই ধুলো— হলুদ পরাগ রেণু। এই হলুদ ধুলো না থাকলে পৃথিবী ফুলে-ফলে ভরে উঠত না। আর এক রকম হলুদ ধুলো হল মানুষের ধ্বংসের কারণ, ইউরেনিয়াম। নাভাজোদের বর্তমান প্রজন্ম আজ বিপন্ন ইউরেনিয়াম দূষণের কারণেই।
১৭৮৯ সালে পিচব্লেন্ড থেকে এক নতুন ধাতু আবিষ্কার করেন হেনরিখ ক্ল্যাপরথ। ধাতুটি ক্ষণস্থায়ী, তেজস্ক্রিয়, পারমাণবিক সংখ্যা বা অ্যাটমিক নম্বর ৯২। ইউরেনাস গ্রহের নামানুসারে তিনি এই ধাতুর নাম রাখেন ইউরেনিয়াম। ক্ল্যাপরথ অবশ্য জানতেন না তাঁর এই আবিষ্কারের অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই শুরু হবে পারমাণবিক যুগ। বিশ্ব সাক্ষী থাকবে হিরোশিমা-নাগাসাকি বিপর্যয়ের।
খনিতে তিন ধরনের খনিজ ধাতু ও পাথরমিশ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায় ইউরেনিয়াম আকরিক। এক টন ইউরেনিয়ামের জন্য ১,০০০ টন আকরিক খনন করে বের করতে হয়। এর পরে রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরি হয় ইউরেনিয়াম অক্সাইড, যার মাত্র ০.৭১১ শতাংশ ইউরেনিয়াম-২৩৫, যা নিউক্লিয়ার ফিশন-এ কাজে লাগে। বাকিটা অব্যবহারযোগ্য ইউরেনিয়াম-২৩৮। ব্যবহারযোগ্য ইউরেনিয়ামকে জমা করা হয় হলুদ কেক হিসেবে। এরও ৭৫ শতাংশ কাজে লাগে পরমাণু চুল্লিতে। এই হলুদ কেকই নাভাজোদের হলুদ ধুলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যানহাটন প্রজেক্ট-এর হাত ধরে পরমাণু বোমা তৈরির সময় থেকেই ইউরেনিয়াম খনন পৃথিবীর অন্যতম লাভজনক ব্যবসা। ম্যানহাটন প্রজেক্ট জন্ম দিয়েছিল পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে রোম্যান্টিক কিছু কাহিনির। কিন্তু চাপা পড়ে গিয়েছে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা উপনিবেশ বিস্তার ও জনজাতি ধ্বংসের নির্মম ইতিহাস।
১৯১৫ সালে বেলজিয়ামের শাসনাধীন কঙ্গোর শিঙ্কোলোবুই প্রদেশে ইউরেনিয়ামের অস্তিত্বের সন্ধান দেন ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ রবার্ট রিচ শার্প। এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে ইউরেনিয়াম পাচার হয় মার্কিন মুলুকে। সুসান উইলিয়ামস তাঁর ‘স্পাইসেস ইন দ্য কঙ্গো’ বইয়ে ইউরেনিয়াম খনির কার্যকলাপের খুঁটিনাটি তুলে ধরেন। বিভিন্ন পথ ঘুরে, সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পাচার করা হত ইউরেনিয়াম। সেই কাজে লাগানো হত শিঙ্কোলোবুই গ্রামের মানুষকেই। এই অঞ্চলের মানুষ আজও শরীরে বহন করে চলেছে ইউরেনিয়ামের বিষ। হলুদ ধুলো তাঁদের ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে। কঙ্গোর মতোই ম্যানহাটন প্রজেক্টে ইউরেনিয়াম সরবরাহ করেছিল কানাডার গ্রেট বেয়ার লেক সংলগ্ন খনি। ১৯৩০ সালে সেখানে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া যায়।
শুধুমাত্র নাভাজো, শিঙ্কোলোবুই বা কানাডার গ্রেট বেয়ার লেক অঞ্চলে নয়, গোটা বিশ্বেই ইউরেনিয়াম দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন জনজাতিরা। খনি তৈরির জন্য তাঁদের বাসভূমি হারাতে হয়। তার উপর রয়েছে তেজস্ক্রিয়তা। ইউরেনিয়াম আকরিকের অব্যবহারযোগ্য ইউরেনিয়াম-২৩৮ খনি-সংলগ্ন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। ভারী ইউরেনিয়াম-২৩৮ ভেঙে তৈরি করে বোরন, থোরিয়াম, রেডিয়াম, পোলোনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় ধাতু। এগুলি কোষের ডিএনএ-র গঠনকে প্রভাবিত করে তৈরি করে ক্ষতিকর মিউটেশন। ফলে দেখা দেয় ক্যানসার-সহ একাধিক মারণরোগ। এই মিউটেশন বহন করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ইউরেনিয়াম-২৩৮ ভাঙার সর্বশেষ ধাপে তৈরি হয় বিষাক্ত সীসা, লেড-২০৬। এই ধাতু বিষিয়ে দেয় সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ।
অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন জনজাতিদের গানের লাইন ও প্রচলিত গল্পগুলোয় বারে বারে উল্লেখ রয়েছে পূর্বপুরুষের সাবধানবাণী— পৃথিবীর বুকের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে বিষ। সেই বিষকে সেখানেই থাকতে দিতে হয়। এই সাবধানবাণীরই প্রচারে ১৬ জুলাই এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের মঞ্চে বিশ্বের প্রথম ইউরেনিয়াম অ্যাটলাস প্রকাশ করল জার্মানির রোজা লুমেক্সবার্গ ইনস্টিটিউট।
এই বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে গোটা বিশ্বের ইউরেনিয়াম খননের ম্যাপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত কোন দেশ কত পরিমাণ ইউরেনিয়াম খনন করেছে, কোন কোন খনিতে এখনও কাজ চলছে এবং কোন খনি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, রয়েছে তারও সম্পূর্ণ খতিয়ান। তবে এই ওয়েবিনার ও বই প্রকাশের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র তথ্যপ্রদান নয়, বরং ইউরেনিয়াম খননের ফলে যাঁরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের কথা তুলে ধরা।
বইপ্রকাশের তারিখটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ট্রিনিটি টেস্ট-এর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র। এই ইতিহাস সবার জানা। যে ঘটনা তেমন চর্চিত নয়, তা হল ১৯৭৯ সালে চার্চ রক ইউরেনিয়াম মিল-এর ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। মারা গিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের বেশির ভাগই নাভাজো জনজাতির মানুষ। এই ঘটনায় দূষিত হয়ে যায় নাভাজোদের নদী-সহ সমস্ত জলাধার। ফল, প্রজন্মের পর প্রজন্ম মারণরোগ বহন। চার্চ রক ইউরেনিয়াম মিলের দুর্ঘটনার দিনটাও ছিল ১৬ জুলাই। তাই তেজস্ক্রিয়তা ও জনজাতির বিপন্নতাকে ইতিহাসের সামনের সারিতে জায়গা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ১৬ জুলাই বই প্রকাশ।
ইউরেনিয়াম অ্যাটলাসে বিশেষ ভাবে জায়গা পেয়েছে এশিয়া। রয়েছে কোল্ড ওয়রের সময় কী ভাবে রাশিয়ার উত্তরভাগে ও কাজাখস্তানে শুরু হয় ইউরেনিয়াম সন্ধানের কাহিনি। সঙ্গে ভারতের যদুগুড়া, ভাতিন, নরপাহাড়, মহুলডিহির কেস স্টাডিও উল্লেখ করা রয়েছে।
সত্তরের দশকের শুরু থেকেই বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার ও সেই সঙ্গে ইউরেনিয়াম দূষণের বিরুদ্ধে একাধিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। তৈরি হয় ফ্রেন্ডস অব আর্থ ইন্টারন্যাশনাল-সহ একাধিক সংস্থা। বর্তমানে এই আন্দোলন জারি রেখেছে নিউক্লিয়ার ফ্রি ফিউচার ফাউন্ডেশন, বেয়ন্ড নিউক্লিয়ার এবং ইন্টারন্যাশনাল ফিজ়িশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশনস অব নিউক্লিয়ার ওয়র-এর মতো সংস্থাগুলো।
কিন্তু, এর পরেও গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে কাজ চলছে শতাধিক পারমাণবিক চুল্লিতে। আর এই চুল্লিগুলোয় ইউরেনিয়াম আকরিকের জোগান দিয়ে চলেছে খনিগুলো। হলুদ ধুলোয় বিষিয়ে যাচ্ছে মাটি, বন, জল। বিষিয়ে যাচ্ছে জীবন।