নোবেল পুরস্কারজয়ী জেমস পিবল্স। -ফাইল ছবি।
খবরটা পাওয়া ইস্তক ডুবে গেলাম স্মৃতিতে। আট বছর আগের ঘটনা। গোয়ার পানজিম শহরে পদার্থবিদ্যার আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন গ্র্যাভিটেশন অ্যান্ড কসমোলজি (আইসিজিসি ২০১১)। ডিসেম্বরের ১৪ থেকে ১৯। উদ্যোক্তা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর জেনারেল রিলেটিভিটি অ্যান্ড গ্র্যাভিটেশন। বিদেশ থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন অনেকে। রবার্ট কার্শনার, কিপ থর্ন, অভয় আস্থেকর, প্রিয়ম্বদা নটরাজন। এবং অবশ্যই ফিলিপ জেমস এডুইন পিবল্স। বিশ্বতত্ত্বের ‘গ্র্যান্ড ড্যাডি’। আমেরিকায় প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আলবার্ট আইনস্টাইন প্রফেসর। সেই পিবল্স এ বার পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ় পেলেন।
কলকাতা থেকে আইসিজিসি ২০১১ কভার করতে গিয়েছিলাম পানজিম। ঘটনাচক্রে ঠাঁই পেয়েছিলাম একই হোটেলে। হাথিমহল। কনফারেন্স ‘হলিডে ইন’ হোটেলে। রোজ সকালে উদ্যোক্তাদের তরফে গাড়ি এসে দাঁড়াত আমাদের হোটেলের সামনে। কয়েক জনের সঙ্গে গাড়িতে উঠতেন পিবল্স। প্রথম আড়ষ্টতা কাটিয়ে তৃতীয় দিনে বসে পড়লাম ওঁর পাশের ফাঁকা সিটে। কথাবার্তা এগোলো। বিজ্ঞান সাংবাদিকতা করি শুনে তিনি কৌতূহলী হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ভারতে এ ধরনের সাংবাদিকতার সুযোগ কতটা? অথবা পাঠক মহলে এর প্রতিক্রিয়াই বা কত দূর? সে দিন তো বটেই, যে কয়েক দিন সম্মেলন চলল, সে ক’দিন বাসে যেতে যেতে ওঁর সঙ্গে কথা হল অনেক।
আগেই বলেছি, বিশ্বতত্ত্ব চর্চার প্রায় ‘ঠাকুরদা’ তিনি। বিশেষত, ওই বছরই পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ় পেয়েছেন এমন তিন বিজ্ঞানী, যাঁরা ওঁর আইডিয়াকেই সত্যি বলে প্রমাণ করেছেন। সাংবাদিক হিসেবে ওঁকে ঘিরে আমার কৌতূহল তাই অনেক। আমার বহু প্রশ্নের জবাব দিলেন যেন শিক্ষকের ভঙ্গিতে। জটিল বিষয়ে আমি কতটা বুঝতে পারছি, তা খেয়াল রেখে। আমার বিদ্যে যে সীমিত, তা মাথায় রেখে।
১৯ ডিসেম্বর, ২০১১। আইসিজিসি ২০১১ শেষ। আমার কলকাতা ফেরার উড়ান ধরতে হবে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে আছি। গাড়ির অপেক্ষায়। দেখলাম পিবল্সও হোটেলে চেক আউট করছেন। আমার গাড়ি এসে গেল, ওঁর এল না। উদ্যোক্তাদের তরফে হোটেলে ওঁকে জানানো হয়েছে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওঁর গাড়ি এসে পড়বে। কিন্তু-কিন্তু করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যাবেন আমার গাড়িতে? দেখলাম ওঁর মোবাইল ফোন নেই। হোটেলের লবির ফোন ব্যবহার করে উদ্যোক্তাদের কাউকে বললেন, ‘‘আমার গাড়ি পাঠানোর দরকার নেই। আমি কলকাতা থেকে আসা সাংবাদিকের গাড়িতেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাচ্ছি।’’ ওঁর সম্মানার্থে উদ্বিগ্ন উদ্যোক্তাদের কেউ ফোনের ও-পার থেকে বোধহয় নিরস্ত করতে যাচ্ছিলেন ওঁকে। শুনলাম, টেলিফোনের এ পারে শান্ত অথচ দৃঢ় মন্তব্য, ‘‘কী হবে বাড়তি একটা গাড়ির তেল পুড়িয়ে?’’
প্রায় ঘণ্টাখানেকের পথ পানাজি বিমানবন্দর। বিশ্বতত্ত্বের ঠাকুরদাকে আবার একা পেয়ে আমার হাজার প্রশ্ন। এবং উত্তর পেলাম একই ভঙ্গিতে। সেই পিবল্স নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন খবর পেয়ে মনে পড়ে গেল পানজিমে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কয়েকটা দিন। এবং ভবিষ্যতের নোবেল বিজেতার সঙ্গে এক ঘণ্টার সেই কার রাইড। পাশাপাশি সিটে সাবলাইম এবং রিডিকুলাস!
এ বারে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারের ৯ লক্ষ ১৮ হাজার ডলারের অর্ধেকটা পেলেন পিবল্স। বাকি অর্ধেকটা জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল মেয়া এবং দিদিয়ে কেলজ়। নোবেল কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী, পিবল্সকে পুরস্কার ‘ভৌত বিশ্বতত্ত্বে তাত্ত্বিক আবিষ্কারের জন্য।’ আর মেয়া এবং কেলজ় পুরস্কৃত হলেন ‘সূর্যের মতো একটা নক্ষত্র-আবর্তনকারী এক গ্রহ আবিষ্কারের সূত্রে।’ তিন বিজ্ঞানীকে পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটির ঘোষণা, ওঁরা মানবজাতিকে বুঝিয়েছেন ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তন এবং প্রকাণ্ড বিশ্বে পৃথিবী গ্রহের অবস্থান।
আসলে, ওঁরা বোধহয় দিয়েছেন সেই অমোঘ প্রশ্নের উত্তর, যা মাথায় আসে এক শিশু অথবা এক মাতালের। আমি এলাম কোথা থেকে?
প্রকাণ্ড এই বিশ্ব। আদিগন্ত বিস্তৃত নক্ষত্রপুঞ্জ, নক্ষত্র, গ্রহ। এর মাঝে দাঁড়িয়ে মানুষ চিরকাল বিহ্বল, হতচকিত। এক সাধারণ নক্ষত্রপুঞ্জের তুচ্ছ এক নক্ষত্র-আবর্তনকারী এক অকিঞ্চিৎকর গ্রহের প্রাণী বিস্মিত। জিজ্ঞাসায় সে অতুলনীয়। এত সব এল কোথা থেকে?
মাত্র ১০০ বছর আগেও বিশেষজ্ঞ যাঁরা, সেই বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম বলে কিছু নেই, সে ছিল আবহমানকাল ধরেই। এমনকি যে আইনস্টাইন, যাঁর গবেষণা এক দিন পাল্টে দেবে ওই ধারণা, তিনিও বিশ্বাস করতেন ব্রহ্মাণ্ড অজর-অমর। তার কোনও জন্ম নেই। এমনই দৃঢ় তাঁর বিশ্বাস যে, জেনারেল রিলেটিভিটি (যা পাল্টে দিল পুরনো বিশ্বাস, বলে দিল ব্রহ্মাণ্ড পরিবর্তনশীল) আবিষ্কার করার পরেও তিনি নিজের আবিষ্কৃত ফর্মুলার মধ্যে গুঁজে দিলেন একটা জিনিস। যাতে কাগজে-কলমে ব্রহ্মাণ্ড থাকে অপরিবর্তনীয়। ১৯২০-র দশকে পাল্টাল সেই বিশ্বাস। দেখা গেল, নক্ষত্রপুঞ্জগুলো একটা আর একটার থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। তা হলে তো ব্রহ্মাণ্ড আর স্থির নয়। তা বদলে যাচ্ছে দিনকে দিন। গত কালের বিশ্ব আজকের থেকে আলাদা ছিল। আগামী কালের ব্রহ্মাণ্ড আলাদা হবে আজকের থেকে। ১৯২০-র দশকের শেষে আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন তার আবিষ্কৃত ফর্মুলায় বিশেষ জিনিসটা গুঁজে দিয়ে তিনি ভুল করেছিলেন। নিজে বললেন, ওটা ছিল তাঁর জীবনের ‘গ্রেটেস্ট ব্লান্ডার’।
বিশ্ব পরিবর্তনশীল। ১৯৬৪ সালে দুই মার্কিন বিজ্ঞানী আর্নো পেঞ্জিয়াস এবং রবার্ট উইলসন প্রমাণ করলেন এক দিন এক মাহেন্দ্র ক্ষণে জন্মেছিল এই ব্রহ্মাণ্ড। এক মহাবিস্ফোরণে (বিগ ব্যাং)। প্রমাণ? হ্যাঁ, তা পেলেন ওঁরা। ১৩৮০ কোটি বছর আগে সেই বিস্ফোরণের এখন-পড়ে-থাকা আঁচ আবিষ্কার করে। কৃতিত্বের জন্য ১৯৭৮ সালে ওঁদের দেওয়া হয়েছে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার।
কৃতিত্ব বড় বটে। এই প্রথম বড়সড় ভাবে বিশ্বতত্ত্ব হয়ে দাঁড়াল মাপজোকের ব্যাপার। আর তা তত্ত্বকথা নয়। যদি পেঞ্জিয়াস আর উইলসন পরীক্ষা করে সেই পরিবর্তন আনেন, তবে তার তাত্ত্বিক ভিত্তি কার অবদান? প্রশ্নের অব্যর্থ উত্তর— পিবল্স। হ্যাঁ, যাঁরা বলেছিলেন একদা সেই বিশ্বের জন্মকালীন মহাবিস্ফোরণের আঁচ এখনও খুঁজলে মিলবে, তাঁদের অন্যতম ওই পিবল্স।
নোবেলের খবরে তাই ৮৬ বছর বয়সি পিবল্স বিস্মিত নন মোটেই। সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম ৫৫ বছর আগে। সে-দিনের সতীর্থদের মধ্যে আমিই কেবল টিকে আছি একা।’’
ব্রহ্মাণ্ড রহস্য কি শেষ? মোটেই না। তা যেন ক্রমবর্ধমান। সর্বশেষ খবর, দৃশ্যমান বস্তুর (গ্রহ-নক্ষত্র কিংবা নক্ষত্রপুঞ্জ) বাইরেও আছে অজানা বস্তু। ডার্ক ম্যাটার। চেনা এনার্জির বাইরেও আছে অচেনা এনার্জি। ডার্ক এনার্জি। ব্রহ্মাণ্ডের কতটুকু জেনেছি আমরা? মাত্র ৫ শতাংশ। বিশ্বের ২৬ শতাংশ হল ডার্ক ম্যাটার, ৬৯ শতাংশ ডার্ক এনার্জি। ডার্ক ম্যাটার বস্তুকে আকর্ষণ করছে, ওদিকে ডার্ক এনার্জি নক্ষত্রপুঞ্জদের একে অন্যের থেকে প্রবল বেগে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
১৯৯৮ সালে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব। প্রমাণ দাখিলের তিন কারিগর সল পার্লমাটার, ব্রায়ান স্মিট এবং অ্যাডাম রাইস ২০১১ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। মজার ব্যাপার, আইনস্টাইনের জীবনের ‘সেরা ভুল’ই (ফর্মুলায় তাঁর গুঁজে দেওয়া সেই জিনিসটি) নাকি ডার্ক এনার্জি। ১৯৮০-র দশকে এটা যাঁরা দাবি করেন, তাঁদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন সেই পিবল্স। ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ায় ২০১১ সালের গোয়া সম্মেলনে সেই কারণেই লাইমলাইটে ছিলেন তিনি। এমন বিজ্ঞানীকে নোবেল প্রাইজ় বোধহয় একটু দেরিতেই দেওয়া হল।
এ বারে নোবেল পুরস্কারের দ্বিতীয় প্রাপক মেয়া আর তাঁর একদা ছাত্র কেলজ়। ১৯৯৫ সালে ওঁরা দু’জন খুঁজে পেয়েছিলেন ৫১ পেগাসি নামে সূর্যসম একটা নক্ষত্র-আবর্তনকারী একটা গ্রহ। বলা যায়, পৃথিবীর মতো গ্রহ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ওঁরা হলেন পথিকৃৎ। ওঁদের আবিষ্কৃত পদ্ধতি মেনে এখন সৌরজগতের বাইরে খোঁজা হয় পৃথিবীর মতো গ্রহ। যাঁদের সংখ্যা, বিজ্ঞানীদের মতে, এখন পর্যন্ত চার হাজারেরও বেশি।
বিজ্ঞান আসলে এক প্রতিযোগিতা। কম্পিটিশনে মেয়া এবং কেলজ়ের সঙ্গে যিনি ছিলেন, তিনি হলেন বার্কলিতে ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওফ্রে মার্সি। তিনিও অজানা গ্রহ খুঁজে পেয়েছিলেন। অথচ প্রাইজ় থেকে বঞ্চিত। কেন? অনেকের ধারণা, চার বছর আগে যৌন হেনস্থার অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাঁর বিরুদ্ধে। হয়তো তাই বিজ্ঞানের জগতে সেরা শিরোপা পেলেন না মার্সি।