থোয়েইট্স হিমবাহের সেই ভয়াবহ ফাটল। ছবি সৌজন্যে: নাসার ‘আইসব্রিজ’ রাডার।
যতটা জায়গা জুড়ে আমাদের কলকাতা জেলা, তার তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ এলাকা জুড়ে সুবিশাল ফাটলের হদিশ মিলল আন্টার্কটিকার দৈত্যাকার একটি হিমবাহ বা গ্লেসিয়ারে। ফাটলটির গভীরতা এক হাজার ফুটেরও বেশি। ভূগর্ভের এতটা কাছাকাছি আন্টার্কটিকার কোনও বিশাল হিমবাহে এর আগে এত বড় ফাটলের খোঁজ মেলেনি। পশ্চিমবঙ্গ যতটা জায়গা জুড়ে রয়েছে, হিমবাহটি রয়েছে তার দ্বিগুণেরও বেশি এলাকায়।
দৈত্যাকার হিমবাহে সেই ফাটলটা ভূগর্ভের এতটা কাছাকাছি যে, বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ, লাগোয়া মহাসাগরের জল তার ভিতর দিয়ে ঢুকে খুব দ্রুত গলিয়ে দিতে পারে গোটা গ্লেসিয়ারটাকেই। ওই হিমবাহে যতটা বরফ রয়েছে, তা যদি পুরোপুরি গলে যায়, তা হলে সাগর, মহাসাগরের জলস্তর উঠে আসবে অন্তত ২ ফুট বা ৬৫ সেন্টিমিটার।
কী ভাবে মিলল সেই ফাটলের হদিশ?
পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা নাসার ‘আইসব্রিজ’ উপগ্রহে বসানো রাডারের পাঠানো ছবিতেই আন্টার্কটিকার হিমবাহের অত গভীরে ফাটলটি ধরা পড়েছে। একই ছবি পাঠিয়েছে কক্ষপথে থাকা ইতালি ও জার্মানির উপগ্রহের রাডারও। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এ। ২৯ জানুয়ারি। যার শিরোনাম- ‘হেটরোজিনাস রিট্রিট অ্যান্ড আইস মেল্ট অফ থোয়েইট্স গ্লেসিয়ার, ওয়েস্ট আন্টার্কটিকা’। দুই মূল গবেষক নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী পিয়েত্রো মিলিল্লো ও আরভিনের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এরিক রিগনটের সঙ্গে ওই আন্তর্জাতিক গবেষকদলে রয়েছেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
পশ্চিম আন্টার্কটিকার যেখানে রয়েছে থোয়েইট্স গ্লেসিয়ার
উদ্বেগে বিজ্ঞানীরা
আনন্দবাজার ডিজিটালের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে সুমন ই-মেলে বলেছেন, ‘‘উষ্ণায়নের জন্য দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কত তাড়াতাড়ি সমুদ্রের জলস্তর কতটা উপরে উঠে আসতে পারে, তা সঠিক ভাবে মাপতে পশ্চিম আন্টার্কটিকার ওই দৈত্যাকার হিমবাহ থোয়েইট্স গ্লেসিয়ারের উপর এখন আমাদের কড়া নজর রাখতে হবে।’’
কতটা গলেছে সেই থোয়েইট্স হিমবাহ?
সুমন ও মূল গবেষক এরিক রিগনট বলেছেন, ‘‘ফাটলটির গভীরতা ১ হাজার ফুটের কিছু বেশি বা সওয়া ৩০০ মিটারের মতো। শুধু তাই নয়, হিমবাহ না গললে ভূগর্ভের (বেডরক) গায়ে হিমবাহটির নীচের দিকটার লেগে থাকার কথা। কিন্তু উষ্ণায়নের জন্য আন্টার্কটিকার জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় আমরা ভেবেছিলাম, ভূগর্ভের উপরের দিকটা আর হিমবাহটির নীচের দিকটার মধ্যে একটু ফাঁক থাকবে। আমরা অবাক হয়ে গিয়েছি, ‘আইসব্রিজ’-এর রাডারে ধরা পড়া ছবি দেখে। ভাবতে পারিনি, ফাটলটা এতটা বড় আর এতটা গভীর হবে। আমরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন, কারণ ‘আইসব্রিজ’-এর রাডার জানিয়েছে্, খুব দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে ওই দৈত্যাকার হিমবাহ- থোয়েইট্স গ্লেসিয়ার। গত তিন বছরে যার ১৪০০ কোটি টন বরফ পুরোপুরি গলে গিয়েছে।’’
যে ভাবে গলছে থোয়েই্ট্স হিমবাহ, দেখুন ভিডিয়ো
ওই ফাটলই গলিয়ে দিতে পারে আন্টার্কটিকার আরও হিমবাহ!
পুণের ন্যাশনাল সেন্টার ফর আন্টার্কটিক অ্যান্ড ওশ্ন রিসার্চ (এনসিএওআর)-এর অধিকর্তা, বিশ্বের অন্যতম বিশিষ্ট আন্টার্কটিকা ও হিমবাহ বিশেষজ্ঞ এম রবিচন্দ্রনের কথায়, ‘‘আন্টার্কটিকার মতো জায়গায় কোনও সুবিশাল হিমবাহের নীচে অত বড় ফাটল অবশ্যই অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ, সেই ফাটলই হিমবাহটিকে দ্রুত গলিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। বরফ গলে যাওয়ার ফলে ওই ফাটলের জন্ম হয়েছে। আর সেটি রয়েছে ভূগর্ভের খুব কাছাকাছি। ফলে, প্রচুর তাপশক্তির জন্ম হবে ফাটলটির মধ্যে। তা হিমবাহটির নীচের দিকের অন্যান্য স্তরগুলিকেও দ্রুত গলিয়ে দিতে শুরু করবে। আর সেই ফাটল দিয়েই হু হু করে ঢুকবে লাগোয়া মহাসাগরের জল। সেটাও হিমবাহটিকে আরও দ্রুত গলিয়ে দেবে।’’
এই ভাবে গলে যাচ্ছে থোয়েইট্স হিমবাহ
এমন আরও দু’-তিনটি হিমবাহ গললে সমুদ্র ফুঁসে উঠবে ৮ ফুট!
পশ্চিমবঙ্গের মোট এলাকার দ্বিগুণেরও বেশি জায়গা জুড়ে থাকা থোয়েইট্স হিমবাহটির বরফ গলে যাওয়ার ফলে ইতিমধ্যেই সমুদ্রের জলস্তর উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে উদ্বেগজনক ভাবে। উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলস্তর গত এক দশকে যতটা উঠে এসেছে, তার প্রায় ৪ শতাংশ ইতিমধ্যেই উঠেছে থোয়েইট্স হিমবাহটির বরফ গলে যাওয়ার ফলে।
রবিচন্দ্রন বলছেন, ‘‘আরও উদ্বেগের কারণ, ওই ফাটল দিয়ে লাগোয়া মহাসাগরের জল হু হু করে ঢুকে যদি থোয়েইট্সের আশপাশে থাকা আরও দু’-একটি হিমবাহকে গলিয়ে দেয়, তা হলে সমুদ্রের জলস্তর আরও ৮ ফুট উপরে উঠে আসবে।’’
আগামী বছরের মধ্যেই ওই হিমবাহে নেমে আরও পরীক্ষানিরীক্ষা (ফিল্ড স্টাডি) চালাবে একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল। যার নাম- ‘ইন্টারন্যাশনাল থোয়েইট্স গ্লেসিয়ার কোলাবরেশান’।
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা