চাঁদের সূর্যালোকিত দক্ষিণ মেরুর ক্লেভিয়াস খাদে (উপরে) জলের অণুর (ডান দিকে) সন্ধান দিয়েছে ‘সোফিয়া’। যা আসলে একটি ইনফ্রারেড ক্যামেরা, বসানো রয়েছে নাসার এই ৭৪৭ জেট বিমানে (নীচে)। এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে ৪৫ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়ছে। ছবি: নাসা
একান্ন বছর আগে চাঁদের মাটিতে পা রেখে, প্রথম মানুষ নিল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন এই ক’টি কথা, “আ স্মল স্টেপ ফর এ ম্যান, এ জায়ান্ট লিপ ফর ম্যানকাইন্ড।” তখন থেকেই ‘জায়ান্ট লিপ’ শব্দবন্ধ মানবজাতিকে তাড়া করে ফিরছে। কবে হবে সেই প্রচণ্ড লাফ? আপাতত পরিকল্পনা আছে ২০৩০-এর দশকে। যখন মানুষ যাবে মঙ্গলগ্রহে। তারও পরে মহাকাশযাত্রার অন্যান্য মাইলফলক। কিন্তু বাদ সাধছে সাধ্য। মহাকাশযাত্রায় চাই জ্বালানি। সে সমস্যা মিটবে কোথা থেকে?
সমস্যা মেটার ইঙ্গিত দিচ্ছে নাসা ও জার্মান এরোস্পেস সেন্টার। ‘নেচার অ্যাস্ট্রনমি’ জার্নালে সদ্য প্রকাশিত দু’টি প্রবন্ধে। নাসার স্ট্র্যাটোস্ফেরিক অবজ়ারভেটরি ফর ইনফ্রারেড অ্যাস্ট্রনমি (ইংরেজি আদ্যক্ষরে ‘সোফিয়া’) জানাচ্ছে, চাঁদের সূর্যালোকিত দক্ষিণ মেরুতে ‘ক্লেভিয়াস’ খাদে (যা পৃথিবী থেকেও খালি চোখে দেখা যায়) মিলেছে জল। এর আগে সূর্যালোকিত কোনও জায়গায় জলের খবর দিতে পারেনি কেউ। ওখানে জলের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, চাঁদের অনেক জায়গাতেই তা আছে। যা থেকে পাওয়া যেতে পারে হাইড্রোজেন— এক অতি উত্তম জ্বালানি। তবে কি চাঁদকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে মহাকাশ যাত্রায়? জল থেকে যদি নিষ্কাশন করে নেওয়া যায় হাইড্রোজেন, তা হলে পৃথিবী থেকে জ্বালানি বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। জ্বালানির ভার কমিয়ে মহাকাশ যাত্রায় সঙ্গে নেওয়া যায় অনেক যন্ত্রপাতি।
কী পরিমাণ জল মিলেছে সূর্যালোকিত চাঁদের মাটিতে? নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ১০০-৪১২ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, এক ঘনমিটার মাটিতে, মাত্র ১২ আউন্স। সাহারা মরুভূমির বালিতে জল রয়েছে এর ১০০ গুণ বেশি। তা হোক, বিজ্ঞানীরা উৎসাহিত চাঁদকে মহাকাশ যাত্রায় ঘাঁটি বানানোর সম্ভাবনায়।
আরও পড়ুন: নোবেল পুরস্কারের নেপথ্যে
সোফিয়া আসলে ভ্রাম্যমাণ ৭৪৭ বোয়িং জেট বিমানে বসানো এক ইনফ্রারেড ক্যামেরা, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে ৪৫ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়তে পারে। সোফিয়া-র মূল লক্ষ্য ব্ল্যাকহোল, নক্ষত্রপুঞ্জ, গ্যালাক্সি অন্বেষণ। সোফিয়া প্রকল্পের বিজ্ঞানী নাসিম রঙ্গওয়ালা বলেছেন, “এই প্রথম সোফিয়া চাঁদের দিকে তাকাল। আর তাকিয়েই সূর্যালোকিত মেরুপ্রদেশে পেয়ে গেল জল।” ‘নেচার অ্যাস্ট্রনমি’ মুখ্য পেপারের লেখক বিজ্ঞানী কেসি হনিবল বলেছেন, “ওই জল H2O, যে জল আমরা পান করি।”
জল এল কোথা থেকে? বিজ্ঞানীরা এখনও ধন্দে। সম্ভাবনা দুই। ক্ষুদ্রাকৃতি উল্কাপিণ্ড চাঁদের মাটিতে ছড়িয়েছে এমন রাসায়নিক, যা সেখানে উপস্থিত অণুর সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি করেছে জল। অথবা সৌরঝড়ের উপহার এই জলের অণু। আলোকিত অঞ্চল শুকনো। তা সত্ত্বেও সেখানকার মাটি কেমন করে জলের অণু ধরে রাখল, তা এক বিস্ময়।
আরও পড়ুন: গ্রহাণু বেন্নুতে পা ছোঁয়াল নাসার মহাকাশযান
এর আগে নানা অনুসন্ধানে (ভারতের পাঠানো চন্দ্রযান-১ তার অন্যতম) হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের যৌগ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে চাঁদে। কিন্তু সেটা হাইড্রক্সিল (— OH) না জল (H2O), সেটা ভাল করে বোঝা যায়নি। সোফিয়া প্রমাণ করেছে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে জলের অণুই আছে।
‘নেচার অ্যাস্ট্রনমি’ জার্নালে দ্বিতীয় পেপারের উপজীব্য চাঁদের মাটিতে জলের অণু। নাসার ‘লুনার কনাইসান্স অর্বিটার’ কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল হেন জলের অণু খুঁজেছেন চাঁদের অন্ধকার এলাকায়। অন্ধকার এলাকা মানে, উষ্ণতা সেখানে মাইনাস ১৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও কম। ওখানেও মিলেছে জলের অণু। এবং তা কোটি কোটি বছর ধরে আছে একই রকম। পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হেন বলেছেন, চাঁদের মেরুপ্রদেশে অনেক জায়গায় ছড়িয়ে আছে জলের অণু। সুতরাং তা থেকে হাইড্রোজেন নিষ্কাশিত করে মঙ্গল অভিযানে জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগানোর ব্যাপারেও হেন আশাবাদী।