Mars

৩০ জুলাই শুরু মার্সমিশন আর্টেমিস, দু’বছরের মধ্যে মিলবে প্রাথমিক ফল

২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি আর্টেমিস প্রকল্পে মঙ্গলে যাওয়ার জন্য ১৩ জনের নাম ঘোষণা করে নাসা। এঁদের মধ্যে আছেন ৪২ বছর বয়সি ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজা চারী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২০ ০২:০৬
Share:

গত বছরের শেষে মার্কিন কংগ্রেস ‘ইউনাইটেড স্টেটস স্পেস ফোর্স’ নামে এক নতুন সামরিক দফতরের জন্য ৭ লক্ষ ৩৮ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অর্থ অনুমোদন করে বিল পাশ করে। ২০ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই দফতরের সূচনা করেন। কেন এই স্পেস ফোর্স? দিনে দিনে মহাকাশে মানুষের অধিকার নিয়ে দাবি বাড়ছে। মহাকাশ বিজ্ঞান ও কারিগরি শিল্পে রাশিয়া, চিন, জাপান, ইউরোপ, ভারত এগিয়ে চলেছে নিরন্তর। তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার ছোট-বড় কৃত্রিম উপগ্রহ ও রকেট। ক্রমশ আকাশ হয়ে ‌উঠছে যানবহুল। সেখানে জমি নেই। তা-ও আকাশছোঁয়া দামে আকাশ বেচাকেনার চেষ্টা করছেন কিছু কোটিপতি ব্যবসায়ী।

Advertisement

রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯৭০ কোটি হওয়ার সম্ভাবনা। এখনকার জনসংখ্যার থেকে ২০০ কোটি বেশি। ১৯৯০ সালের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মহিলা পিছু গড়ে ৩.২ সন্তান থেকে কমে ২.৫ সন্তান হয়েছে। তবু এই অতিরিক্ত ২০০ কোটি লোকের জন্য অতিরিক্ত খাবার, জ্বালানি, অক্সিজেন প্রয়োজন। ও দিকে, বেড়ে যাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড। বিশ্ব উষ্ণায়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। জনস্ফীতির চাপে দেখা দেবে খাদ্যাভাব। তাই মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ভাবনা, চাঁদে বা মঙ্গলে মানুষের দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার। অতিমারি সেই ভাবনা রূপায়ণে যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, তার প্রমাণ জুলাইয়ের শেষে একের পর এক মঙ্গল অভিযান। ১৯ জুলাই হোর অরবাইটারের মঙ্গল পাড়ির হাত ধরে শুরু হয় সংযুক্ত আরব আমিরশাহির এমিরেটস মার্স মিশন। ২৩ জুলাই যাত্রা শুরু করেছে চিনের মঙ্গলযান তিয়ানওয়েন-১। এর পরে নাসা-র পালা। শুরু হতে চলেছে আর্টেমিস প্রকল্প। মঙ্গলে পাড়ি দেবে নাসা-র মানুষ-বিহীন রোভার।

১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে প্রথম চাঁদে পা রাখে মানুষ। তার প্রায় ২৮ বছর বাদে ১৯৯৭ সালের ৫ জুলাই মঙ্গলের মাটি স্পর্শ করে রোভার সোজার্নার। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ সংস্কারক ইসাবেলা বমফ্রি ওরফে সোজার্নার ট্রুথ-এর নামানুসারে এই রোভারের নামকরণ। সোজার্নারের দুই ‘চোখ,’ যা দিয়ে সে মঙ্গলের মাটি আকাশ পর্যবেক্ষণ করে, তা হল— আলট্রা প্রোটন এক্স-রে স্পেক্ট্রোমিটার ও ইমেজার ফর মার্স পাথফাইন্ডার। পৃথিবীর মাটিতে বসে বিজ্ঞানী ও উৎসুক জনতা দেখে নিলেন মঙ্গলের লাল মাটি। শার্ক, জোগি, বার্নাকল বিল, অ্যারে ভ্যালি, কাস্পার ইত্যাদি নানা পাথুরে টিলা রয়েছে সেখানে। সম্প্রতি ২০১২ সালে মঙ্গলের গেল ক্রেটারে নামে কিউরোসিটি রোভার। তার ক্যামেরায় ধরা পড়ে নাটকীয় চিত্র। আজ থেকে ৩৫০ কোটি বছর আগে মঙ্গলে যথেষ্ট জল ছিল। ছিল পাহাড়, ঝর্না, নদীনালা, হ্রদ। বিশেষত মাউন্ট শার্কের কাছে তোলা কিউরোসিটির ছবিতে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তাই হয়তো এক কালে মঙ্গলে ছিল প্রাণও।

Advertisement

১৯৮৪ সালে আন্টার্কটিকায় এক ভূতাত্ত্বিক অভিযানে ১২টি উল্কাপিণ্ড উদ্ধার করা হয়। আজ থেকে ৩৬০ কোটি বছর আগে মঙ্গলগ্রহ থেকে এক প্রবল বিস্ফোরণে এই এক ডজন উল্কা পৃথিবীতে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে কিছু আগ্নেয় শিলা এবং কার্বনজাত রাসায়নিক। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অ্যালান হিলস ৮৪০০১ নামের উল্কাপিণ্ড। মাত্র দুই কিলোগ্রাম ওজনের এই মহাজাগতিক বস্তুটিতে মৃত ব্যাকটিরিয়ার কোষের মতো লম্বাটে সসেজ আকৃতির কিছু ক্যালসিয়াম কার্বনেটের খোল খুঁজে পান নাসার বিজ্ঞানীরা। এই খবর ১৯৯৬ সালের ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’ জার্নালে প্রকাশের পর থেকে তুমুল হইচই শুরু হয়। উল্কাপিণ্ডে ব্যাকটিরিয়ার অবশেষ প্রমাণিত হলে পৃথিবীর বাইরে ভিন্ন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব প্রথম স্বীকৃতি পাবে। বিভিন্ন গ্রহে, উপগ্রহে মানুষের উপনিবেশ গড়ে তোলাও আর অবিশ্বাস্য ঠেকবে না। তবে উপনিবেশ গড়তে চাই জল।

কিছু দিন আগে বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে বরফের সন্ধান পেয়েছেন। এই গ্রহে বাতাসের চাপ খুবই কম। তাই পৃথিবীর মতো উন্মুক্ত জায়গায় কোনও জলাশয় খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। থাকলে তা মাটির নীচে। মঙ্গলের ভর পৃথিবীর ৯.৩ ভাগ, আর উপরিতলের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ২.৬৫ ভাগ। ফলে মঙ্গলে দীর্ঘ দিন বসবাসের জন্য চাই সেখানকার পরিবেশে চাষ-আবাদ করে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদনের জ্ঞান। ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি আর্টেমিস প্রকল্পে মঙ্গলে যাওয়ার জন্য ১৩ জনের নাম ঘোষণা করে নাসা। এঁদের মধ্যে আছেন ৪২ বছর বয়সি ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজা চারী। মঙ্গল স্নাতকদের মধ্যে আছেন ৭ জন পুরুষ ও ৬ জন মহিলা। ২০১৭ সালে ১৮ হাজার প্রার্থীর মধ্যে থেকে বাছাই করে এঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মঙ্গলে যেতে সময় লাগবে বেশ কয়েক মাস। তাই যাত্রার প্রথম ধাপ হিসেবে আর্টেমিস ২ অভিযানে নাসার ওরিয়ন মহাকাশযানে চেপে ১০ দিনের অভিযানে পৃথিবীর ২,৮০,০০০ মাইল দূরে চাঁদের কক্ষপথ পরিক্রমা করবেন এই স্নাতকেরা। ২০২৪ সালে একসঙ্গে পুরুষ ও মহিলার পদার্পণ ঘটবে চাঁদে। এর পর আরও কঠোর অনুশীলন। তার পর ২০৩০ নাগাদ মঙ্গল মিশন। গত বছর থেকেই এই অভিযানের প্রস্তুতি তুঙ্গে।

মঙ্গল নিয়ে মানুষ বরাবরই কৌতূহলী। মিশরীয় সভ্যতায় এই গ্রহটিকে বলা হত হের দেসের বা লাল বিন্দু। ব্যাবিলনের মানুষ বলত নেরগাল বা মৃত্যুর তারকা। প্রাচীন গ্রিসের বাসিন্দারা একে বলত রাগী তারকা— যুদ্ধ ও রক্তপাতের কারণ। রোমানরা তাদের যুদ্ধ দেবতার নামে আকাশের এই লাল বিন্দুর নাম রাখল মার্স। সাম্প্রতিক কালে এই লাল গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীর সম্ভাবনা নিয়ে অনেক জল্পনা হয়েছে। সাইবেরিয়ায় এক বিশাল সমকোণী ত্রিভুজাকৃতি গমখেত বসানোর প্রস্তাব দেন উনিশ শতকের জার্মান গণিতজ্ঞ কার্ল ফ্রিডরিক গস। উদ্দেশ্য, পৃথিবীর মানুষের গণিত বিষয়ে জ্ঞান মঙ্গলবাসীদের বোঝাতে হবে। ১৮৭৭ সালে জিয়োভান্নি স্কিয়াপ্যারাল্লি দূরবিন দিয়ে লাল গ্রহের গায়ে আঁচড়ের দাগ দেখে মনে করেন, সেগুলো উন্নত প্রাণীর তৈরি জলনিকাশি নালি। তখন সদ্য সুয়েজ খাল কাটা হয়েছে। তাই নামকরণ হল স্কিয়াপ্যারাল্লি ক্যানালি। শুরু হল মানুষের মঙ্গল-রোমাঞ্চ!

আর্টেমিস প্রোগ্রামের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হবে ৩০ জুলাই। রোভার পারসিভের‌্যান্স পাাড়ি দেবে মঙ্গলে। নাসার হিসেবমতো তাতে মোট খরচ হবে ২৪৬ কোটি মার্কিন ডলার। এই মিশনে তিনটি ল্যান্ডিং সাইট চিহ্নিত করা হয়েছে। জেজ়েরো ক্রেটার, এন ই সারটিস এবং কলম্বিয়া হিলস। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ্য হল জেজ়েরো ক্রেটার। সম্ভবত উল্কাপাতে এই ক্রেটারের সৃষ্টি হয়েছিল। আজ থেকে ৩৫০ কোটি বছর আগে সেই খাদে জল জমে চিল্কা হ্রদের প্রায় দ্বিগুণ আকৃতির একটি হ্রদ তৈরি হয়। হয়তো সে জলে ছিল মঙ্গলের মাছ। আজ ক্রেটারে জল নেই। কিন্তু সেই তখনকার জলের নীচের পলিতে জমাট বাঁধা পাললিক শিলার মধ্যে ধরা থাকতে পারে কোটি বছর আগেকার কোনও অজানা প্রাণীর জীবাশ্ম। রোভার মিশনে ক্রেটার জরিপের পাশাপাশি পাথর খনন করা হবে। উন্নত অ্যানালাইজারের সাহায্যে বিশ্লেষণও করা হবে সেখানেই। ২০২২ সালের মধ্যে জানা যাবে তার প্রাথমিক ফলাফল। ফলে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে।

ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (এসা) এবং রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমস-এর তরফেও ২০২০ সালের জুলাই মাসে রোভার ‘রোজ়ালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন’ পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ দমকা ঝড়ের মতো কোভিড-১৯ সব পরিকল্পনা ওলটপালট করে দিল। নতুন হিসেবমতো এই রোভার মঙ্গলের পথে পাড়ি দেবে ২০২২ সালে। সেখানে পৌঁছবে ২০২৩ সালে। পৃথিবীর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডে আঘাত করেছে অতিমারি। ফলে আমেরিকায় আর্টেমিসের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এসএলএস) এবং ওরিয়ন ক্যাপসুল বানানো স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।

আর্টেমিস প্রকল্পে মঙ্গলে মানুষের যে প্রথম শিবির বসতে চলেছিল, তার সময়সীমাও এখন অনিশ্চিত। সে জন্য অবশ্য আগে থেকে মঙ্গলের মাটিতে পাঠানো রোভারের ‘চোখ’ দিয়ে স্থান নির্বাচন হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। আশা করা যায়, তত দিনে এই সমস্যা মিটবে। অর্থনীতি ফের স্থিতিশীল হবে।

১০ জুলাই জাপানের সঙ্গে আমেরিকার এক জয়েন্ট এক্সপ্লোরেশন ডিক্লারেশন অব ইন্টেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। চাঁদ ও মঙ্গল অভিযানে যৌথ ভাবে কাজ করবে দুটি দেশ। এই অভিযানগুলোয় মহাকাশচারীদের পাশাপাশি কাজ করবে উন্নত রোবট। অর্থাৎ, আগামী দু’দশকের মধ্যেই মানুষ এবং কারগো নিয়ে লাল গ্রহের পথে পাড়ি দেবে এসএলএস। দেরিতে হলেও মঙ্গলে বসবে মানুষের হাট।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement