প্রতীকী ছবি।
বাদুড়ের দেহে কসরৎ, সাপের দেহে প্ল্যানিং, ঠিক তারপরেই আক্রমণ, মানুষে। এটাই কি সন্ত্রাসের পথ-মানচিত্র বিশ্বত্রাস করোনা ভাইরাসের? করোনার এপিসেন্টার নাকি চিনের ইউহান প্রদেশে সি-ফুডের দোকানের সাপের মাংস। তাই বছরের শুরুর দিন থেকেই দোকানের ঝাঁপি বন্ধ করতে আদেশ। আগে ভাবনা ছিল বাদুড় থেকে কোনও ভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করেছে এই ২০১৯-এনসিওভি ভাইরাস। হ্যাঁ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দিষ্ট এই নামেই বিজ্ঞানীরা আজকের ঘাতক ভাইরাসটিকে চেনেন। এখন তো জানা যাচ্ছে, বাদুড় থেকে সাপ হয়ে মানুষে। চিনা কালাচ ও কোবরা সম্ভবত করোনা ভাইরাসের আধার হিসেবে কাজ করছে। ভাইরাসেরা নামতার মতো লাফ দেয়। এক-একটা লাফে বহু গুণ শক্তি বাড়িয়ে নব কলেবরে হাজির হয়। সারস (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) এবং মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম)— এই দুটোই করোনা ভাইরাস প্রকাশের পরিচিত রূপ। মূলত নিঃশ্বাসের কষ্ট দিয়ে শুরু করে ঘাতক হয়ে ওঠা এই ২০১৯-এনসিওভি-র বর্তমানে কোনও টিকা নেই। উনিশ জন আক্রান্তের দেহ থেকে ভাইরাস পরীক্ষা করে ওয়াশিংটনের বিজ্ঞানী ট্রেভর বেডফোর্ড দেখালেন, নিতান্ত বৈচিত্রহীনতায় ভুগছে ভাইরাসগুলো। মানে? সম্ভবত ২০১৯-এর শেষ দু’মাসেই নবজন্ম। আমেরিকার বিজ্ঞানীদের আঙুল সেই ‘সি ফুডের’ দোকানে। তা বলে সাপ!
কিছুতেই মানতে রাজি নন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড রবার্টসন। তাঁর মতে, সাপ হয়ে মানুষে প্রবেশ এত দ্রুত হতে পারে না। কিন্তু ভাইরাসকে বুঝে ওঠার সমস্যা তো শতাব্দীর শুরুতেই।। জীব বিজ্ঞানের প্রতিটি পরিবর্তনের অদৃশ্য সুতো বিবর্তনের লাটাইতে বাঁধা। বুঝতে ঘাড় ঘোরাতেই হবে। ঘাড় ঘোরালেই সামনে গ্রিক মহাকাব্যের রহস্যময়ী রাক্ষসী মেডুসা। সঙ্গে বিস্ময়কর ক্ষমতা মানুষকে প্রস্তরে রূপান্তরিত করার। এই ধরনের কথা মহাকাব্যের পাতায় আর সীমাবদ্ধ থাকছে না।
২০১৯-এ জাপানের উষ্ণপ্রস্রবণ থেকে আবিষ্কার হল এক অজানা ভাইরাস। পরীক্ষাগারে দেখা গেল, বেচারি প্রোটোজোয়া ভাইরাসের ভয়েই পাথর। নেই কোনও নড়ন-চড়ন। বিজ্ঞানীরা সেই ভাইরাসের নাম দিলেন মেডুসা ভাইরাস। পুরনো ডিএনএ কে ছাঁচ হিসেবে ব্যবহার করে নতুন ডিএনএ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচকও রয়েছে এদের দেহে। আমাদের দেহেরও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই উৎসেচকটি সম্ভবত তাদেরই উপহার। শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষ হওয়ার যে পথ, তাতে ৩০ শতাংশের বেশি প্রোটিনের মনুষ্যমুখী অভিযোজনে ভাইরাসের সরাসরি ভূমিকা দেখা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: কলকাতার শীত এ বার নোবেলবর্ষী, শহরের লাভ হল কি!
২০১৫ সালে সাইবেরিয়ায় ৩০ হাজার বছরের পুরনো পার্মাফ্রস্ট থেকে বের হল ঘুমন্ত মলিভাইরাস। আকারে বিশাল এই ভাইরাসগুলো বিবর্তনের রহস্যময়তাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর উত্তর রয়েছে জীবের জিনোমে। মলিভাইরাসের জিনসংখ্যা ৫০০, পিথোভাইরাসের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৪৬৭, কিন্তু প্যান্ডোরা ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রায় তিন গুণ থেকে পাঁচ গুণ। আর আমাদের পরিচিত হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি)-র জিনসংখ্যা কিনা মাত্র নয়। বৃহত্তম আরএনএ ভাইরাস, করোনার প্রোটিন তো মূলত চার প্রকার। গবেষণায় দেখা গেল প্যান্ডোরা ভাইরাস নতুন নতুন কার্যক্ষম জিন (কোডিং রিজিয়ন)তৈরি করতে সক্ষম পূর্বের নন-কোডিং রিজিয়ন থেকে। আসলে কোনও জীবের গোটা জিনোম বা জেনেটিক পদার্থের যে অংশটি সেন্ট্রাল ডগমা পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে প্রোটিন তৈরি করে সেগুলিই জিনের কোডিং রিজিয়ন। যে অংশগুলি সরাসরি এই পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করে না, সেগুলি নন-কোডিং রিজিয়ন। অর্থাৎ শুধু কার্যক্ষম জিন থেকে নয়, অন্য অংশ থেকেও ফের নতুন জিন তৈরিও করছে ভাইরাস। ফলে ভাইরাসের জিন ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।এই ঘটনাকেই বলা হয় মাইক্রোইভোলিউশন, যা কাজে লাগিয়ে এরা নিজেদের ক্রমশ অচেনা করে তুলেছে। পিথোভাইরাসের রকমসকম কিছুটা পক্স ভাইরাসের মতো। মলি ভাইরাস আবার পরিচিত হারপিসের মতো। অজানা এই শত্রুর আক্রমণের কোনও উত্তর নেই আমাদের কাছে। তবে কি আমাদেরও পাথর হওয়ার পালা? যদিও বিজ্ঞানীরা একটু ধৈর্যশীল হতে বলছেন।
আরও পড়ুন: ট্রেনিং লাগে না, আমরা কী বলতে চাই, বুঝতে পারে রাস্তার কুকুর, দেখালেন অনিন্দিতা
ভাইরাস কি? জীবনই বা কি? প্রাণের পুরাণে ভাইরাসের ভূমিকা বেশ ধূসর। এক দল বিজ্ঞানী মনে করেন, কোষের বিবর্তনে ভাইরাস অপরিহার্য। ভাইরাসের হাত ধরেই কোষে ডিএনএ-র আগমন। কোষের শুরুতে ডিএনএ দিয়ে স্থিরতা আসার আগে আরএনএ-র উপর নির্ভরশীল ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তামাক গাছের পাতায় ভাইরাস আবিষ্কারের সঙ্গেই বিজ্ঞানের নতুন এক শাখার শুরু। একটা সময় পর্যন্ত ধারণা ছিল, সমুদ্র বোধ হয় ভাইরাস-মুক্ত। কিন্তু সেটা যে কতটা ভুল, তার প্রমাণ মিলল মাত্র ৫০ বছর আগেই। সংখ্যাটা চমকে দেওয়ার মত। অঙ্কের হিসেবে ১-এর পিঠে ৩০টা শূন্য।
ভাইরাসের বেঁচেবর্তে থাকাটাই পোষকের কোষকে হাইজ্যাক করে। ভাইরাসের বিবর্তনের অনেক মতবাদ রয়েছে। এক দলের মতে, পোষক কোষকে হাইজ্যাক করে এরা নিজেদের প্রয়োজন মতো বদলে ফেলে। কিন্তু সেটা বোধহয় সম্পূর্ণ ব্যাখা নয়। ভাইরাসের ঘাতক হয়ে ওঠার পিছনে তাদের বংশলতিকার জটিল পরিবর্তনটা আবশ্যিক ছিল।
বেশ কিছু সাংঘাতিক ঝাঁপ, যার ফলে এইচআইভি, বার্ড ফ্লু, ইবোলা জ্বর চূড়ান্ত বিপর্যয় ডেকে নিয়ে এল। ডেঙ্গির বানরের দেহ থেকে মরিয়া একটা লাফে আমাদের দেহে মৃত্যুদূত। একটি প্রাণীর দেহ থেকে সম্পর্কহীন নতুন প্রাণীর দেহে ঝাঁপ। ঠিক এই কারণেই ভাইরাসের শুরুটা ঠিক কোথায় বুঝে ফেলা যাবে না। প্রাণীকূলের বিবর্তনের ধারা ভাইরাস অনুসরণ করলে তারা এতটা জটিল হয়ে উঠত না। যেমন, আমাদের আর শিম্পাঞ্জির দেহে পাওয়া যাওয়া ‘হেপাটাইসিস বি’ ভাইরাস জিনে বেশ অমিল হলেও শুরুতে একটি ভাইরাসই ছিল। এখন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন বেশভূষা। ২০০৩ সাল থেকে বিশালাকার ভাইরাস সম্পর্কে জানতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। বেশ বড়সড় জিনোম তাদের রহস্যময় করে তুলেছে। এদের অবস্থান আরও ধূসর, এরা ভাইরাস ও ব্যাকটিরিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে। কিছু বিজ্ঞানীর মতে, বিবর্তনের সূচনাতে এরা হয়তো স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, সময়ের সঙ্গে স্বাধীন প্রজননের ক্ষমতা হারিয়েছে।
বর্তমানে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা উষ্ণতা ভাইরাস-সমস্যাকে হাতের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার জন্য সুমেরু অঞ্চলে কয়েকশো মিথেন গহ্বর হাঁ করেছে, বেড়িয়ে পড়ছে শত শতাব্দী প্রাচীন ভাইরাসেরা। শুধু তা-ই নয়, এখন তো বনাঞ্চল থেকেও পাওয়া যাচ্ছে বিশাকার ভাইরাসগুলি। জীবনের গঠন কি তবে ত্রিভুজ থেকে চতুর্ভুজ হতে চলেছে? প্রোক্যারিয়োটিক, ইউক্যারিয়োটিক আর আর্কিয়ার সঙ্গে কি ভাইরাসও যোগ দেবে? চিরতরে জড়ত্বর মুক্তি ঘটিয়ে প্রাণসন্ধানী ভাইরাসের আর কতটা পথ বাকি? জীবনের সংজ্ঞা ধূসর হচ্ছে আরও।