স্রষ্টা: প্রতীক ঘোষ। নিজস্ব চিত্র
বন্ধুর বাচ্চা ছেলেটি কিছুতেই শক্ত হয়ে যাওয়া কিমা-পরোটা খেতে চাইছিল না। রুটির সঙ্গে কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের তুলনা টেনে গল্প বলতে শুরু করায় সেই ছেলেই দিব্যি খেয়ে নিল। দিনটি এখনও মনে আছে প্রতীক ঘোষের। ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
ঘটনাটি গল্পের ক্ষমতা নিয়ে প্রতীকবাবুকে সচেতন করে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গল্প বলার এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করার মতো কোনও উপযুক্ত অ্যাপ তো নেই! মরিশাস-প্রবাসী বাঙালি এই মানুষটির পড়াশোনা কলকাতা ও লন্ডনে। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর এই ছাত্র ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করেছেন। কনসাল্টিং করেছেন। গল্পের, শব্দের শক্তিকে ঠিকমতো ব্যবহারের জন্য নতুন অ্যাপ বানানোর নেশায় সব ছেড়ে প্যারিস চলে এলেন। তার পরে গবেষণা, পরিকল্পনা, কোডিং। এক বছর পরে আত্মপ্রকাশ করল ‘জাস্টোরি’ (Justori)।
গল্প, কবিতা, গান, কৌতুক, নিজের কথা, সংবাদপাঠ— যা কিছু ইচ্ছে রেকর্ড করে, সম্পাদনার পরে আপলোড করতে পারেন এই অ্যাপে। পর পর রেকর্ডিংগুলি সাজিয়ে রাখতেও পারেন। অ্যাপের ‘স্টুডিয়ো’ সেকশনে ঢুকে যখন খুশি তা করতে পারেন। ড্রাফ্টে তা সেভ করে রেখেও দিতে পারেন। পরে তা আপলোড করে দিন। আপনার কথা সবাইকে শোনাতে পারেন, আবার ছোট গ্রুপের মধ্যেও রাখতে পারেন। আপনার কথা শুনে, কেউ ইচ্ছে করলে মন্তব্যও করতে পারেন এই অ্যাপে। অ্যানড্রয়েড-এর ‘গুগল প্লে’ বা অ্যাপল-এর ‘অ্যাপ স্টোর’ থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিতে পারেন।
‘‘বাকস্বাধীনতা জাস্টোরির প্রথম স্তম্ভ’’, বলছিলেন প্রতীকবাবু। এই অ্যাপে যে কেউ, যা কিছু বলতে পারেন। কোথাও কোনও সেন্সর নেই। যত ক্ষণ না কেউ আপত্তি তুলছেন। আপত্তি তুললেও প্রথমে মিটমাট করে নিতে বলা হয়। তা না হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, জানালেন প্রতীকবাবু।
এর পাশাপাশি, জাস্টোরি এক ধরনের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর ব্যবস্থাও করে। যে কেউ যে কোনও জায়গা থেকে তাঁর কাজ আপলোড করতে পারেন। প্রশংসিত হলে, মূল ধারায় সুযোগ পেতে পারেন।
কিন্তু শুধু শব্দ নিয়ে তৈরি একটি অ্যাপ কি জনপ্রিয় হতে পারে? ‘‘শব্দের নিজস্ব শক্তি আছে। ছবি বা ভিডিয়ো দেখতে হয়। ছাপা অক্ষর পড়তে হয়। কিন্তু শব্দে, কানকে আর মনকে সজাগ রাখতে হয়। ফলে কাজ করতে করতে জাস্টোরি শুনতে পারেন। অনেকটা রেডিয়োর মতো,’’ বলছিলেন প্রতীকবাবু। তবে রেডিয়োর থেকে বাড়তি একটি সুবিধা আছে। রেডিয়োয় কোনও অনুষ্ঠান শুনতে গেলে আপনাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়। এখানে যখন খুশি শুনতে পারেন।
ইউটিউব এখন খুব পরিচিত নাম। ভিডিয়ো বা অডিয়ো শোনার জন্য মোবাইলের ইউটিউবে ঢুঁ মারেন না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেখানে শুধু শব্দ শোনার জন্য কেউ জাস্টোরিতে আসবেন কেন? প্রতীকবাবু তুলে ধরলেন দু’টি যুক্তি। তিনি জানান, ইউটিউব প্রধানত ভিডিয়োর জন্য তৈরি। শুধু শব্দ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন বা শুনতে আসেন, তাঁরা ওই প্ল্যাটফর্মে অনেকটা ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’। তা ছাড়া, এখানে শুধু এমপি-৪ ফাইল আপলোড করা যায়। এবং ধরেই নেওয়া হয়, আপনি যা আপলোড করছেন তা চূড়ান্ত। আপলোডের পরে ইউটিউব লিঙ্ক ফেসবুক, টুইটার বা অন্য কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিলেন। মন্তব্য এল, রিভিউ হল। এ বার কাজটিতে কোনও পরিবর্তন করতে চাইলে আপনাকে আবার ইউটিউবে আপলোড করতে হবে। আবার লিঙ্ক শেয়ার করতে হবে। যাতে আগের রিভিউ, মন্তব্যগুলি হারিয়ে যাবে। কিন্তু জাস্টোরিতে আপনি ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করুন। আপনাআপনি তা যেখানে লিঙ্ক শেয়ার করেছেন, সেখানেও পরিবর্তন হয়ে যাবে।
কোনও অ্যাপ-এর অস্তিত্ব নির্ভর করে তা নতুন প্রজন্মের কাছে কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তার উপরে। জাস্টোরির মধ্যে প্রবল ভাবে সেই সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন প্রতীকবাবু। এই সময়ের নবীনদের এক বড় সমস্যা বিচ্ছিন্নতা। তাঁরা বড় একা। নিজের যন্ত্রণা, কষ্ট প্রকাশের জায়গা নেই। জাস্টোরি এই একাকিত্বের বেড়া ভেঙে সংযোগ গড়ে তুলতে পারে। শুধু বলতে হবে। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ শোনার জন্য বসে আছেন।
এই সংযোগ সম্ভব হয়েছে বলেই জাস্টোরিতে নথিভুক্ত সদস্য রয়েছেন ২,৭৭২ জন। এখন পর্যন্ত এই ওয়েবসাইটে এসেছেন ১,১৯,২০৬ জন। ৩০টি ভাষায় নানা ধরনের উপস্থাপনা। গল্প প্রকাশিত হয়েছে ১,০১৭টি। আর বাঙালি? বিশ্ব জুড়ে বাঙালিরা এর সদস্য হচ্ছেন। কবিতা, গান, গল্প, এমনকি, সংবাদপত্র পাঠও করছেন কেউ কেউ। তাঁর মধ্যে ছোটরাও আছে। পুরোটাই বিনা খরচে।
তা হলে, এই অ্যাপ কি পুরো বিজ্ঞাপনহীন? না। ইউটিউব বা ফেসবুকে যে ভাবে থাকে, সে ভাবে থাকবে না। তবে এর বাণিজ্যিক দিকও আছে। এখানে কোনও সংস্থা তার পণ্য বা পরিষেবা নিয়ে ভয়েস নোটে ‘ওরাল রিভিউ’ তৈরি করতে পারবে। পরে সেই নোটটি বিজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করতে পারবে।
অ্যাপটির কাজ চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে। সার্ভার নেদারল্যান্ডসে, কোড লেখা হয়েছে কলকাতায় বসে। অ্যাপটি নথিভুক্ত হয়েছে মরিশাসে। আর প্রশাসনিক কাজকর্ম হয় নিউ ইয়র্ক এবং প্যারিস থেকে। সব মিলিয়ে এক বিশ্বজনীন আয়োজন।