ষণ্মুগ সুব্রমনিয়ন
ল্যাপটপে গাদা-গাদা ছবি। দৈনিক ছ’-সাত ঘণ্টা ধরে সেই ছবি পরীক্ষা করতেন বছর তেত্রিশের দক্ষিণী ইঞ্জিনিয়ারটি। কার্যত খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো সেই কাজই আচমকা সংবাদ-শিরোনামে নিয়ে এসেছে চেন্নাইয়ের বাসিন্দা ষণ্মুগ সুব্রমনিয়নকে। চাঁদে অবতরণের আগে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়া বিক্রমের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে দিয়েছেন তিনিই! এই কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা— নাসা।
নাসার ‘লুনার রিকনিস্যান্স অরবিটার’ (এলআরও)-এর পাঠানো ছবি বিশ্লেষণ করে চন্দ্রযান-২-এর বিক্রম ল্যান্ডারের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করে নাসাকে জানিয়েছিলেন সুব্রমনিয়ন। মঙ্গলবার নাসা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, সুব্রমনিয়নের দাবিই ঠিক। অবতরণের সময় চাঁদে আছড়ে পড়ে ভেঙে গিয়েছে বিক্রম। তবে রাত পর্যন্ত ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) এ নিয়ে বিবৃতি দেয়নি। তবে ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘তারকা’ হয়ে উঠেছেন সুব্রমনিয়ন।
গত ২২ জুলাই শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। তার তিনটি অংশ, অরবিটার, বিক্রম ল্যান্ডার এবং বিক্রমের শরীরের ভিতরে থাকা রোভার প্রজ্ঞান। ৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে (রাত ১২টা পেরিয়ে যাওয়ায় সরকারি হিসেবে ৭ সেপ্টেম্বর) চাঁদে অবতরণের কথা ছিল বিক্রমের। কিন্তু অবতরণের ঠিক আগে বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
নাসা জানিয়েছে, ২৬ সেপ্টেম্বর ‘এলআরও’ বিক্রমের অবতরণস্থলের চারপাশের ছবি তুলেছিল। সেই ছবি দেখে সুব্রমনিয়ন বিক্রমের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেছিলেন এবং নাসার বিজ্ঞানীরা বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৩৪ মিটার উঁচু একটি জায়গায় প্রথমে আছড়ে পড়েছিল বিক্রম। সেখান থেকে ৭৫০ মিটার উত্তর-পশ্চিমে বিক্রমের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেছেন সুব্রমনিয়ন। কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজ়িক্স-এর অধিকর্তা সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কম। তার ফলে আছড়ে পড়ার পরে ধ্বংসাবশেষগুলি বেশ কিছুটা উপরে উঠে ছিটকে পাঁচ-সাতশো মিটার দূরে পড়তে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘বিক্রমের ভেঙে পড়ার সম্ভাবনার কথা আমরা আগেই বলেছিলাম।’’
আদতে মাদুরাইয়ের বাসিন্দা সুব্রমনিয়ন তিরুনেলবেল্লির সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক। কর্মসূত্রে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি করলেও রকেট এবং অন্যান্য প্রযুক্তি নিয়ে নিয়মিত ব্লগ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘এলআরও’ ছবি প্রকাশ করার পরে তিনি বিক্রমের অবতরণের আগে ও পরে নাসার চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি কম্পিউটারে ডাউনলোড করেন এবং তা ঘেঁটে বিক্রমের সন্ধান শুরু করেন, দিনে ছ’-সাত ঘণ্টা করে। তাঁর কথায়, ‘‘যেখানে বিক্রমের অবতরণের কথা ছিল, তার ২ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে খোঁজ করতে গিয়েই কতগুলো টুকরো পড়ে থাকতে দেখি। তা নাসা এবং ইসরোকে জানিয়েছিলাম। নাসা ই-মেল করে জানিয়েছে, আমার দাবিই ঠিক।’’
সন্দীপবাবু বলছেন, অবতরণের সময় বিক্রমের আনুভূমিক গতির থেকে উল্লম্ব গতি বেড়ে গিয়েছিল। তার ফলে একটি গহ্বরের উঁচু জায়গা বা কোণায় ধাক্কা খায়। আরও একটি প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বলছেন, ‘‘নাসা জানিয়েছে, চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৩৪ মিটার উচ্চতায় ধাক্কা খেয়েছে বিক্রম। কিন্তু ইসরো জানিয়েছিল, ৩৩৪ মিটার উচ্চতা থেকেও বিক্রম সঙ্কেত পাঠিয়েছে। তা হলে কি ধাক্কা খাওয়ার পরেও শেষ বারের মতো রেডিয়ো-বার্তা পাঠিয়েছিল সে?’’
এ রহস্যের উত্তর এখনও মেলেনি।