নকল-আসল: ফ্রান্সিস ক্রিক এবং জেমস ওয়াটসনের মূর্তির পাশে বসে নোবেল পুরস্কারবিজয়ী হ্যারল্ড এলিয়ট ভার্মাস।
সালটা ১৯৫৩। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো দিকে একটা ছোট্ট পাব ‘ঈগল’। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামীদামি বিজ্ঞানীরা এখানে বসে মগজাস্ত্রে ধার দিতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত ক্ষুরধার আলোচনা। লোকে বলত ‘থিঙ্কিং ইন’।
ঈগলে আসা-যাওয়া ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণ বিজ্ঞানীরও। জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক তখন কেমব্রিজের ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছেন। পাবে বসে কতগুলো তার পেঁচিয়ে কী যেন বানানোর চেষ্টা করতেন দুজনে। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎই এক দিন ঘোষণা করলেন, এই ঈগল পাবে বসে তাঁরা ‘জীবন-রহস্য’ উন্মোচন করে ফেলেছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁদের গবেষণাপত্রটি। তার দিয়ে যে খাঁচাটি তৈরি করেছিলেন দুজনে, সেটি ছিল ডিএনএ ডাবল হেলিক্স। ওয়াটসনদের আবিষ্কারের পিছনে অবশ্য আরও দুই বিজ্ঞানীর অবদান ছিল। মরিস উইলকিন্স এবং রোজ়ালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন। ১৯৬২ সালে ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কারের জন্য ওয়াটসন এবং ক্রিকের সঙ্গে উইলকিন্সও নোবেল পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ফ্র্যাঙ্কলিন তত দিনে মারা গিয়েছেন। উইলকিন্স ও ফ্র্যাঙ্কলিনকে সে ভাবে মনেও রাখেনি ইতিহাস। ২৫ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে এখন ‘ডিএনএ ডে’ হিসেবে পালন করা হয়।
ওয়াটসনদের তৈরি ডিএনএ মডেলটি এখনও রাখা আছে ‘ঈগল’-এ। আর তার একটি প্রতিলিপি রাখা আছে কল্যাণীতে দেশের এক মাত্র জিন মিউজ়িয়ামে। কল্যাণীর জিন বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স’ (এনআইবিএমজি)-এ রয়েছে এই প্রদর্শনীশালা। নাম ‘দ্য হিউম্যান জিনোম হল’। এনআইবিএমজি ও ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়াম’-র যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা হয় এটি। ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রদর্শনীশালার উদ্বোধন করেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হ্যারল্ড এলিয়ট ভার্মাস। রেট্রোভাইরাল অঙ্কোজিনের (এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস, যা তার জিনোম অতিথি-কোষের ডিএনএ-তে ঢুকিয়ে দিয়ে সে কোষের চরিত্র বদলে দেয়) উৎস আবিষ্কার করার জন্য তিনি ও বিজ্ঞানী জে মাইকেল বিশপ ১৯৮৯ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পান।
প্রতিষ্ঠানের মূল দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেই স্বাগত জানাচ্ছে প্রকাণ্ড এক ডাবল হেলিক্স স্কাল্পচার। ডান দিকে একটু এগোলেই জিনোম হল বা প্রদর্শনীশালা। তার সামনে এক টুকরো সবুজ। ঘাসের উপরে একটা সিমেন্টের বেদিতে বসে আছেন সহাস্য ওয়াটসন ও ক্রিক। বয়সকালে তখন দুজনে আলাদা আলাদা শহরে থাকতেন। এক বার নিউ ইয়র্কের কাছে কোল্ড স্প্রিং হারবারে দেখা হয় দুজনের। পার্কে দুজনের পাশাপাশি বসে তোলা একটি ছবি আছে। সেটির আদলেই জিনোম হলের সামনে রাখা ওয়াটসন ও ক্রিকের মূর্তি দু’টি তৈরি করা হয়েছিল। পাশেই রাখা তাঁদের তৈরি ডিএন ডাবল হেলিক্সের মডেলটির প্রতিলিপি।
এনআইবিএমজি-র প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী পার্থপ্রতিম মজুমদার জানালেন, ছোটদের মধ্যে জেনেটিক্স-এ উৎসাহ বাড়াতেই এই কর্মকাণ্ড। তাঁর কথায়, ‘‘দেশে বিজ্ঞানচর্চা বাড়লেও জিন নিয়ে গবেষণা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। দেশে জিন-গবেষণায় অগ্রগতির জন্য তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উৎসাহ বাড়াতে হবে। সে কথা মাথায় রেখেই এই প্রদর্শনীশালা তৈরি।’’ তবে এ রকম কিছু যে করা যায়, সেই পরিকল্পনাটা পার্থপ্রতিমবাবুর মাথায় আসে আমেরিকার স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে হিউম্যান জেনেটিক্স বিষয়ক একটি প্রদর্শনী দেখার পরে। সেটি তৈরি করেছেন আমেরিকার ‘ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর ডিরেক্টর এরিক গ্রিন। পরে তিনি এনআইবিএমজি-র জিনোম হলটি ঘুরে দেখেন। বলেছিলেন, ‘‘আমার প্রদর্শনীশালার থেকেও বেশি সুন্দর হয়েছে তোমাদেরটা।’’ প্রতিষ্ঠানের অতিথিদের জন্য রাখা বিশেষ নোটবুকে লিখে গিয়েছেন, ‘স্পেকটাকিউলার’।
জিনোম হলের মূল দরজা খুলতেই নানা আয়োজন। প্রথমেই জিনতত্ত্বের গোড়ার কথা। ডিএনএ কী, তার আকার কেমন, জেনেটিক ম্যাপিং, ক্রোমোজ়োমের অস্বাভাবিকতা থাকলে কী হয়, এমন সব খুঁটিনাটি প্রশ্নের উত্তর। নির্দিষ্ট বোতাম টিপলেই পর্দায় ভেসে উঠছে জবাব। ১৯ মিনিটের একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবিতে দেখানো মানবসভ্যতার গোড়ার কথা ও মানুষের বিবর্তন।
২৩ জোড়া ক্রোমোজ়োম রয়েছে মানবকোষে। প্রতিটি ক্রোমোজ়োমের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একটি ডিসপ্লে বোর্ডে মজাদার উপায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ২২ জোড়া অটোজ়োম এবং বাকি দুই সেক্স ক্রোমোজ়োম (এক্স ও ওয়াই)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। একটা বোর্ডের উপরে অনেকটা পাজ়লের মতো করে এক-এক জোড়া ক্রোমোজ়োম প্লেট ছড়ানো। যেটা সম্পর্কে জানতে চাইবেন, নির্দিষ্ট জায়গায় সেই প্লেটটি রাখলেই ফুটে উঠবে, ওই ক্রোমোজ়োমের স্বভাবচরিত্র। যেমন, এক্স ক্রোমোজ়োম নিয়ে জানতে চাইলেই পর্দায় ভেসে উঠছে, ‘এতে রয়েছে ১৪০০ জিন। ১৫ কোটি বেস পেয়ার।’
অভিনব পদ্ধতিতে দেখানো হয়েছে, জিন-চরিত্রের পরিবর্তনে কী ভাবে বদলে যায় ত্বকের রং। ব্যাপারটা খানিকটা এ রকম, গায়ের চামড়া সাদা না কালো হবে, তার জন্য দায়ী অন্তত ১২০টি জিন। যেমন, SLC24A5 জিনের মাত্র একটি নিউক্লিয়োটাইড বদলে গেলে ১১১তম স্থানে অ্যামিনো অ্যাসিড বদলে যায়। যদি অ্যামিনো অ্যাসিড অ্যালানিন হয়, তা হলে গায়ের রঙ কালো। যেমনটা পশ্চিম আফ্রিকার বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে ঘটে। আবার ওই অ্যামিনো অ্যাসিড যদি থ্রিয়োনাইন হয়, তা হলে সে শ্বেতাঙ্গ হবে। প্রদর্শনীতে হাতেকলমে দেখানো হয়েছে এই বিষয়টি। যন্ত্রের পর্দায় ভেসে উঠছে একটি মেয়ের ছবি। বিশেষ কি-বোর্ডের সাহায্যে থ্রিয়োনাইনকে বদলে অ্যালানিন করে দিলেই শ্বেতাঙ্গ মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে উঠছে।
প্রত্যেক আবিষ্কারের আড়ালে লুকিয়ে আছে রোমাঞ্চকর ইতিহাস। প্রদর্শনীশালার আনাচেকানাচে রয়েছে তার ছোঁয়াও। লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা করছিলেন জিন-বিশেষজ্ঞ অ্যালেক জেফ্রিস। গবেষণার বিষয় ছিল, একই পরিবারে কী ভাবে কোনও অসুখ বয়ে চলে। তাঁর সেই গবেষণাটি ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন তিনি— ‘ডিএনএ ফিংগারপ্রিন্টিং’। মানবকোষ থেকে ডিএনএ নিয়ে তা ফোটোগ্রাফিক ফিল্মে জুড়ে দিয়েছিলেন জেফ্রিস। ফিল্মে কিছু ‘ব্যান্ড’ ভেসে ওঠে। জেফ্রিস টের পান, এ ভাবে যাঁর যাঁর দেহকোষ নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করেছিলেন তিনি, প্রত্যেককে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। জেফ্রিস প্রথম যখন এক বিজ্ঞানসভায় তাঁর আবিষ্কারের কথা বলেছিলেন, অনেকে শুনে হাসেন। কিন্তু পরে তিনিই হয়ে ওঠেন ‘ফাদার অব ডিএনএ ফিংগারপ্রিন্টিং’। তাঁর গবেষণার সাহায্য নিয়ে ব্রিটেনে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বহু শিশুর পিতৃপরিচয় নির্ধারণ করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার সাহায্যে খুনের মামলায় ধরা হয় অপরাধীকেও। এক বার এক জোড়া খুনের মামলায় সন্দিহান হয়ে পড়েছিল পুলিশ। দু’টি মেয়ে লিন্ডা ও ডন খুন হয়। পুলিশের সন্দেহ ছিল একই লোক খুন করেছে। কিন্তু প্রমাণ করতে পারছিল না তারা। জেফ্রিসের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। তিনি মৃতদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ-পরীক্ষা করে দেখিয়ে দেন, একই লোক লিন্ডা ও ডন, দু’জনকেই ধর্ষণ করে খুন করেছে। পরবর্তী কালে এই ‘ডিএনএ ফিংগারপ্রিন্টিং’ পদ্ধতি অনুসরণ করেই ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীকে হত্যার ঘটনায় আত্মঘাতী জঙ্গি তেনমোঝি রাজারত্নম ওরফে ধানুকে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯১ সালের ২১ মে ওই আত্মঘাতী বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ২০টি দেহ। ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা যায় ধানুই সে দিন বিস্ফোরক বেল্ট পরেছিল।
অ্যালেক জেফ্রিসের পাশাপাশি ভারতীয় বিজ্ঞানীদের (হরগোবিন্দ খুরানা, প্রশান্ত মহলানবিশ, ডি ডি কোশাম্বি, এল ডি সাঙ্ঘভি) কৃতিত্বকেও সম্মান জানানো হয়েছে জিনোম হলে। আবার, ক্যানসারের মতো মারণ রোগ ও তার পিছনে জিনের কারসাজি কতটা, এ নিয়ে হ্যারল্ড ভার্মাস-এর মতো বিজ্ঞানীদের ভাবনাচিন্তাও স্থান পেয়েছে। জিনের সামান্যতম ‘খামখেয়ালিপনায়’ কী হতে পারে (ডাউন সিনড্রোম, প্রেডার উইলি সিনড্রোম, লিউকেমিয়া), ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা। সমস্যা যখন আছে, তার সমাধানের পথও আছে। প্রদর্শনীতে আলো ফেলা হয়েছে সেই ভবিষ্যতের গবেষণায়। যেমন, ‘জিন-এডিটিং’। প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কোনও জিন ঘটিত অসুখে জিনের খারাপ অংশটাকে ‘এডিট’ করে (বাদ দিয়ে) সেখানে ভাল অংশ বসিয়ে কঠিন রোগকে বাগে আনা যায় কি?
২৫ ফেব্রুয়ারি ওয়াটসনদের জিন-রহস্য উন্মোচনের ৬৭ বছর পূর্ণ হল। পার্থপ্রতিম মজুমদারের কথায়, ‘‘ওয়াটসন ও ক্রিক যে জীবন-রহস্য উন্মোচন করেছিলেন, সেই ধাঁধারই পরের সূত্র আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছি আমরা।’’