এসআইএনপি-তে বক্তৃতা হ্যারল্ড এলিয়ট ভারমাসের। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
মোক্ষম প্রশ্ন। উত্তরদাতা নোবেলজয়ী ক্যানসার গবেষক হ্যারল্ড এলিয়ট ভারমাস। সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (এসআইএনপি)-এ ৫৪তম মেঘনাদ সাহা স্মৃতি বক্তৃতা দিতে এসে এমনই অভিজ্ঞতা হল ওঁর।
উত্তর কলকাতার এক বাসিন্দা কর্কট রোগের শিকার। তিনি জানেন, মৃত্যু শিয়রে। ক’দিন ধরে কাগজে পড়েছেন কলকাতায় এসেছেন ভারমাস। নানা জায়গায় বক্তৃতা দিতে। মৃত্যুপথযাত্রী ওঁর কাছে জানতে চান, যমের আহ্বান বলে যে রোগের পরিচয়, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষ কতদূর এগোল। রোগীর হয়ে ওই প্রশ্ন নিয়ে এসআইএনপি-তে ভারমাসের মুখোমুখি হলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক প্রতিনিধি। জানালেন, রোগী নিজেই আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অশক্ত তিনি, তাই তাঁর অনুরোধ বয়ে এনেছেন ওই প্রতিনিধি।
অনুরোধ শুনে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ালেন ভারমাস, কর্কট রোগ বিষয়ে যাঁর গবেষণা প্রায় চার দশকের। কী বলবেন তিনি? গত ৫০ বছরে অনেক কিছুই জানা গিয়েছে রোগটি সম্পর্কে, অগ্রগতিও হয়েছে বেশ কিছুটা, কিন্তু ক্যানসার যে এখনও এক অজেয় শত্রু।
আরও পড়ুন: গবেষণার জন্য আন্টার্কটিকা পাড়ি প্রেসিডেন্সির শিক্ষকের
তবু, এক মৃত্যুপথযাত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করা সম্ভব হল না ভারমাসের পক্ষে। সংক্ষেপে বললেন, পৃথিবীব্যাপী গবেষকদের মরণপণ প্রয়াসের কথা, ক্যানসার জয়ের লক্ষ্যে যা ধাবিত। আর, সেলাম জানালেন সেই রোগীকে, মৃত্যু শিয়রে জেনেও যিনি ভেঙে পড়েননি, ছাড়েননি হাল। মোবাইলে ফটো সহযোগে রেকর্ড হল বিজ্ঞানীর বার্তা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি জানালেন, তিনি তা পৌঁছে দেবেন রোগীর কাছে। প্রতিনিধিটি জানতে চাইলেন, রেকর্ড করা বয়ান তিনি একবার দেখে দেবেন কি-না। নোবেলজয়ী অসম্মত। বোঝা গেল, তিনি নিষ্কৃতি চান মর্মবিদারক অভিজ্ঞতা থেকে।
এর পর সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে থিতু হতে যেন একটু সময় নিলেন ভারমাস। একটি মাত্র ওষুধে ক্যানসার নির্মূলের আশা কি নেই? ‘‘নাহ্, সে আশা ধূলিসাৎ হয়েছে আমাদের,’’ বললেন ভারমাস, ‘‘যখন থেকে আমরা বুঝেছি জীবকোষে ক্যানসারের পদক্ষেপ, তখন থেকেই সে আশা মুছে গিয়েছে আমাদের। আমরা জেনেছি, রোগটা একটা নির্দিষ্ট পথে এগোয় না। নানা ভাবে কাবু করে জীবকোষকে। সুতরাং, সব ক্যানসারের চিকিৎসা এক পথে এগোবে কী ভাবে?’’
এসআইএনপি-তে তাঁর বক্তৃতায় ভারমাস ব্যাখ্যা করলেন পরিবেশজনিত ক্যানসার রোগের কথা, ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণে ওই রোগের ব্যাপারও। শুধু ক্যানসার আক্রান্ত কোষকে নিশানা করে চিকিৎসা কিংবা প্রতিষেধক হিসেবে টিকা ব্যবহারের কথাও। জানালেন, এ সব সত্ত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০৩০ খ্রিস্টাব্দে পৌঁছে পৃথিবী জুড়ে কর্কট রোগের প্রকোপ বাড়বে বহু গুণ। সমাধান সত্ত্বেও রোগের প্রকোপ বাড়বে কেন? উত্তরে ভারমাস জানালেন, ক্যানসারের যে সব ক্ষেত্রের চিকিৎসা আবিষ্কৃত হচ্ছে, সে সব রীতিমতো ব্যয়বহুল। ধনী নাগরিক ব্যতীত চিকিৎসার সঙ্কুলান অসম্ভব। এ ছাড়াও আছে রাজনৈতিক বাধা। কোথাও কোথাও আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না রাজনৈতিক প্রতিবাদের চাপে পড়ে। বক্তৃতায় অনেকটা জুড়ে ভারমাস বললেন, বিজ্ঞান গবেষণার সামাজিক বা রাজনৈতিক দিক নিয়ে। ওঁর মতে, জীব বিজ্ঞানের গবেষণায় চারটে পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। (১) একক নয়, দলগত গবেষণা; (২) রাজনৈতিক এবং আর্থিক মদত (‘‘অর্থ বিনা গবেষণা হয় না।’’); (৩) গবেষণাপত্রের খোলাবাজার; (৪) আন্তর্জাতিকতাবাদ (‘‘ট্রাম্প সাহেবের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান শুনলে আমি সিঁটিয়ে যাই।’’)
ট্রাম্প জমানায় আমেরিকায় বিজ্ঞান গবেষণা কি ব্যাহত? উত্তরে ভারমাস বলেন, ‘‘পরিসংখ্যান দিয়ে বলতে পারলে ভাল হত। তার বদলে যা দেখছি, তা-ই বলি। ভিসার কড়াকড়িতে আমেরিকায় এখন মেধা আমদানি কমে গিয়েছে। ব্যাপারটা আমাদের কাছে বিপজ্জনক। গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। ওখানে বিজ্ঞানীরা এখন দারুণ খুশি। আমাকে বললেন, ‘ট্রাম্প এবং ব্রেক্সিট অস্ট্রেলিয়ার কাছে আশীর্বাদ। ওখানে এখন মেধাবী গবেষকদের পাড়ি জমানো দারুণ বেড়েছে।’ ওদের কথা শুনে খুশি হতে পারলাম না।’’
আরও পড়ুন: কামড়ে কান কেটে দেওয়ার অভিযোগ
মোটা মাইনের লোভে এখন মেধাবী ছাত্ররা গবেষণার তুলনায় বহুজাতিক সংস্থায় চাকরির প্রত্যাশী। সমস্যাটা কি কুরে কুরে খাচ্ছে আমেরিকাকেও? ‘‘অবশ্যই,’’ বললেন ভারমাস, ‘‘কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে-গবেষণাগারে এখন অর্থের টান। মেধাবী ছাত্রেরা দেখতে পাচ্ছে চাকরি জোটানো কঠিন। তাই অনন্যোপায় হয়েই তাঁরা কেরিয়ার হিসেবে প্রযুক্তিকে বাছছে। আমার মনে হয় সমস্যার সমাধানে স্নাতকোত্তর স্তরে পঠন-পাঠনের ধারা বদলানো দরকার। গবেষণা করতে গেলে পিএইচডি কেন আবশ্যিক হবে বলতে পারেন?’’