অতি প্রবল বর্ষণে ভয়ঙ্কর হয়ে পশ্চিম হিমালয়ের নদীগুলি।
উষ্ণায়নের জন্য পশ্চিম হিমালয়ের দু’টি নদী ভাগীরথী ও শতদ্রুতে উদ্বেগজনক ভাবে বেড়ে চলেছে অতি-জলপ্রবাহের পরিমাণ। তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না দু’টি নদীর জলধারণ ক্ষমতা। ফলে, ২০১০ থেকে শুরু করে পরের ১০ বছরে একের পর এক ভয়াল বন্যা হয়েছে ওই দু’টি নদীর অববাহিকায়। বেড়েছে হড়কা বানের (‘ফ্ল্যাশ ফ্লাড’) ঘটনা ও প্রাবল্য।
দু’টি নদীতে অতি-জলপ্রবাহের পরিমাণ যে ভাবে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে, তাতে আগামী দিনে আরও ঘন ঘন, আরও ভয়াল বন্যায় প্লাবিত হয়ে যাবে পশ্চিম হিমালয়ে এই দু’টি নদীর অববাহিকা। জাতীয় স্তরে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা এই আশঙ্কাজনক পূর্বাভাস দিয়েছে। দেবপ্রয়াগের পর থেকেই ভাগীরথী হয়ে গিয়েছে গঙ্গা।
গবেষণাটি চালিয়েছে মুম্বইয়ের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি মুম্বই)’ এবং ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হাইড্রোলজি (এনআইএইচ)’। গবেষকদলের নেতৃত্বে রয়েছেন ‘শান্তিস্বরূপ ভাটনগর’ পুরস্কারজয়ী এক বঙ্গসন্তান। মুম্বই আইআইটি-র অধ্যাপক সুবিমল ঘোষ।
গবেষকদল। (উপরে বাঁ দিক থেকে) দিব্যাংশ চুঘ, অমেয় পাঠক, জে ইন্দু ও শরদ জৈন। (নীচে বাঁ দিক থেকে) সঞ্জয় জৈন, এ ডিমরি, দেব নিয়োগী ও সুবিমল ঘোষ।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স’-এ। গবেষকদলে রয়েছেন এনআইএইচ-এর প্রাক্তন অধিকর্তা শরদ জৈন, সঞ্জয় জৈন, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) অধ্যাপক এ ডিমরি এবং পার্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেব নিয়োগী।
আটের দশক থেকেই বেড়েছে অতিবর্ষণের প্রাবল্য
গবেষকরা দেখেছেন, আটের দশকের শুরু থেকেই অতিবর্ষণের (বিজ্ঞানের পরিভাষায়, ‘এক্সট্রিম রেনফল’) ঘটনা ও তার প্রাবল্য দুই-ই অনেক বেড়ে গিয়েছে পশ্চিম হিমালয়ে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পশ্চিম হিমালয়ে অতিবর্ষণের ঘটনা ও তার প্রাবল্য বেড়েছে উদ্বেগজনক ভাবে। দু’টি ঋতুতেই। স্বাভাবিক বর্ষায় (‘সামার মনসুন’), যা মৌসুমি বায়ুর জন্য হয়। এমনকী, শীতের সময়েও, যা পশ্চিমী ঝঞ্ঝার (‘ওয়েস্টার্ন ডিসটার্বেন্স’) জন্য হয়।
এই ঝঞ্ঝাই পশ্চিম হিমালয়ের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে শীতের সময়ে ফের নামায় বর্ষা।
অতিবর্ষণের প্রাবল্য বেশি দক্ষিণ ভারত ও হিমালয়ে
খড়্গপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি খড়্গপুর)’-র সাম্প্রতিক একটি গবেষণা জানাচ্ছে, অতিবর্ষণের প্রাবল্য গোটা ভারতেই আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেলেও, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দক্ষিণ ভারত ও হিমালয়ের পাদদেশে। মূলত, ভারত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে (আফ্রিকার দিকে) সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে।
আরও পড়ুন- পানীয় জলে বিষ মেশায় এই দুই ব্যাকটেরিয়া, হদিশ মিলল এই প্রথম
আরও পড়ুন- বিষে বিষে বিষক্ষয়! ভয়ঙ্কর মানসিক রোগ সারানোর পথ দেখালেন তিন বাঙালি
গবেষকদের পূর্বাভাস, এই শতাব্দীর শেষ ভাগে দক্ষিণ ভারতের দক্ষিণাংশ ও হিমালয়ে অতিবর্ষণের পরিমাণ দিনে গড়ে সাড়ে ১৮ মিলিমিটার বেড়ে যাবে। যার ফলে, দক্ষিণ ভারতের (কেরল, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ডের দক্ষিণ দিক) বহু নদীর অববাহিকা ভয়াল বন্যায় প্লাবিত হয়ে যেতে পারে।
গবেষণাপত্র ও গবেষক ছাত্র মায়াঙ্ক সুমনের সঙ্গে অধ্যাপক রাজীব মাইতি।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার’ গ্রুপের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’-এ। এই গবেষকদলেরও নেতৃত্বে রয়েছেন এক বঙ্গসন্তান। খড়্গপুর আইআইটি-র অধ্যাপক ও জার্মানির ‘হামবোল্ট ফেলো (এক্সপেরিয়েন্স ক্যাটেগরি)’ রাজীব মাইতি।
অতিবর্ষণের সর্বাধিক বৃদ্ধি কাশ্মীর, উত্তরাখণ্ড, উত্তরাঞ্চলে
প্রথমে আসা যাক সুবিমলদের গবেষণায়। ’৮০ থেকে ২০০৩, এই বছরগুলির পরিসংখ্যান বলছে, অতিবর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পশ্চিম হিমালয়ের যে সব এলাকায়, তার মধ্যে অন্যতম জম্মু-কাশ্মীর, উত্তরাখণ্ড ও উত্তরাঞ্চল। ওই তিনটি রাজ্যের প্রায় সব জায়গাতেই অতিবর্ষণের ঘটনা গড়ে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এখনও বেড়ে চলেছে। কোথাও কোথাও এই ঘটনার বৃদ্ধি হয়েছে ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ।
আরও ভয়াল বন্যা হবে ভাগীরথী, শতদ্রুতে
সুবিমলদের গবেষণাপত্র জানাচ্ছে, এই অতিবর্ষণের ঘটনা ও প্রাবল্য আগের এক দশক থেকে গড়ে ১.২৫ গুণ থেকে দেড় গুণ বেড়েছে পশ্চিম হিমালয়ের পাদদেশে অধিকাংশ এলাকায়।
এর ফলে, ১৯৯২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ওই দু’টি নদীতে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গিয়েছে অতি-জলপ্রবাহের (‘এক্সট্রিম স্ট্রিমফ্লো’) ঘটনা। আর সেই ধারা এখনও অব্যাহত। ২০১০ থেকে ২০১৯-এ কম করে ৫টি ভয়াল বন্যা হয়েছে ভাগীরথী ও শতদ্রু নদীর অববাহিকায়।
আরও পড়ুন- সূর্যের করোনায় এই প্রথম হদিশ ‘ক্যাম্পফায়ার’-এর
আরও পড়ুন- নিজের ছোড়া ‘বাণ’ থেকে আমাদের বাঁচায় সূর্যই! দেখালেন মেদিনীপুরের সঞ্চিতা
গবেষকদের পূর্বাভাস, পশ্চিম হিমালয়ে এই ভয়াল বন্যা আরও ঘন ঘন এবং আরও ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে আগামী দিনে।
পশ্চিম হিমালয়ে বাড়ছে হড়কা বান
প্রধান গবেষক মুম্বই আইআইটি-র অধ্যাপক সুবিমল ঘোষ ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে জানিয়েছেন, উষ্ণায়নের দরুন গত তিন দশকে পশ্চিম হিমালয়ে অতিবর্ষণের প্রাবল্য বেড়ে যাওয়ায় ’৯২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ভাগীরথী ও শতদ্রু নদীর অববাহিকায় স্বাভাবিক কারণে বন্যার পাশাপাশি হড়কা বানের ঘটনা ও তার প্রাবল্য আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত তা বেড়ে চলেছে। পশ্চিম হিমালয়ের পার্বত্য এলাকা অত্যন্ত খাড়াই (‘স্টিপ টেরেন’) বলেই বেড়েছে হড়কা বানের ঘটনা ও তার প্রাবল্য।
সৌজন্যে: জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স।
অতি-জলপ্রবাহ অস্বাভাবিক বেড়েছে উত্তরকাশী, অলকানন্দা, মন্দাকিনীতে
মুম্বই আইআইটি এবং এনআইএইচ-এর যৌথ গবেষণা জানাচ্ছে, ১৯৮০ থেকে ১৯৯১-এ ভাগীরথী নদীর অববাহিকায় দেবপ্রয়াগে নদীর অতি-জলপ্রবাহ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে যেখানে ৩টি, সেটাই পরবর্তী ১২ বছরে (’৯২ থেকে ২০০৩) বেড়ে হয়েছে ৬টি। মন্দাকিনীতে সেটা বেড়ে ৩টি থেকে ৮টি হয়েছে। প্রায় আড়াই গুণ। অলকানন্দাতেও ৩টি থেকে বেড়ে হয়েছে ৮টি। প্রায় আড়াই গুণ। এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে উত্তরকাশীতে। সাড়ে ৩ গুণ। ২টি থেকে বে়ড়ে হয়েছে ৭টি।
আরও পড়ুন- পরিচয়ভেদে মস্তিষ্কের নির্দেশে বদলে যায় গলার স্বর, দেখালেন বেহালার ভীষ্মদেব
আরও পড়ুন- অকারণ ভয়ে আর ভুগতে হবে না? পথ দেখালেন দুই বাঙালি
একই ভাবে ওই ১২ বছরে শতদ্রু নদীতেও অতি-জলপ্রবাহের ঘটনা ও পরিমাণ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়েছে। ওই নদীর অববাহিকায় তা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সুনিতে। আড়াই গুণ। সেখানেও শতদ্রু নদীতে অতি-জলপ্রবাহ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘটনার সংখ্যা ৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭। আর রামপুরে সেটা দ্বিগুণের সামান্য কম হয়েছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯১-এ সেখানে এমন ঘটনা ঘটেছিল ৬টি। পরের ১২ বছরে তা বেড়ে ১১টি হয়েছে।
২০১০-২০১৯: ৫টি ভয়াল বন্যা পশ্চিম হিমালয়ে
সুবিমলের বক্তব্য, এই প্রবণতা একই রকম রয়েছে পরবর্তী সময়েও। তার ফলে, পশ্চিম হিমালয়ে ভাগীরথী ও শতদ্রু নদীর অববাহিকায় ২০১০ থেকে ২০১৯, এই ১০ বছরে ভয়াল বন্যা হয়েছে কম করে ৫টি। ২০১০-এ পাকিস্তানে। ২০১৩-য় উত্তরাখণ্ডে। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে যথাক্রমে কাশ্মীর ও নেপালে। ২০১৯-এ আবার কাশ্মীরে।
তবে সুবিমলদের গবেষণার পুরোটাই ’৮০ থেকে ২০০৩, এই আড়াই দশকের তথ্য, পরিসংখ্যান ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। আগামী দিনেও এই ধারা বজায় থাকবে কি না, নিখুঁত ভাবে তার পূর্বাভাস দিতে গেলে প্রয়োজন অতীতের তথ্যাদি ও বিভিন্ন চালু মডেলের ভিত্তিতে কম্পিউটার সিম্যুলেশন। সুবিমলরা সেই কম্পিউটার সিম্যুলেশনের কাজটা করেননি।
শতাব্দীর শেষে অতিবর্ষণ বাড়বে দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৮ মিমি
সেটা করেছেন খড়্গপুর আইআইটি-র অধ্যাপক রাজীব মাইতি ও তাঁর এক গবেষক ছাত্র মায়াঙ্ক সুমন। তাঁরা ১৯৬০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ এবং ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পূর্বাভাস দিয়েছেন, এই ধারা বজায় থাকবে। গোটা ভারতেই বাড়বে অতিবর্ষণের প্রাবল্য। আর সেটা বেশি বাড়বে দক্ষিণ ভারত ও গোটা হিমালয়েরই পাদদেশে। যার ফলে, এই শতাব্দীর শেষ ভাগে (২০৭১ থেকে ২১০০) পৌঁছে ভারতের এই দু’টি প্রান্তে অতিবর্ষণের পরিমাণ দিনে গড়ে সাড়ে ১৮ মিলিমিটার (মিমি) বেড়ে যাবে।
কেন বাড়ছে অতিবর্ষণের প্রাবল্য?
রাজীব বলছেন, ‘‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, এটা হচ্ছে মূলত, ভারত মহাসাগরের বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্রপৃষ্ঠের মধ্যে ঘটে চলা পরিচলনের (‘অ্যাটমস্ফেরিক সার্কুলেশান’ বা ‘ইন্ডিয়ান ওশ্ন ডাইপোল’) পরিবর্তনের জন্য।’’
খুব সহজে বলতে গেলে, পরিচলন আদতে সেই প্রক্রিয়া, যার জন্য মাটি তেতে উঠলে বায়ুমণ্ডলও গরম হয়ে ওঠে।
সৌজন্যে: সায়েন্টিফিক রিপোর্টস।
রাজীবের কথায়, ‘‘১৯৬০ থেকে ২০০৫, এই ৪৫ বছরের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, ভারত মহাসাগরের পূর্ব দিক (ইন্দোনেশিয়ার দিকে) থেকে মহাসাগরের পশ্চিম দিকে (আফ্রিকার দিকে) সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা-বৃদ্ধির ঘটনা বেশি ঘটছে। তার ফলে, ওই এলাকায় আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে জলীয় বাষ্পের জন্ম হচ্ছে। অনেক বেশি পরিমাণে মেঘ জমছে। এটাই দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুকে আরও শক্তিশালী করে তুলে দক্ষিণ ভারতে অতিবর্ষণের প্রাবল্য বাড়িয়ে তুলছে। এ ছাড়াও হিমালয়ে ধাক্কা খেয়ে সেই বায়ু হিমালয়ের পাদদেশে অতিবর্ষণের প্রাবল্য বাড়াচ্ছে। তুলনায় উত্তর ভারতের সমতলভূমিতে অতিবর্ষণের প্রাবল্য ততটা দেখা যাচ্ছে না।’’
যেটা যথেষ্টই উদ্বেগের, তা হল; দু’টি স্বীকৃত গবেষণাপত্রই সামনের দিনগুলিতে হিমালয় ও প্রায় গোটা দক্ষিণ ভারতেই আরও ঘন ঘন, আরও ভয়াল বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
গ্রাফিক তথ্য সৌজন্যে: জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স ও সায়েন্টিফিক রিপোর্টস।