এমন কোনও সুপার হিউম্যান? -ফাইল ছবি।
ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না কোথাও ‘সুপার হিউম্যান’দের দেখা পেতে আর বোধহয় আমাদের অপেক্ষা করতে হবে না বেশি দিন! হাতড়ে বেড়াতে হবে না জমাট অন্ধকারে! জন্ম হল প্রাণ-সৃষ্টির মূল উপাদানের মতোই সম্পূর্ণ নতুন ধরনের আরও একটি অণুর। যার নাম- ‘হাচিমোজি’। জাপানি শব্দ।
এর আগে এই ধরনের অণুর হদিশ মেলেনি পৃথিবীতে। খোঁজ মেলেনি ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও। না, আমরা এখন যেমন কল্পনায় ছবি আঁকি ভিনগ্রহীদের, সেই গা ছমছমে, ভয় দেখানো চেহারা নয় সেই সব প্রাণীর। তাঁদের মগজ, শারীরিক গঠন, চিন্তাভাবনা কোনওটাই আমাদের মতো নয়। তাঁরা সবাই অন্য রকমের মানুষ। হয়তো বা তাঁরা অতিমানব। আক্ষরিক অর্থেই।
এই অণুর হাতেই ‘সুপার হিউম্যানে’র জিয়নকাঠি!
নাসার অর্থসাহায্যে চলা গবেষণা জানাল, এই সদ্য আবিষ্কৃত অণুর হাতেই রয়েছে নতুন রকমের প্রাণের জিয়নকাঠি। যা এখনও নজরে পড়েনি ঠিকই। কিন্তু সেই জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না কোথাও সেই প্রাণের জন্ম হয়তো অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে।
গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স’-এর হালের সংখ্যায়। গত সপ্তাহে। সেই আন্তর্জাতিক গবেষকদলের নেতৃত্বে রয়েছেন ফ্লোরিডার আলাচুয়ায় ফাউন্ডেশন ফর অ্যাপ্লায়েড মলিকিউলার এভোলিউশন-এর স্টিভেন বেন্নার। রয়েছেন মিশিগানে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএনএ বিশেষজ্ঞ অনাবাসী ভারতীয় অধ্যাপক কুমার রঙ্গনাথনও।
ভিন গ্রহে কেউ কি সেই প্রাণকে আরও উন্নত করেছে?
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-এর অ্যাস্ট্রোকেমিস্ট্রি ও অ্যাস্ট্রোবায়োলজির বিভাগীয় প্রধান অঙ্কন দাস বলছেন, ‘‘কোটি কোটি বছরের পরিক্রমায় সেই প্রাণ হয়তো আরও উন্নত হয়ে গিয়েছে। বা আমাদের মতোই কোনও জীব হয়তো কোনও সুদূর অতীতে কৃত্রিম ভাবে সেই প্রাণ সৃষ্টি করেছিল। যা আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি উন্নত। তা হতে পারে উন্নততর মানুষ বা ‘সুপার হিউম্যান’। বা হতে পারে উন্নততর প্রাণী, উন্নততর উদ্ভিদও।’’
ডিএনএ অণুর চেহারা
কী ভাবে জন্ম হল প্রাণের?
এককোষী থেকে শুরু করে অণুজীব, প্রাণী ও উদ্ভিদ, পৃথিবীতে যত রকমের প্রাণের হদিশ মিলেছে এখনও পর্যন্ত তার জিয়নকাঠি ধরা রয়েছে বিশেষ একটি অণুর হাতে। যার নাম- ‘ডিঅক্সি-রাইবোনিউক্লিক’ অ্যাসিড বা ‘ডিএনএ’। ওই একটি অণুর হাতেই লুকিয়ে রয়েছে প্রাণ সৃষ্টির যাবতীয় ম্যাজিক। এখন অপরাধীদের ধরতে যার নমুনা পরীক্ষার চল হয়েছে বিশ্ব জুড়ে।
যে ভাবে ডিএনএ থেকে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে, দেখুন ভিডিয়ো
ডিএনএ অণুই তার নানা রকমের কায়দা-কসরৎ দিয়ে, তার শরীরকে নানা রকম ভাবে বাঁকিয়েচুরিয়ে অন্তত ২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিডের জন্ম দিয়েছে। যার থেকে তৈরি হয়েছে হাজার হাজার প্রোটিন। সেই সবক’টি প্রোটিনেই রয়েছে ২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিড। বিভিন্ন পরিমাণে, নানা রকমের মিশেলে। নানা রকমের চেহারা ও আচরণে।
সাকুল্যে সেই ২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিডের নানা রকমের চেহারা ও চরিত্র, নানা ধরনের আচার, আচরণের জন্যই পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রাণের জন্ম হয়েছে গত ৩৭০/৪০০ কোটি বছর ধরে, হয়ে চলেছে। হবে আগামী দিনেও। প্রাণের যতই বৈচিত্র থাক, সব প্রাণেরই জন্ম হয়েছে ওই ডিএনএ-রই জিয়নকাঠিতে।
প্রাণ সৃষ্টির সব ছক জানে ডিএনএ!
কী ভাবে কোন ধরনের প্রাণ সৃষ্টি হবে পৃথিবীতে তার সব চিন্তাভাবনা আগে থেকে করে রাখে ডিএনএই। ছকে রাখে সেই প্রাণ সৃষ্টির গতিপথ। সেই ঠিক করে কোন কায়দা-কসরতের মাধ্যমে তার দেহ কতটা বাঁকিয়েচুরিয়ে সে কোন ধরনের প্রোটিন তৈরি করবে। জন্ম দেবে আরও নানা রকমের অণু, পরমাণুর। জন্ম দেবে এককোষী প্রাণী বা উদ্ভিদের নাকি বহুকোষী জীবের।
যে ভাবে ৫ গুণ বেড়ে যায় প্রাণ-সৃষ্টির বর্ণমালা...
ডিএনএ-র চেহারা, ছবিটা বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে। যার দু’টি হাত। আর সেই হাতগুলি রয়েছে একে অন্যকে পেঁচিয়ে। স্ক্রুয়ের গায়ের প্যাঁচের মতো। এত দিন বিজ্ঞানীরা জানতেন, ডিএনএ অণুর শরীর গড়ে তোলে চারটি জিনিস। যাদের নাম- অ্যাডেনাইন (এ), সাইটোসাইন (সি), গুয়ানাইন (জি) এবং থায়ামাইন (টি)। তাদের হাতে হাত মিলিয়ে দেয়, ধরে রাখে হাইড্রোজেনের বন্ধন।
যে ভাবে জীবনের বর্ণমালা গড়ে ওঠে ডিএনএ-র শরীরে মাত্র চারটি অক্ষরে। ‘এ’, ‘সি’, ‘জি’ এবং ‘টি’।
মিশিগান থেকে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএনএ বিশেষজ্ঞ অনাবাসী ভারতীয় অধ্যাপক কুমার রঙ্গনাথন ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে টেলিফোনে জানিয়েছেন, এত দিন জানা ছিল, ডিএনএ-র শরীর গড়ে তোলে প্রাণ সৃষ্টির বর্ণমালার চারটি অক্ষর। এ, সি, জি, টি। যার মানে, প্রাণ সৃষ্টির বর্ণমালাটা শুরু হয় মাত্র চারটি অক্ষর (লেটার) দিয়ে। তার চেয়ে একটা কমও হতে পারে না। বেশিও সম্ভব নয়। প্রাণের টানে বর্ণমালার সেই চারটি অক্ষরই পাঁচ গুণ বেড়ে গিয়ে হয়ে যায় ২০। নিজেদের মধ্যে নানা রকমের কায়দা-কসরতের মাধ্যমে গড়ে তোলে ২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিড। দেখুন, প্রাণ তৈরি করতে হবে, সেই জরুরি বার্তাটা কী দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়ল ডিএনএ থেকে আরএনএ হয়ে ২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিডে। যেন ‘দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’!
ধারণাটা এ বার বদলাতে হবে
রঙ্গনাথনের কথায়, ‘‘আমাদের গবেষণা জানাল, ধারণাটা এ বার বদলাতে হবে। ডিএনএ অণুর মতোই আরও একটি অণুর অস্তিত্ব সম্ভব। তেমন অণুও বানানো যায়, যেখানে চারটি নয়, আটটি জিনিস দিয়ে গড়ে উঠছে ডিএনএ-র শরীর। তাদের সংক্ষিপ্ত নামগুলি হল, পি, বি, এস এবং জেড। এর নাম আমরা দিয়েছি, ‘হাচিমোজি’। একটি জাপানি শব্দ। ‘হাচি’ মানে, আট। আর ‘মোজি’ মানে, অক্ষর।’’
কোন জাদুতে ধারণা বদলে দেবে নতুন ‘ডিএনএ’?
অঙ্কন বলছেন, ‘‘এর ফলে, প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব হয় যাদের কায়দা-কসরতে, ডিএনএ-র মধ্যে সেই ‘কারিগর’দের সংখ্যাটা ৪ থেকে বেড়ে হয়ে গেল ৮। ডিএনএ-র ৪টি কারিগরই যদি ২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিডের জন্ম দিতে পারে, তা হলে তার আরও ৪টি নতুন কারিগর তো জন্ম দেবে আরও নতুন নতুন অ্যামাইনো অ্যাসিডের। তার ফলে, তৈরি হবে নতুন নতুন রকমের প্রাণ। আর সেটা হলে আমাদের চেয়ে আরও অনেক বেশি উন্নত প্রাণের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’’
আরও পড়ুন- বাঙালি কন্যার চোখে মঙ্গল আর চাঁদে প্রাণ খুঁজবে নাসা
আরও পড়ুন- গত ২০ বছরে আরও সবুজ হয়েছে বিশ্ব, নেতৃত্বে ভারত-চিন, বলছে নাসা
রঙ্গনাথনের বক্তব্য, এই ধরনের অণু দিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রাণের জন্ম হয়নি পৃথিবীতে। তা সে প্রাণীজগতই হোক বা উদ্ভিদজগত। ভিন গ্রহের অচেনা, অজানা মুলুকে এই রকমের প্রাণের খোঁজতল্লাশও হয়নি। কারণ, আমাদের জানাই ছিল না, এমন ধরনের প্রাণ আদৌ সৃষ্টি হতে পারে ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না কোথাও। যা এ বার সম্ভব হল গবেষণাগারে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা বিশেষ একটি অবস্থায়। তবে স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রায় এখনও পর্যন্ত ডিএনএ-র মতো ওই নতুন ধরনের অণুর দেখা মেলেনি।
এই সেই নতুন ধরনের ডিএনএ ‘হাচিমোজি’।
যে ভাবে প্রাণ সৃষ্টির বার্তা ‘রটে যায় দ্রুত’!
২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিড, হাজার হাজার প্রোটিন বা অন্য রকমের অণু অথবা নানা রকমের কোটি কোটি কোষ বানানোর জন্য আর একটি অণুকে খুব জরুরি কিছু তথ্য বা ইনফর্মেশন দিতে হয় ডিএনএ-কে। নির্দেশ দিতে হয়। সেই অণুর নাম- ‘রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড’ বা ‘আরএনএ’। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই পদ্ধতির নাম- ‘ট্রান্সস্ক্রিপশন’।
আলাপ-আলোচনা বা নির্দেশের জন্য আমাদের যেমন ভাষা লাগে, তেমনই ডিএনএ-রও লাগে ‘নির্দেশ দেওয়া’র ভাষা। আরএনএ-র জন্য।
ডিএনএ সেই কাজটা করে তার শরীর গড়ে তোলার চারটি উপাদান, অ্যাডেনাইন, সাইটোসাইন, গুয়ানাইন এবং থায়ামাইন দিয়ে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাদের বলা হয়, ‘নিউক্লিওটাইড্স’ বা ‘নিউক্লিওবেসেস’। তারাই আরএনএ-কে গোপনে বলে আসে প্রাণটা কী ভাবে তৈরি করতে হবে। সেটা গাছ হবে নাকি মানুষ। সেই গোপন বার্তা পাওয়ার পরেই তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য উঠেপড়ে লাগে আরএনএ। তাদের মধ্যেই কিছু কিছু আরএনএ হয়ে ওঠে ‘বার্তাবাহক’। তাই ওই আরএনএ গুলিকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’।
ভবিষ্যৎ কী? ব্যবহারের সম্ভাবনা কোথায়?
অঙ্কন বলছেন, ‘‘এই নতুন অণুটা বানানো হয়েছে গবেষণাগারের কৃত্রিম পরিবেশে। সেখানে ঘরের স্বাভাবিক চাপ নেই। তাপমাত্রাও ঘরের মতো নয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে আসারও সুয়োগ পায়নি সেই নতুন অণু। তাই গবেষকদের প্রথম কাজ হবে, ঘরের স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রাতেও সেই অণুর জন্ম দেওয়া যায় কি না বা তাকে দীর্ঘ সময় বাঁচিয়ে রাখা যা কি না, তা দেখা। তা ছাড়া নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণাতেও খুব কাজে লাগবে এই নতুন অণু।’’
ছবি সৌজন্যে: নাসা
ভিডিয়ো সৌজন্যে: ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন, আমেরিকা