Science

চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছেও সারতে পারে স্তন ক্যানসার!

তারা ছিল ঘরশত্রু ‘বিভীষণ’! কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তাদেরই কেউ কেউ হয়ে উঠতে পারে পরিত্রাতা ‘রাম’ও! যারা ক্যানসারের ‘রাবণে’র হাতে ‘সীতা হরণে’র পরেও ‘সীতা’কে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে ‘রাম-রাজ্যে’! এমনকী, তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে (আলটিমেট স্টেজেস) পৌঁছে যাওয়া স্তন ক্যানসারও সারিয়ে ফেলার পথ দেখাতে পারে, কেমোথেরাপিউটিক ট্রিটমেন্টের হাতিয়ারকে আরও ধারালো, আরও জোরালো করে তুলে। যার ফলে, আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে কেমোথেরাপি। যা একাধারে হবে কেমোথেরাপি আবার ইমিউনোথেরাপিও।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১২:০০
Share:

তারা ছিল ঘরশত্রু ‘বিভীষণ’!

Advertisement

তারা আমাদের ‘ঘর’ বলতে শরীরেই থাকত, গড়ে উঠত, বেড়ে উঠত আর শরীরে স্তন ক্যানসারের বাসা বাঁধা থেকে শুরু করে তার বাড়-বৃদ্ধিতে অকৃপণ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত, গোপনে, আড়ালে-আবডালে।

‘যার খাচ্ছি, যার পরছি, তাকেই মারছি’- এই ‘মন্ত্রে’ই চলত আমাদের শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থার (ইমিউন সিস্টেম) কিছু কিছু কোষ, কলা।

Advertisement

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তাদেরই কেউ কেউ হয়ে উঠতে পারে পরিত্রাতা ‘রাম’ও! যারা ক্যানসারের ‘রাবণে’র হাতে ‘সীতা হরণে’র পরেও ‘সীতা’কে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে ‘রাম-রাজ্যে’!

এমনকী, তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে (আলটিমেট স্টেজেস) পৌঁছে যাওয়া স্তন ক্যানসারও সারিয়ে ফেলার পথ দেখাতে পারে, কেমোথেরাপিউটিক ট্রিটমেন্টের হাতিয়ারকে আরও ধারালো, আরও জোরালো করে তুলে। যার ফলে, আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে কেমোথেরাপি। যা একাধারে হবে কেমোথেরাপি আবার ইমিউনোথেরাপিও।


স্তনগ্রন্থির বিভিন্ন অংশ

এটাকে আমাদের শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থার দ্বিচারিতা বলতে পারেন। আর অন্তত এই ‘দ্বিচারিতা’কে সাধুবাদও জানাতে পারেন, ক্যানসার চিকিৎসায় আগামী দিনে জোরালো হাতিয়ার হয়ে ওঠার রাস্তা দেখিয়েছে বলে!

রীতিমতো নজরকাড়া এই আবিষ্কারটি করেছেন আমস্টারডামের ‘নেদারল্যান্ডস ক্যানসার ইনস্টিটিউট’-এর সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কেলি কার্স্টেন। তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায়।

স্তন ক্যানসার কতটা ভয়াবহ?


মহিলাদের কোন ক্যানসার কতটা ভয়াবহ (হার)

মহিলাদের মোটামুটি যে ৯ ধরনের ক্যানসারে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়, তার মধ্যে একেবারে শীর্ষে রয়েছে স্তন ক্যানসার। বিশ্বে অন্যান্য ক্যানসারে মহিলাদের আক্রান্ত হওয়ার হার যেখানে ১.৫ শতাংশ থেকে ৬.১ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, সেখানে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার গড়ে ৩০.৮ শতাংশ। মানে, ৫ গুণেরও বেশি! আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (‘হু’) পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, সবক’টি মহাদেশে মহিলাদের মৃত্যুর কারণ হয় যে সব রোগ, তার তালিকায় প্রথম তিনটি প্রাণঘাতী অসুখের একটি- স্তন ক্যানসার! হ্যাঁ, ক্যানসারের টার্গেটেড থেরাপি (ওষুধ) ও কেমোথেরাপির যথেষ্ট উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও।

হালের গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?

স্তন ক্যানসারের বাড়-বৃদ্ধিতে যে গোপনে, আড়ালে-আবডালে কলকাঠি নাড়ে শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থার কোষ, কলাগুলি, তা কিন্তু বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু, তারা কলকাঠিটা কী ভাবে নাড়ে, কী ভাবে দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থার ‘বিভীষণ’ কোষ, কলাগুলিই টিউমারকে বাড়তে, ছড়িয়ে পড়তে সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দেয়, তা এত দিন বোঝা যাচ্ছিল না।

হালের গবেষণা কী কী দেখিয়েছে?



আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে আমস্টারডাম থেকে ‘নেদারল্যান্ডস ক্যানসার ইনস্টিটিউট’-এর সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কেলি কার্স্টেন ই-মেলে যা লিখেছেন, খুব সহজ ভাবে তার নির্যাসটুকু তুলে ধরলে দাঁড়ায় এটাই- যে ইঁদুরগুলি ওই ক্যানসারের তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, তাদের ওপরেই পরীক্ষাটা করা হয়েছিল। মানুষের ক্ষেত্রে যাকে বলে, ‘মেটাস্টাসাইজিং ব্রেস্ট’। গবেষকরা দেখেছেন, টিউমার হওয়ার পরেই তা শরীরে এক রকমের সংক্রমণের জন্ম দেয়। আর সেই সংক্রমণ খুব দ্রুত হারে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যা আদতে মেটাস্টাসিসের গতি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আর এখানেই ‘বিভীষণে’র ভূমিকাটা নেয় আমাদের শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থার কোষ। কলাগুলি। যে ভাবে রাবণ ভিক্ষুকের বেশে এসে সীতাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল, অনেকটা সেই ভাবেই দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থার কোষগুলি আমাদের ধোঁকা দিয়ে, ছলনা করে গোপনে সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দেয় মেটাস্টাসিসের দিকে, যাতে তা আরও দ্রুত হারে আর অনেক বেশি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থার ওই ‘বিভীষণ’ কোষগুলির নাম- নিউট্রোফিল। প্রাথমিক ভাবে টিউমার হওয়ার পর যে সংক্রমণ হয় শরীরে, সেই সংক্রমণই জন্ম দেয় নিউট্রোফিলের। সেই নিউট্রোফিলগুলি তার পর জড়ো হতে থাকে। জোট বাঁধতে থাকে। দল গড়তে থাকে। দলে-উপদলে বাড়তে থাকে। ছড়িয়ে পড়তে থাকে।’’

শত্রু নিউট্রোফিলগুলি কী ভাবে স্তন ক্যানসারের বন্ধু হয়ে ওঠে?

নেদারল্যান্ডস ক্যানসার ইনস্টিটিউট’-এর সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কেলি কার্স্টেন ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘এটা আমাদের আগেই জানা ছিল, দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থার মধ্যে যে টি-সেলগুলি থাকে, সেগুলি ক্যানসার রুখতে (এমনকী, স্তন ক্যানসারও) বড় ভূমিকা নেয়। তারাই টিউমারের বাড়-বৃদ্ধির ‘রথে’র রশি টেনে ধরে! আমরা দেখেছি, নিউট্রোফিল সেটা জানে। আর জানে বলেই নিউট্রোফিলের মূল টার্গেট হয়ে ওঠে টি-সেলগুলি। টি-সেলগুলিকে অকেজো, ‘নিষ্কর্মার ঢেঁকি’ বানিয়ে দেয় নিউট্রোফিলগুলি। ফলে, টিউমারগুলি গায়ে-গতরে আর সংখ্যায় বাড়তে পারে খুব তাড়াতাড়ি। খুব দ্রুত হারে। এলাকা নির্বিশেষে। নিউট্রোফিলগুলিকে দিয়ে এই ‘বদমায়েশি’টা করিয়ে নেয় দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থার ‘ডোমিনো এফেক্ট’। সেই ‘ডোমিনো এফেক্টে’র যাবতীয় শয়তানির ধাপগুলি আমরা খুঁজে বের করতে পেরেছি। আর তার মাধ্যমে টিউমার নিকেশ করার কাজকর্মও শুরু হয়ে গিয়েছে। ফুসফুস ও চামড়ার ক্যানসারের ক্ষেত্রে। তবে স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে তা এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। আমরা ইঁদুরের ওপর ওই ইমিউনোথেরাপির সঙ্গে কেমোথেরাপিকে মিলিয়ে-মিশিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি, তা স্তন ক্যানসারের ‘রথে’র চাকায় লাগাম পরাতে পারছে। আমরা এটাকে বলছি, কেমো-ইমিউনোথেরাপি। এখনও হিউম্যান ট্রায়াল বা মানুষের ওপর পরীক্ষা চালানোর কাজটা শেষ হয়নি। তবে গবেষণায় আমি যে ইঙ্গিত পেয়েছি, তাতে বলতে পারি, এটা মানুষের ওপরেও সফল হওয়ার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ। ক্লিনিক্যাল টেস্ট বা মানুষের ওপর পরীক্ষার কাজটা শুরু হয়েছে নেদারল্যান্ডস ক্যানসার ইনস্টিটিউটে। স্তন ক্যানসারের যে রোগীদের কেমোথেরাপি করানো হচ্ছে, তাদের ওপরেই পরীক্ষাটা চালানো হচ্ছে।’’


স্তন ক্যানসারের কোষগুলি

কী বলছেন কলকাতার বিশিষ্ট অঙ্কোলজিস্টরা?


(বাঁ দিকে) মূল গবেষক কেলি কার্স্টেন। কলকাতার দুই অঙ্কোলজিস্ট। গৌতম মুখোপাধ্যায় ও সোমনাথ সরকার

শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এটা একটা অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং গবেষণা। আমরা স্তন ক্যানসারের বেশির ভাগ রোগীকেই পাই একেবারে আলটিমেট স্টেজে। যখন কেমোথেরাপি আর বিশেষ কাজে দেয় না। এই গবেষণা যদি মানুষের ওপর চালানো পরীক্ষাতেও ১০০ শতাংশ সফল হয়, তা হলে তা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। কারণ, শুধু প্রাথমিক পর্যায়েই নয়, স্তন ক্যানসারের একেবারে ‘আলটিমেট স্টেজে’ও এই কেমো-ইমিউনোথেরাপি আমাদের হাতে অনেক জোরালো ও ধারালো হাতিয়ার তুলে দেবে টিউমারের টুঁটি টিপে ধরার জন্য।’’

আরও পড়ুন: অ্যাসপিরিনেই কাবু হতে পারে ক্যানসার! পথ দেখালেন ২ ভারতীয়

কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের অঙ্কোলজিস্ট সোমনাথ সরকারের কথায়, ‘‘ইমিউনোথেরাপি চামড়া ও আরও কয়েকটি ক্যানসারের ক্ষেত্রে কাজ করে শুধুই প্রাথমিক পর্যায়ে। আর কেমোথেরাপি করে দেহের প্রতিরোধী কোষ গ্র্যানিউলোসাইটসের কার্যকরী ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করি আমরা। সাম্প্রতিক গবেষণা যদি মানুষের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে পুরোপুরি সফল হয়, তা হলে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তা একটি মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়াবে।’’

ছবি সৌজন্য: নেদারল্যান্ডস ক্যানসার ইনস্টিটিউট, আমস্টারডাম

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement