শনি গ্রহ আর তার সেই ভযঙ্কর সুন্দর বলয়।
আজ, বৃহস্পতিবারের বারবেলায় শনির বলয়ে মরণ-ঝাঁপ দেবে ‘ক্যাসিনি’!
বলয়ের ‘সুদর্শন চক্রে’ ধীরে ধীরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে ক্যাসিনি’র শরীর! তার পর আগামী বছর তা তলিয়ে যাবে শনি গ্রহের অতল আহ্বানে।
এই প্রথম কোনও মহাকাশযান ‘ঝাঁপ’ দেবে শনির বলয়ে। ঢুকে পড়বে শনির ২০টি বলয়ের মধ্যে সবচেয়ে বাইরের বলয়টির ‘আন্তরিক টানের’ (অভিকর্ষ বল) চৌহদ্দিতে। নিজের শরীরের অংশ থেকে যাকে ছিঁড়ে ‘ক্যাসিনি’ ছুঁড়ে ফেলে নামিয়ে দিয়েছিল শনির অন্যতম চাঁদ ‘টাইটান’-এ, সেই তার দোসর মহাকাশযান ‘হাইগেন্স’কে ‘তুই ভাল থাকিস’ বলে শনির চাঁদে রেখেই আজ শনির বলয়ে ‘সুইসাইডাল জাম্প’ দিচ্ছে ‘ক্যাসিনি’। নিজেকে ‘শেষ’ করে দেওয়ার আগে শনির বলয়গুলিকে খুব কাছ থেকে দেখার ছবি আর তথ্যাদি ‘ক্যাসিনি’ একের পর এক পাঠিয়ে যাবে নাসার গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুমে। শনির বলয়গুলিকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ এর আগে পায়নি কোনও মহাকাশযান। ফলে, কোনও মহাকাশযানই এর আগে এত কাছ থেকে শনির বলয়গুলির ছবি তোলারও পায়নি কোনও সুযোগ। তাই শনির বলয়ে ‘ক্যাসিনি’র ঐতিহাসিক মরণ-ঝাঁপ দেখার জন্য নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি, ইসরোর মতো বিশ্বের প্রথম সারির মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলি তো অধীর অপেক্ষায় রয়েছেনই, শনির বলয় সম্পর্কে নতুন-নতুন ছবি আর চমকে দেওয়ার মতো হাতেগরম তথ্যাদি পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ প্রতীক্ষায় রয়েছেন বিশ্বের তাবৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
শনির বলয়ে মরণঝাঁপের প্রস্তুতি ‘ক্যাসিনি’র। দেখুন ভিডিও।
দেখুন শনির বিভিন্ন বলয়...
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ বা ‘এসা’) বানানো ‘ল্যান্ডার’ মহাকাশযান ‘হাইগেন্স’-এর হাত ধরে নাসার ‘অরবিটার’ মহাকাশযান ‘ক্যাসিনি’ শনির বহু দূরের কক্ষপথে ঢুকে পড়েছিল সেই কবে- ১২ বছর আগে। ২০০৫ সালের ১৪ জানুয়ারি নিজের শরীরের অংশ ছিঁড়ে ‘ল্যান্ডার’ মহাকাশযান ‘হাইগেন্স’কে শনির চাঁদ ‘টাইটান’-এ নামিয়ে দিয়েছিল ‘ক্যাসিনি’। ২০০৪ সালের পয়লা জুলাই। ‘ক্যাসিনি-হাইগেন্স’-এর আগে আরও তিন-তিনটি মহাকাশযান শনির পাশ কাটিয়ে ঘুরে ও বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভয়ঙ্কর সুন্দর বলয়ের ঘেরাটোপে নিজেকে এই সৌরমণ্ডলে ‘স্বতন্ত্র’ করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা শনি এতটাই ‘সম্ভ্রম-সমীহ’ আদায় করে নিতে পেরেছিল আমাদের কাছে থেকে যে হুট করে ‘গ্রহরাজ’-এর ‘ঘরে’ (কক্ষপথ) ঢুকে পড়ার সাহসে কুলোয়নি কোনও মহাকাশযানের! শনির কক্ষপথে প্রথম ‘পা’ দেওয়ার সাহসটা দেখিয়েছিল ‘ক্যাসিনি-হাইগেন্স’ মহাকাশযানই। আজ থেকে ১২ বছর আগে।
২০০৪-এর জুলাই। শনির কক্ষপথে ঢোকার পর ‘ক্যাসিনি-হাইগেন্স’ মহাকাশযান
তার আগে শনির কক্ষপথে পৌঁছতেও তো কম সময় লাগেনি ‘ক্যাসিনি-হাইগেন্স’-এর। পৃথিবী থেকে ‘জয় গুরু শনি’ বলে ‘ক্যাসিনি-হাইগেন্স’ রওনা দিয়েছিল সেই ১৯৯৭ সালে। তার পর পৃথিবীর ‘মায়াজাল’ (অভিকর্ষ বল) কাটিয়ে, শুক্র আর বৃহস্পতির পাশ কাটিয়ে (মঙ্গলকে অনেক অনেক দূর থেকে দেখতে দেখতে) সাত বছর ধরে একটানা মহাকাশে দৌড়ে শনির কক্ষপথে ‘ক্যাসিনি-হাইগেন্স’ পৌঁছেছিল ২০০৪ সালে। তার পর শনির একের পর এক চাঁদের কাছাকাছি গিয়েছে, তাদের কক্ষপথে পাক মেরেছে ‘ক্যাসিনি-হাইগেন্স’। করেছে অনেক নতুন নতুন আবিষ্কার। হদিশ পেয়েছে শনির চাঁদ ‘এনসেলাডাস’-এর অন্তরে-অন্দরে গভীর সমুদ্রের। খুঁজে পেয়েছে শনির অন্য চাঁদ ‘টাইটান’-এর অন্দরে লুকিয়ে থাকা তরল মিথেনে ভরা সমুদ্রেরও।
২০০৫। শনির চাঁদ ‘টাইটান’-এ নামানো হল ‘ল্যান্ডার’ মহাকাশযান ‘হাইগেন্স’। ‘ক্যাসিনি’র সঙ্গে ‘ছাড়াছাড়ি’ হল ‘হাইগেন্স’-এর!
এই মরণ-ঝাঁপ সম্পর্কে কী বলছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা?
শনির ‘রিং-গ্রেজিং অরবিটে’ এ বার যে ভাবে চক্কর মারবে ‘ক্যাসিনি’ (হলদেটে কমলা)
আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ই-মেলে আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, ‘’৩০ নভেম্বর (ভারতীয় সময়ে আজ থেকে) থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত শনির দুই মেরুর ওপরে চক্কর মারবে ‘ক্যাসিনি’। তার মধ্যে সাত দিন অন্তর প্রায় বার কুড়ি শনির বলয়গুলিকে ‘বুড়িছোঁয়া’ দিয়ে যাবে ‘ক্যাসিনি’। অনেকটা নেমে আসবে শনির দুই মেরুর কাছে। তার আগে আজ বৃহস্পতিবারই শনির চাঁদ ‘টাইটান’ এক ধাক্কায় ‘ক্যাসিনি’কে ছুঁড়ে দেবে শনির বলয়গুলির দিকে। শনির নিরক্ষরেখার (ইক্যুয়েটর) দিকে। ‘ক্যাসিনি’র এই পর্বটাকে আমরা বলছি ‘রিং-গ্রেজিং অরবিটস্’।
শনির রিং-গ্রেজিং অরবিটসে’ ঢোকার আগে ‘ক্যাসিনি’। দেখুন ভিডিও।
কারণ, শুধুই মরণ-ঝাঁপ দেওয়ার জন্য শনির বলয়ে ঢুকবে না, ওই বলয় আর তার আশপাশে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে থাকা কণা, গ্যাস আর ধুলোবালি ছেঁচে নিয়ে তা পৃথিবীতে পাঠানোর ব্যবস্থাও করে যাবে ‘ক্যাসিনি’। তাই এই পর্বটাকে আমরা বলছি, ‘গ্রেজিং’। আগামী মার্চ-এপ্রিলে শনির ‘এফ’ বলয়ে প্রায় ঢুকেই যাবে ‘ক্যাসিনি’। তবে তখনও শনির ‘এফ’ বলয় থেকে ‘ক্যাসিনি’র দূরত্ব থাকবে প্রায় ৭ হাজার ৮০০ কিলোমিটার বা ৪ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার। শনির বলয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে বাইরে থাকা এই ‘এফ’ বলয়টিই সবচেয়ে পাতলা। ৫০০ মাইল বা ৮০০ কিলোমিটারেই তা ফুরিয়ে যায়। আর তার ‘অন্তঃস্থল’টার ঘনত্বও খুব বেশি নয়। হবে কী ভাবে? তা যে সাকুল্যে ৩০ মাইল বা ৫০ কিলোমিটারের বেশি নয়। এই মরণ-ঝাঁপে আমাদের কিন্তু অনেক লাভ হবে। কারণ, ‘ক্যাসিনি’র চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পারব শনির আরও কয়েকটি ‘লুকিয়ে থাকা’ চাঁদ ‘প্যান্ডোরা’, ‘অ্যাটলাস’, ‘প্যান’ আর ‘ডাফনিস’কে। জানতে পারব শনির খুব গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বলয় ‘এ’ আর ‘বি’ সম্পর্কেও।’’
মরণঝাঁপের আগে শনির বলয়ের কাছাকাছি ‘ক্যাসিনি’
মরণ-ঝাঁপের শেষ পর্বে শনির কতটা ওপরে থাকবে ‘ক্যাসিনি’?
শনির বলয়গুলির ‘আলোর বর্ণালী
মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের (টিআইএফআর) জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপক দেবেন্দ্র ওঝার কথায়, ‘‘এই কক্ষপথগুলিতে ‘ক্যাসিনি’ থাকবে শনির মেঘমণ্ডলের ৫৬ হাজার মাইল বা ৯০ হাজার কিলোমিটার ওপরে। আর আগামী এপ্রিলে তা তলিয়ে যেতে শুরু করেব শনির অতলান্ত অন্দরে। আর সেই সময় তা থাকবে শনির মেঘমণ্ডল থেকে মাত্রই ১ হাজার ১২ মাইল বা ১ হাজার ৬২৮ কিলোমিটার ওপরে। আর তা শনির বুকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আগামী বছরের ১৫ সেপ্টেম্বরে।’’
ভাল থেকো ‘ক্যাসিনি’!!!
ছবি, ভিডিও এবং অ্যানিমেশন সৌজন্যে: নাসা
দেখুন গ্যালারি- শনি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণাই বদলে দিল ক্যাসিনি, দেখুন কী ভাবে?
আরও পড়ুন- ১৫১ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও জল জমে বরফ হচ্ছে! বড় চমক ভারতীয়ের