Science News

বিগ ব্যাংয়ের পর ৬০০ লক্ষ কোটি সূর্যের ঝলসানি দেখল নাসা

বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের পর জমাট বাঁধা অন্ধকার ফুঁড়ে তখন সবে ভোর হয়েছে এই ব্রহ্মাণ্ডে। নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ তো দূরের কথা, কোনও গ্যালাক্সিরও জন্ম হয়নি। সেই গ্যালাক্সির যেটা ভ্রূণ, সেই কোয়েজারও তখন সবে চেহারা নিতে শুরু করেছে।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৯:১৪
Share:

সেই কোয়েজার (লাল)। দু’পাশের নীল আলো গ্যালাক্সিদের। ছবি সৌজন্যে: নাসা

ব্রহ্মাণ্ডের ভোর হওয়ার সময় সবচেয়ে উজ্জ্বল মহাজাগতিক বস্তুটির হদিশ মিলল। ঠিকরে বেরিয়ে আসা আলোয় এখনও যা অসম্ভব রকমের ঝকঝকে। ঝলমলে। ১২৮০ কোটি বছর আগেকার সেই অসম্ভব জোরালো আলো। ৬০০ লক্ষ কোটি সূর্য এক সঙ্গে জ্বললে, যে পরিমাণ আলো হয়, ততটাই উজ্জ্বলতা ছিল সেই আলোর।

Advertisement

বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের পর জমাট বাঁধা অন্ধকার ফুঁড়ে তখন সবে ভোর হয়েছে এই ব্রহ্মাণ্ডে। নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ তো দূরের কথা, কোনও গ্যালাক্সিরও জন্ম হয়নি। সেই গ্যালাক্সির যেটা ভ্রূণ, সেই কোয়েজারও তখন সবে চেহারা নিতে শুরু করেছে। যাকে ‘প্রোটো-কোয়েজার’ও বলা যায়। মেরেকেটে তার ১০০ কোটি বছর আগে হয়েছে সেই বিগ ব্যাং। কোয়েজারটির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘J043947.08+163415.7’।

আদিমতম ব্রহ্মাণ্ডের সেই সৃষ্টি-প্রক্রিয়া দেখল নাসার হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপ। এই প্রথম। নাসা জানিয়েছে, বিগ ব্যাংয়ের পর সুদূরতম অতীতের কোনও মহাজাগতিক বস্তুকে এতটা উজ্জ্বল ভাবে এর আগে দেখা যায়নি।

Advertisement

দৈত্যাকার ব্ল্যাক হোলের চার পাশে তখন আলোর বলয়!

আর সেই ঘটনাটা যখন ঘটেছিল, তার আগেই দৈত্যাকার ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরদের জন্ম হয়েছে। গ্যালাক্সি তৈরি হওয়ার জন্য যে অত্যন্ত ঘন গ্যাসের জমাট বাঁধা মেঘের সঙ্গে ধাতব পদার্থের ধুলোবালিও লাগে, তখনও তৈরি হয়নি সেই ধুলোবালি। ছিল শুধুই হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের জমাট বাঁধা গ্যাসের অত্যন্ত ঘন মেঘ। জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে সেই সব কিছুই তখন গিলে, চেটেপুটে খেতে শুরু করে দিয়েছে ব্ল্যাক হোলগুলো। আর তার পেটে ঢুকছে যে গ্যাসের জমাট বাঁধা মেঘ, তারা অতলের আহ্বানে তলিয়ে যাওয়ার সময় চার পাশে ছড়াচ্ছে বিকিরণ। সেই বিকিরণই ব্ল্যাক হোলের চার পাশে এক ধরনের আলোর বলয় তৈরি করছে।

অত দূরের ঘটনা কী ভাবে হয়ে উঠল উজ্জ্বলতম?

বিগ ব্যাংয়ের সামান্য সময় পরেই সদ্য জন্মানো সেই কোয়েজার, যা কি না রয়েছে আমাদের থেকে ১২৮০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, কী ভাবে তাকে এতটা উজ্জ্বল ভাবে দেখতে পেল হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপ?

আলোর আর একটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এই ভাবেই দেখা গিয়েছে সেই উজ্জ্বলতম কোয়েজারকে

নাসা জানিয়েছে তার আদত কারণটি। বলেছে, পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা বড় একটা গ্যালাক্সি হঠাৎই সামনে এসে পড়েছিল হাব্‌ল টেলিস্কোপের। আর তাতেই কেল্লা ফতে! ওই বড় গ্যালাক্সিটাই তখন হাব্‌লের সামনে হয়ে পড়ে একটি আতস কাচ বা ম্যাগনিফাইং গ্লাস।

সামনে আতস কাচ ধরলে যেমন সব কিছুকেই অনেক গুণ বড় করে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। আর যাকে বড় চেহারায় দেখতে চাইছি, আতস কাচকে তার থেকে যত দূরে নিয়ে গিয়ে আমাদের চোখের কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়, ততই তাকে আমরা আরও বড় চেহারায় দেখতে পাই। আর সেই বস্তুটি থেকে যদি আলো ঠিকরে বেরয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে তার উজ্জ্বলতাও বেড়ে যায় অনেক গুণ।

ব্রহ্মাণ্ডের উজ্জ্বলতম কোয়েজারটি দেখার সময়েও সেই ঘটনাটা ঘটেছে। এর মানে, ওই কোয়েজারটিকে উজ্জ্বল ভাবে দেখার জন্য যে গ্যালাক্সিটা আতস কাচের মতো কাজ করেছে, সেই গ্যালাক্সিটা ছিল পৃথিবীর কাছাকাছি। না হলে, ওই কোয়জারটিকে অতটা উজ্জ্বল ভাবে দেখা সম্ভব হত না।

‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’ কী জিনিস?

সেই কোয়েজার ‘J043947.08+163415.7’

মহাকাশে কোনও মহাজাগতিক বস্তুকে আতস কাচের মতো ব্যবহার করে অনেক দূরের ঘটনাকে দেখার কৌশলকে বলা হয় ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’।

আরও পড়ুন- ব্রহ্মাণ্ডের ভোরের প্রথম আলোর হদিশ মিলল​

যে কোনও মহাজাগতিক বস্তুরই ভর থাকে। থাকে অভিকর্ষ বলও। ভরের তারতম্যে তার সেই বলেরও ফারাক ঘটে। যার ভর যত বেশি, তার অভিকর্ষ বল ততটাই জোরালো হয়। আর সেই অভিকর্ষ বলের জন্যই ব্রহ্মাণ্ডের স্থান ও কাল (স্পেস অ্যান্ড টাইম) বেঁকেচুরে যায়। ফলে, খুব দূরের জিনিস থেকে বেরিয়ে আসা আলোর গতিপথকেও বাঁকিয়েচুরিয়ে দিয়ে তাকে কাছে টেনে আনে। তার ফলে সেই দূরের বস্তুটিও উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। আবার ‘আতস কাচ’ হয়ে ওঠা সামনের সেই গ্যালাক্সিটা যখন সরে যায়, তখন দূরাগত সেই আলোর উজ্জ্বলতাও কমে যায়।

দেখুন সেই উজ্জ্বলতম কোয়েজারের ভিডিয়ো

এর চেয়ে উজ্বল কোয়েজার দেখার আশা করি না, বলছেন গবেষকরা

এক দিন, দু’দিন বা দু’-এক বছর নয়। টানা ২০ বছর ধরে ওই কোয়েজারটির উপর নজর রেখে এসেছেন গবেষকরা। নিয়মিত ভাবে। মূল গবেষক টাকসনের আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিয়াওহুই ফ্যান তাঁদের গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘ব্রহ্মাণ্ডের যতটা অংশ এখনও পর্যন্ত দৃশ্যমান, তার মধ্যে এর চেয়ে উজ্জ্বল কোনও কোয়েজার আর দেখা যাবে বলে আশাও করি না।’’

তাঁরা জানিয়েছেন, যে গ্যালাক্সির ভ্রূণ ওই কোয়েজারটি, সেই গ্যালাক্সিতে খুব দ্রুত হারে চলছিল তখন নক্ষত্র-সৃষ্টির প্রক্রিয়া।

বছরে ১০ হাজারেরও বেশি তারা জন্মাচ্ছিল ওই শিশু গ্যালাক্সিতে!

কতটা দ্রুত, জানেন? একটা পার্থিব বছরে ১০ হাজারেরও বেশি নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছিল তখন ওই গ্যালাক্সিতে। সেটা কতটা দ্রুত, তা বুঝতে আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। আমাদের মিল্কি ওয়েতে এক বছরে গড়ে একটি করে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়।

কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-এর অধিকর্তা দেশের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘সত্যি-সত্যিই একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এর আগে এত দূরের কোনও মহাজাগতিক বস্তুকে এতটা উজ্জ্বল ভাবে দেখা যায়নি। তবে সেটাই ওই বস্তুর আদত উজ্জ্বলতা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, সেটিকে দেখা হয়েছে সামনে একটি বড় গ্যালাক্সিকে আতস কাচের মতো ব্যবহার করে।’’

এর আগে যে উজ্জ্বলতম কোয়েজারের হদিশ মিলেছিল, দেখুন তার ভিডিয়ো

অত দূরের কোয়েজারেও ‘দূষণের বিষে’ নীল হয়নি!

সন্দীপ এও জানিয়েছেন, এই ঘটনা দেখাল, কোনও দৈত্যাকার ব্ল্যাক হোল তার আশপাশের গ্যাস, ধুলোবালি, সব কিছু গিলে ও চেটেপুটে খাওয়ার সময় মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া অত্যন্ত ঘন গ্যাসের মেঘ থেকে গ্যালাক্সির ভ্রূণ কোয়েজারও তৈরি করতে পারে। যার থেকে পরে জন্ম হয় গ্যালাক্সির।

আরও পড়ুন- বিশাল গর্তের হদিশ মঙ্গলে! নীচে দেখা মিলবে জলস্রোতের?​

সন্দীপ বলছেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে আরও একটি ঘটনা নজর কাড়ার মতো। সেটি হল একেবারে লাল রংয়েই ধরা পড়েছে প্রায় আদিমতম ব্রহ্মাণ্ডে কোনও কোয়েজারের জন্মের সেই আলো। সাধারণত, অত দূর থেকে আসা আলোকে অনেক গ্যালাক্সি পেরিয়ে এসে পৌঁছতে হয় আমাদের কাছে। আমাদের নাগালে। আমাদের ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে। তার ফলে, গ্যালাক্সির আলো ‘বিষিয়ে’ দেয় সেই দূরাগত আলোকে। তাকে নীল করে দেয়। কিন্তু এই আলো সেই অর্থে, ‘দূষণমুক্ত’ই থেকে গিয়েছে।’’

ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement