তখন ৯৩৩ বিক্রম সম্বত; অর্থাৎ, ৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ। শ্রীমদ আদিবরাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে আসীন গুর্জর-প্রতিহার বংশের ষষ্ঠ রাজা, মিহিরভোজ। বিষ্ণুপূজক রাজার আদেশে গ্বালিয়র দুর্গের চতুর্ভুজ বিষ্ণুর একশিলাখণ্ডে খোদিত মন্দিরের গর্ভগৃহের দেওয়ালে সংস্কৃত ভাষায় নাগরী লিপিতে খোদাই করা হল: ‘মন্দির সংলগ্ন একখণ্ড জমি, দৈর্ঘ্যে ২৭০ হস্ত… … দেবত্র করা হল; সেখানে ফুলের চাষ হবে।’
প্রায় হাজার বছর পরে ঊনবিংশ শতকে গ্বালিয়র দুর্গের বৈল্লভট্টস্বামী মন্দিরের দেওয়ালে এক দিন নতুন করে আবিষ্কৃত হল ওই শিলালিপি। দশমিক স্থানীয় মানভিত্তিক নিয়মে লেখা এই ‘০’ চিহ্নকে এখন আন্তর্জাতিক স্তরে আধুনিক গাণিতিক শূ্ন্যের পাথরে খোদাই করা প্রাচীনতম নিদর্শন বলে মানা হয়। যদিও ওই মন্দিরের দেওয়ালেই আর একটা শিলালিপিতে একই লিখনশৈলীর যে ‘১০’ এবং ‘২০’ লেখা রয়েছে, সেটা ৯৩২ বিক্রম সম্বতে উৎকীর্ণ। এমনকি, রাজস্থানে পাওয়া ৮০৭ খ্রিষ্টাব্দের খান্দেলা লিপিতেও ২০১ লিখতে শূন্যের চিহ্ন ব্যবহার হয়েছে একই আঙ্গিকে। সুতরাং, নবম শতাব্দীর ভারতে আজকের মতো দেখতে শূন্য (০) ব্যবহার করে দশমিক নিয়মে সংখ্যা লেখা চালু ছিল। প্রশ্ন হল, কত কাল থেকে তা চালু ছিল?
কথায় বলে, ‘শূন্য থেকে শুরু করা যাক’। কিন্তু শূন্য নিজে কবে, কোথায়, কার হাত ধরে তার যাত্রা শুরু করেছিল, তার স্পষ্ট এবং সর্বজনমান্য ইতিহাস আজও আমাদের অজানা। শূন্যের ব্যবহারিক প্রয়োগের আদিভূমি হিসেবে কখনও প্রাচীন গ্রিস বা চিনের নাম ভেসে ওঠে বটে, তবে আন্তর্জাতিক মহলে এই ধরনের মত সংখ্যালঘু। গণিতের ইতিহাসে প্রাচীন ভারতের অবদান ‘শূন্য’— এ কথাটা ঠাট্টার মতো শোনালেও, তা আক্ষরিক অর্থেই সত্যি, আর সারা বিশ্বে মোটের ওপর স্বীকৃতও বটে। যদিও নানান প্রাচীন সভ্যতায় শূন্যের নানাবিধ প্রাথমিক ধারণার উদ্ভব ঘটেছিল, তবে একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোথাও তা দশমিক স্থানীয়মান পদ্ধতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ আধুনিক গণিতের শূন্যে উত্তীর্ণ হয়নি। না ধারণায়, না চেহারায়।
বেদের যুগ থেকেই ঋষিদের গভীর জ্ঞান-সঞ্জাত উচ্চারণে আমরা শূন্যের কথা শুনতে পাই। এই শূন্য অবশ্যই গণিতের শূন্য নয়, কিন্তু শূন্যতার বোধকে এই সভ্যতা নিঃসন্দেহে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে কৌতূহলের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। গ্রিক সভ্যতার মতো দার্শনিক মতবাদ এখানে গাণিতিক শূন্যকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করেনি, উল্টে বার বার খতিয়ে দেখেছে, অনুভব করতে চেয়েছে শূন্যের বাঙ্ময় নীরবতাকে। এই সামাজিক বাতাবরণে বিভিন্ন দার্শনিক চেতনায় জারিত শূন্যতার ধারণার বীজ থেকে যে দিন জন্ম নিয়েছিল গণিতের শূন্য, সমাজের অন্য দিকপালেরা তাতে বাধার সৃষ্টি করেননি।
যদিও পাণিনীয় ব্যাকরণের ‘লোপ’-এর ধারণায় শূন্যের পূর্বপুরুষকে দেখেন অনেকে, তবে গাণিতিক শূন্যের সরাসরি উল্লেখ রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের পিঙ্গলছন্দসূত্রের ‘রূপে শূন্যম’ এবং ‘দ্বিশূন্য’ সূত্রে। আগে-পরের সূত্রগুলো মিলিয়ে যে গাণিতিক গণনার কথা ধরা রয়েছে টীকাকারদের ব্যাখ্যায়, তার সব কিছুই প্রায় দু’হাজার বছর পরে পুনরাবিষ্কৃত হয়েছিল নবজাগরণোত্তর ইউরোপে, ব্লেইজ় পাস্কালের ত্রিভুজ কল্পনায়, দ্বি-নিধানী (ইংরেজিতে বাইনারি) সংখ্যা বা দ্বিপদ সহগের যোগফল হিসেবে। তবে ছন্দসূত্রে সব কিছুই বলা ছিল ভাষায়, তাই পিঙ্গলের সময় শূন্যকে কী চেহারায় দেখা হত, তা আমাদের জানার বাইরে। প্রাচীন ভারতের শ্রুতির যুগের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে যে দুর্ভাগ্যজনক ‘শূন্যতা’-র সামনে পড়তে হয়, তা হল লিখিত প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাব। ঋগ্বেদে দশমিক সংখ্যাদের সংস্কৃত নামের প্রায় তিন হাজার উদাহরণ পাওয়া গেলেও কোথাও শূন্যের উল্লেখ মেলে না। বস্তুত অশূন্য-সংখ্যাদের নাম, যেমন ‘একশো’, মুখে বলতে কখনওই ‘শূন্য’ লাগে না। তবে স্থানীয় মানভিত্তিক পদ্ধতিতে লিখতে গেলে শূন্য ছাড়া ‘এগারো’ আর ‘একশো এক’ এর তফাত করা যাবে না, দু’টো ১-এর মাঝে শূন্যবাচক চিহ্ন চাই।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে এই প্রয়োজন মেটাতে ব্যাবিলনীয়রা ষষ্টিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করতেন এক বিশেষ (স্থানীয় মান বোঝাতে) ‘শূন্যচিহ্ন’। দেখতে যেন দুটো < চিহ্ন, একে অন্যের পিঠে উঠে পড়েছে। চৈনিক সভ্যতায় এ রকম সংখ্যাদের মাঝে ফাঁক রেখেই লেখা হত, ফাঁকের নাম ছিল ‘কং’। একাধিক শূন্যের প্রয়োজনে আন্দাজমতো বড় ফাঁক, তার নামও ‘কং’, একাধিক ‘কং’ নয়; আন্দাজে ভুল হলে, সংখ্যা বুঝতেও ভুল হবে; গোলমেলে ব্যাপার সন্দেহ নেই, বিশেষ করে যদি সংখ্যার ডান দিকে শূন্য থাকে। মায়া সভ্যতায় শূন্যের অন্যতম চিহ্ন ছিল লাল রঙের ঝিনুকের খোলা, এ ছাড়াও ছিল বেশ কয়েকটা এবং ক্ষেত্রবিশেষে এদের স্বাধীন ভাবে ব্যবহার করা হত শূন্য বোঝাতে। তবে নানা গাণিতিক মানদণ্ডে এরা কেউই আজকের শূন্যের পূর্বপুরুষ হিসেবে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এই উত্তরণ ঘটেছিল একমাত্র ভারতীয় শূন্যের, সংখ্যা হিসেবে, আর সব সংখ্যার সঙ্গে একই অধিকারে ও মর্যাদায়, যার প্রমাণ রয়েছে পরবর্তী কালে পঞ্চম শতাব্দীর আর্যভট্ট, বা সপ্তম শতাব্দীর ব্রহ্মগুপ্তের গণিতে।
লিখিত শূন্যের প্রাচীনতম ভারতীয় চেহারা কিন্তু আজকের মতো ‘০’ ছিল না। শূন্যের সবচেয়ে চালু নাম ছিল ‘খ’, অর্থাৎ আকাশ, আর তাকে লেখা হত ‘বিন্দু’ (•)চিহ্ন দিয়ে। তৃতীয় শতকে স্ফুজিধ্বজ ভাষায় লিখেছেন ছয়ের পাশে বিন্দু (খ) যুক্ত করে ষাট হয়, চতুর্থ শতাব্দীতে সুবন্ধুর বাসবদত্তা নাটকেও পাই ‘শূন্যবিন্দু’র কথা। ৬০৫ শকাব্দে (অর্থাৎ, ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে) পাথরে খোদাই করা সংস্কৃত ভাষায় পুরনো খমের লিপিতে লেখা প্রাচীনতম ‘বিন্দুশূন্য’ আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৩১ সালে, একদা ভারতীয় সংস্কৃতি-সম্পৃক্ত কম্বোডিয়ায়, পরে যা খোয়া যায় পল পট জমানায়। ২০১৩ সালে তা আবার খুঁজে বের করেছেন আমির একজ়েল।
সংখ্যা লিখতে বিন্দুশূন্যের ব্যবহারের অজস্র উদাহরণ রয়েছে বাখশালি পাণ্ডুলিপিতে, যার মূল রচনার সময়কাল নিয়েও নানা মুনির নানা মত। পেশোয়ার থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে, প্রাচীন তক্ষশিলার ১১৫ কিলোমিটারের মধ্যে এই বাখশালি জনপদ, যেখানে ১৮৮১ সালে এক নিরক্ষর চাষির কোদালের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে উঠে এসেছিল বার্চ গাছের ছালে লেখা গোটা সত্তর পৃষ্ঠা, প্রাচীন ভারতীয় (পাটি)গণিতের অসম্পূর্ণ রত্নখনি, যার আজকের ঠিকানা অক্সফোর্ডের বোদলেইয়ান গ্রন্থাগার। ২০১৭ সালে তাদেরই করা রেডিয়ো-কার্বন পরীক্ষায় পৃষ্ঠা ১৬, ১৭ এবং ৩৩-এর সময়কাল নির্ধারিত হয়েছে যথাক্রমে ২২৪-৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ, ৬৮০-৭৭৯ খ্রিস্টাব্দ এবং ৮৮৫-৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ।
হই হই করে আপত্তি জানিয়েছেন কয়েক জন বিশেষজ্ঞ, যাঁরা কিছুতেই সপ্তম শতাব্দীর আগে ভারতীয় গাণিতিক শূন্যের অস্তিত্ব মানতে চান না। এটা সত্যি হলে তাঁদের এত দিনের তাত্ত্বিক অবস্থান ভুল বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু এমন কি হতে পারে না যে, বিভিন্ন সময়ে নষ্ট হতে বসা কোনও কোনও পাতাকে বার বার নতুন করে লেখানো হয়েছিল সমকালীন কোনও অনুলেখককে দিয়ে, সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে, মূল লিখনশৈলীকে অবিকৃত রেখে? বিতর্কের সমাধান করতে সব ক’টা পাতা থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা চালানো দরকার। বোদলেইয়ান কর্তৃপক্ষ শুনছেন কি?
শূন্যের ইতিহাসের পুনরুদ্ধারের বিষয়টা অনেকটা সেই সব ধাঁধার মতো, যেখানে অনেকগুলো টুকরো জুড়ে তৈরি করতে হয় প্রকৃত চিত্রকে। তফাতের মধ্যে, এই ধাঁধার বেশ কিছু টুকরোই গিয়েছে হারিয়ে, হয়তো বরাবরের মতো। তাই যুক্তির সঙ্গে কল্পনার মিশেলে পণ্ডিতরা তৈরি করেন নতুন চিত্রকল্প। কখনও আবিষ্কার হয় অজানা একটা টুকরো, অমনি বদলে যায় চিত্রকল্প, বিকশিত হয় নতুন সম্ভাবনা। এ খেলার কোনও শেষ নেই।