ইনসেটে, অধ্যাপক জ্যোৎস্নেন্দু গিরি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সার্স-কভ-২ ভাইরাস যাতে স্বস্তিতে বসতে না মানুষের ত্বকে, মাস্ক, টেবিল, চেয়ার, লিফ্টের বোতাম, সোফায় তার জন্য ‘বিছানাটা’কেই উঁচু-নীচু করে দিয়েছেন। সেই বিছানায় ছড়িয়ে রেখেছেন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বহু সূচ। ভাইরাস যাতে হুলবিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করে। সেই উঁচু-নীচু বিছানার ভিতরেই লুকিয়ে রেখেছেন ঘাতককে। সূচ ছড়ানো বিছানায় ভাইরাস যন্ত্রণায় ছটফট করার সময় যে ঘাতকরা এসে নিমেষে মেরে ফেলবে ভয়ঙ্কর সার্স-কভ-২ ভাইরাসকে।
শরীরে ঢোকার আগেই মাস্ক, টেবিল, চেয়ার, লিফ্টের বোতাম, সোফা আর মানুষের ত্বকে ভাইরাসকে মেরে ফেলার এই অভিনব কলাকৌশল যাঁর মাথা থেকে প্রথম বেরিয়ে এসেছে তিনি এক বঙ্গসন্তান। কাঁথির বলভদ্রপুর গ্রামের জ্যোৎস্নেন্দু গিরি। হায়দরাবাদের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি)’-র বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর।
ভাইরাসের জন্য এই মারণ-বিছানা পাততে জ্যোৎস্নেন্দু চুলের ১ হাজার ভাগের ১ ভাগ ব্যাসের অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিছু কণা (‘ন্যানো-পার্টিক্ল’)-র সঙ্গে ব্যবহার করেছেন ইথাইল অ্যালকোহলকে। যাকে আমজনতা অ্যালকোহল বলে জানে, চেনে। অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকেই যার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছেছে স্যানিটাইজারের দৌলতে। জ্যোৎস্নেন্দুর বানানো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলি আদতে পলিমার যৌগ।
কেন এমন বিছানা পাততে হল, কেন এমন সূচ?
মাস্ক, টেবিল, চেয়ার, লিফ্টের বোতাম, সোফা আর মানুষের হাতে, পায়ে সব সময়ই থাকে লক্ষ লক্ষ ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া। তাদের মারার জন্যই বার বার স্যানিটাইজারে ভাল ভাবে হাত ধুয়ে নিতে হয় আমাদের। স্যানিটাইজারে থাকা অ্যালকোহল তাদের নিমেষে মেরে ফেলে বলে।
তা হলে ভাইরাসকে যন্ত্রণায় ছটফট করিয়ে মেরে ফেলার জন্য অন্য রকমের বিছানা পাতার দরকার হল কেন জ্যোৎস্নেন্দুর? হল, কারণ অ্যালকোহল তো নিমেষেই উবে যায়। তা আর কত ক্ষণই বা থাকে মাস্ক, টেবিল, চেয়ার, লিফ্টের বোতাম, সোফা বা আমাদের ত্বকে? উবে গেলেই তো সেখানে ফের এসে বসবে লক্ষ লক্ষ ভাইরাস। আর সে সব স্পর্শ করলেই চলে আসবে আমাদের হাতে, পায়ে। তার পর তারা আমাদের শরীরে ঢোকার নানা রকমের ফন্দিফিকির আঁটবে। যত ক্ষণ না ঢুকছে তত ক্ষণ সংক্রমণের ভয় নেই। কারণ, মানুষের ত্বকে বসে নিজেদের বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠার ক্ষমতা ভাইরাসের নেই। শ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকলেই সে হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। পেয়ে যায় জীবন।
হায়দরাবাদ আইআইটি-র গবেষণাগারে জ্যোৎস্নেন্দু। -নিজস্ব চিত্র।
তাই সেরা পন্থা- ভাইরাস আর জীবাণুদের মাস্ক, টেবিল, চেয়ার, লিফ্টের বোতাম, সোফা আর আমাদের ত্বকে এক মুহূর্তও বাঁচিয়ে না রাখা। আর তার মেয়াদ যতটা বাড়ানো যায় ততই মঙ্গল। অ্যালকোহল নিমেষে উবে যায় বলেই জ্যোৎস্নেন্দুকে ভাবতে হয়েছে এমন কলাকৌশল যাতে স্প্রের- মাধ্যমে অ্যালকোহলের সঙ্গে ত্বকে এসে পড়লেও তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণারা উবে যাবে না অ্যালকোহলের সঙ্গে। তারা বরং মানুষের হাতে, পায়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের প্রলেপ (‘কোটিং’) বানিয়ে রাখবে কম করে ২৪ ঘণ্টা আর মাস্ক, টেবিল, চেয়ার, লিফ্টের বোতাম, সোফায় সেঁটে থাকবে অন্তত ৩৫ দিনের জন্য। আর যেহেতু সেই সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার গায়ে রয়েছে অজস্র সূচ আর ভিতরে পুরে রাখা আছে নানা রকমের ঘাতক অণু, তাই ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে কণাগুলি সার্স-কভ-২ সহ যে কোনও ভাইরাস ও জীবাণুকেই কয়েক মূহুর্তের বেশি জীবিত থাকতে দেবে না।
ডিউরোকিয়া প্রযুক্তি: ৪ রকমের নতুন স্যানিটাইজার
এই গবেষণায় প্রয়োজনীয় অর্থের একাংশ বহন করেছে হায়দরাবাদ আইআইটি। বাকিটা একটি বেসরকারি উদ্যোগের। চিন্তাভাবনা, গবেষণার স্তর পেরিয়ে জ্যোৎস্নেন্দু ইতিমধ্যেই তাঁর উদ্ভাবিত প্রকৌশলের ২টি পেটেন্ট করিয়ে ফেলেছেন সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রক থেকে। তাঁর অভিনব কলাকৌশলে বানানো ৪ ধরনের স্যানিটাইজার বাজারে আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু করেছেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল। হায়দরাবাদ আইআইটি-র অধিকর্তা বি এস মূর্তির কথায়, ‘আক্ষরিক অর্থেই এগুলি লং-লাস্টিং হাইজিন প্রোডাক্টস।’
জ্যোৎস্নেন্দু ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে বলেছেন, এই অভিনব কলাকৌশলে মোট ৪ ধরনের স্যানিটাইজার বানিয়েছি ‘‘আমাদের উদ্ভাবিত ‘ডিউরোকিয়া’ প্রযুক্তিতে। এর মধ্যে তিনটি ব্যবহার করা যাবে বাজারে চালু স্যানিটাইজারের পরিবর্তে। প্রথমটি- ‘লং লাস্টিং সারফেস ডিসইনফেক্ট্যান্ট’ বা ‘ডিউরোকিয়া-এস’। দ্বিতীয়টি- ‘লং লাস্টিং হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ বা ‘ডিউরোকিয়া-এইচ’। তৃতীয়টি- ‘লং লাস্টিং ফোম হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ বা ‘ডিউরোকিয়া-এইচ অ্যাকোয়া’। এ ছাড়াও মাস্কের বাইরের দিককে সব সময় ভাইরাসমুক্ত রাখার জন্য বানানো হয়েছে ‘লং লাস্টিং অ্যান্টিভাইরাল মাস্ক কোটিং’ বা ‘ডিউরোকিয়া-এম’।’’
এই ডিউরোকিয়া প্রযুক্তি আদতে দু’টি শব্দের মেলবন্ধন। ‘ডিউরো’ শব্দটি এসেছে ‘ডিউরেশন’ বা মেয়াদ থেকে। আর ‘কিয়া’ শব্দটি জাপানি। যার অর্থ- ‘কেয়ার’ বা সুরক্ষা।
গবেষণার মূল লক্ষ্য কী কী?
জ্যোৎস্নেন্দু জানাচ্ছেন, তাঁদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল ৪টি।
এক, এই কলাকৌশলে যাতে আমাদের দেহত্বকে এসে বসা ভাইরাসকে নিমেষে মেরে ফেলা যায়।
দুই, তার পরেও দীর্ঘ সময় যাতে ভাইরাস আর ত্বকে এসে বসার সুযোগ না পায়।
তিন, যাতে এই কলাকৌশলকে ব্যবহার করা সম্ভব হয় অ্যালকোহলের উপর নির্ভর করে। কারণ, স্বাস্থ্য সচেতনতার নিরিখে চিকিৎসাবিজ্ঞান জলের চেয়ে অ্যালকোহলকেই বেশি গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেয়।
চার, এই ৪ ধরনের স্যানিটাইজারের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা।
তাই ১০০ থেকে ২৩০ মিলিলিটার পরিমাণের এই ৪ ধরনের স্যানিটাইজারের দামই রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে।
প্রথম ধাপ। স্প্রে-র পর অ্যালকোহলের ড্রপলেট (নীল গোলক) মেরে ফেলছে ভাইরাস, জীবাণু (সবুজ রং)। গ্রাফিক সৌজন্যে- হায়দরাবাদ আইআইটি।
কাঁথির জ্যোৎস্নেন্দুর পরিক্রমা
কাঁথির সন্তান জ্যোৎস্নেন্দু বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বি এসসি করার পর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বি টেক করেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। তার পর পিএইচ ডি মুম্বইয়ের আইআইটি-তে। প্রথম পোস্টডক্টরাল আমেরিকার ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক)’ এবং দ্বিতীয় পোস্টডক্টরাল আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেল্থ (এনআইএইচ)’-এ। এর পর দেশে ফিরে অধ্যাপনা শুরু করেন হায়দরাবাদ আইআইটি-তে।
দ্বিতীয় ধাপ। অ্যালকোহল উবে যাওয়ার পর হাতে বা মাস্ক, টেবিল, চেয়ারের উপরে স্থায়ী ভাবে সেঁটে থাকবে অ্য়ালকোহলের সঙ্গে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পলিমারগুলি (নীল গোলক- উপরে)। কী ভাবে কোটিং তৈরি করবে দেখানো হয়েছে (নীচে)। গ্রাফিক সৌজন্যে- হায়দরাবাদ আইআইটি।
এমন অভিনব কলাকৌশল মাথায় এল কী ভাবে?
জ্যোৎস্নেন্দুর কথায়,‘‘অতিমারি শুরুর পর গত বছর যখন স্যানিটাইজারের বহুল ব্যবহার শুরু হল ঘরে ঘরে, অফিসকাছারিতে, তখনই ভাবতে শুরু করেছিলাম এই ভাবে কত ক্ষণই বা মারা যাবে মাস্ক, টেবিল, চেয়ার, লিফ্টের বোতাম, সোফা আর আমাদের ত্বকের উপর সব সময় থাকা ভাইরাসদের? অ্যালকোহল তো নিমেষে উড়ে যাবে। তার পর আবার তো ওই সব জায়গায় ঘাঁটি গাড়বে পরিবেশে থাকা ভাইরাসরা। সে ক্ষেত্রে কিছু ক্ষণ অন্তর ঘরে, হাসপাতাল, অফিসকাছারিতে ব্যবহার করতে হবে স্যানিটাইজার। তাতে খরচ তো অনেক বেড়ে যাবে।’
তৃতীয় ধাপ। এই ভাবে তড়িত আবেশে কাছে টেনে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পলিমারগুলি (নীল গোলক) মেরে ফেলে ভাইরাস (বেগুনি), জীবাণুদের (সবুজ)। গ্রাফিক সৌজন্যে- হায়দরাবাদ আইআইটি।
ফলে, এ ব্যাপারে বিদেশে কী কী গবেষণা হচ্ছে তার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন জ্যোৎস্নেন্দু। দেখেন, আমেরিকা ও জার্মানির দু’-একটি সংস্থা লং লাস্টিং সারফেস ডিসইনফেক্ট্যান্ট স্যানিটাইজার বানাতে শুরু করেছে। সেগুলিতে অ্যালকোহলের পরিবর্তে জল ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলি ছিল সিলিকন যৌগের পলিমার।
এই গবেষণার অভিনবত্ব
জ্যোৎস্নেন্দুর কথায়, ‘‘ওই পদ্ধতির কয়েকটি সমস্যা আছে। রোগীর নিরাপত্তা রক্ষায় চিকিৎসকেরা সব সময়ই জলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন অ্যালকোহলকে। সিলিকনের পলিমারগুলি মাস্ক, টেবিল, চেয়ার, লিফ্টের বোতাম, সোফা আর মানবত্বকে ঘাঁটি গাড়া ভাইরাসকে হুলবিদ্ধ করার জন্য সূচ ফোঁটায় ঠিকই, কিন্তু তাদের মারতে ২৫/৩০ মিনিট সময় নেয়। আমাদের পদ্ধতিতে তাই ব্যবহার করা হয়েছে অ্যালকোহল। যাতে নিমেষে মেরে ফেলা যায় তাদের। বানানো হয়েছে ভাইরাস, জীবাণুদের জন্য অভিনব উঁচু-নীচু বিছানা, যেখানে রয়েছে অজস্র সূচ। তার সঙ্গে আছে আমাদের উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলির ভিতরে থাকা নানা ধরনের ঘাতক অণু যারা বেরিয়ে ভাইরাস, জীবাণুদের নিমেষে বধ করতে পারবে।’’
চতুর্থ ধাপ। তার পর হাতে, মাস্ক টেবিল, চেয়ারের উপর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলি (নীল গোলক) থেকে যাবে ৩৫ দিন। ওই সময় কোনও ভাইরাস, জাবীণুকেই কাছে ঘেঁষতে দেবে না। গ্রাফিক সৌজন্যে- হায়দরাবাদ আইআইটি।
জ্যোৎস্নেন্দু জানাচ্ছেন, ওই অভিনব বিছানায় বসা ভাইরাস, জীবাণুদের মারতে সময় লাগছে খুব বেশি হলে ১ মিনিট। আর পলিমার কণাগুলি মানবত্বকে সেঁটে থাকছে টানা ২৪ ঘণ্টা। আর মাস্ক, টেবিল, চেয়ার, লিফ্টের বোতাম, সোফায় টানা ৩৫ দিন। ফলে, ওই ক’দিন এই সব জিনিস থেকেও আমাদের ত্বকে সার্স-কভ-২ তো বটেই কোনও ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়াই ঘাঁটি গাড়তে পারবে না। তা ছাড়াও পলিমারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার ভিতরে পুরে দেওয়া হয়েছে নানা রকমের ঘাতক অণু। যারা কণার ভিতর থেকে বেরিয়ে নিমেষে নির্বংশ করতে পারবে মানবত্বকে ঘাঁটি গাড়া ভাইরাস ও জীবাণুদের।
বিশ্বে প্রথম এমন স্যানিটাইজার: হায়দরাবাদ আইআইটি
হায়দরাবাদ আইআইটি-র অধিকর্তা বি এস মূর্তি বলছেন, ‘‘বিশ্বে এই প্রথম এমন দীর্ঘমেয়াদি স্যানিটাইজার বানানো সম্ভব হল। যা বার বার ব্যবহার করতে হবে না। ফলে খরচ অনেক কমে যাবে। শুধু তাই নয়, অনেক বেশি সময় ধরে ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়ার উপদ্রব থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে এই চার ধরনের অভিনব স্যানিটাইজার। দাম ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকায় সাধারণ মানুষের ব্যবহার করতে কোনও অসুবিধা হবে না। এর ব্যবহারে বিঘ্নিত হবে না আমাদের শরীর-স্বাস্থ্যের নিরাপত্তাও। আইআইটি-র হায়দরাবাদ ক্যাম্পাসে ইতিমধ্যেই এর ঢালাও ব্যবহার শুরু হয়েছে।’’
ভিডিয়ো ও গ্রাফিক সৌজন্যে- হায়দরাবাদ আইআইটি।