ইনসেটে, গবেষক পৃথা ঘোষ। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
বিন্দুমাত্র আভাস দেয়নি। হুড়মুড়িয়ে এসে পড়েছে! হঠাৎ ঝড়ে উপড়ে পড়ছে সভ্যতার একটা অংশ! এই সব দেখে টিকা, ওষুধ বার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানুষকে বাঁচানোর রাস্তা খুঁজতে আর হয়তো ততটা ঘাম ঝরাতে হবে না। এক-দেড় বছর সময়ও নষ্ট হবে না মানুষকে বাঁচাতে। দেখতে হবে না মৃত্যুমিছিল।
মার্স এবং সার্স-কভ-২ ভাইরাসের হামলায় যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে ও হবে, আগামী দিনে এই পরিবারের নতুন নতুন সদস্যদের হানাদারিতে হয়তো সেই ক্ষয়ক্ষতি এ বার অনেকটাই কমানো যাবে। একই ভাবে ভাইরাসদের অন্য পরিবারগুলির সদস্যদের হানাদারির আগেভাগেই এ বার হয়তো প্রস্তুতি নিতে পারব আমরা।
পথটা দেখালেন দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের পৃথা ঘোষ ও তাঁর সহযোগীরা। করোনাভাইরাস পরিবারের গোটা জিনোমের যাবতীয় খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে। বিশ্বে এই প্রথম।
‘‘এর ফলে, আগামী দিনে করোনাভাইরাস পরিবারের অজানা, অচেনা নতুন নতুন সদস্যদের হানাদারির জন্য আমরা আগেভাগেই তৈরি থাকতে পারব’’, বলছেন কলকাতার বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ।
তাই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নিউক্লিক অ্যাসিডস রিসার্চ’-এ প্রকাশিত পৃথা ও তাঁর সহযোগীদের গবেষণাপত্রটিকে ‘ব্রেকথ্রু’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
২ ভারতীয়। পৃথা ঘোষ (উপরে ডান দিক থেকে দ্বিতীয়) ও চন্দ্রন নিতিন (উপরে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়।
যেন পিঁপড়ের মাউন্ট এভারেস্টে চড়া!
করোনাভাইরাস পরিবারের মোট ৪টি ক্যাটেগরি রয়েছে। আলফা, বিটা, গামা এবং ডেল্টা। গত রবিবার (৬ ডিসেম্বর) পর্যন্ত এই ৪টি ক্যাটেগরির মোট ৬০টি প্রজাতির করোনাভাইরাসের কথা আমরা জানতে পেরেছি।
পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশয়ের ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মলিকিউলার অ্যান্ড সেল বায়োলজি (আইআইএমসিবি)’-র পোস্ট ডক্টরাল গবেষক পৃথা ও তাঁর সহযোগীদের কৃতিত্ব, এই ৪৬টি প্রজাতির করোনাভাইরাসেরই গোটা জিনোমের যাবতীয় খুঁটিনাটি তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন।
ভাইরাসের জিনোম দু’ধরনের হয়। ডিএনএ জিনোম এবং আরএনএ জিনোম। করোনাভাইরাস পরিবারের সব সদস্যই আরএনএ ভাইরাস। তাদের সুদীর্ঘ আরএনএ জিনোমে রয়েছে গড়ে ৩০ হাজার নিউক্লিওটাইড।
প্রতিটি নিউক্লিওটাইড ধরে ধরে পরীক্ষা করে দেখেছেন পৃথা ও তাঁর সহযোগীরা। ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে। তাঁর সহযোগী ছিলেন গ্রনিনজেন ও লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও।
‘‘কাজটা অনেকটা পিঁপড়ের মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছনোর মতো জটিল বলেই এর আগে বিশ্বের কোথাও যা কেউই করে উঠতে পারেননি। এত কম সময়ে এত জটিল কাজটা করেছেন মোট ১১ জন গবেষক। তাঁদের মধ্যে পৃথা-সহ ৫ জনই মূল গবেষক। রয়েছেন আরও এক ভারতীয়। কেরলের নিতিন চন্দ্রন। তিনিও এক জন পোস্ট ডক্টরাল গবেষক ওয়ারশয়ের আইআইএমসিবি-র। ৫ জনেরই সমান অবদান রয়েছে গবেষণাপত্রে। কাজটা কতটা জটিল, এটাই সম্ভবত তার অন্যতম প্রমাণ’’, বলছেন কলকাতার ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (এসআইএনপি)’-এর বায়োফিজিক্সের অধ্যাপক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।
ভবানীপুরের পৃথার পরিক্রমা
গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের ছাত্রী পৃথা মাইক্রোবায়োলজিতে অনার্স নিয়ে বি এসসি পড়তে যান কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তার পর বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে এম এসসি করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মাস্টার্সের পরেই পড়াশোনার জন্য কলকাতা ছাড়তে হয় তাঁকে। পিএইচডি করতে যান বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (এনসিবিএস)’-এ। সেখানেই পৃথার প্রথম পোস্ট ডক্টরাল। দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরাল করতে পৃথা যান পোল্যান্ডে। ওয়ারশয়ের আইআইএমসিবি-তে। স্বামী রোহিত সুরতেকারও জীববিজ্ঞানী।
অন্যান্য ভাইরাসের থেকে কোথায় আলাদা করোনাভাইরাসরা?
মানুষ বা মনুষ্যেতর বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে ঢুকে দ্রুত বংশবৃদ্ধি (‘রেপ্লিকেশন’) করা আর অন্যান্য প্রাণীর শরীরে ছড়িয়ে পড়ার জন্য ভাইরাস তাদের দেহে থাকা প্রোটিনগুলিকে ব্যবহার করে। সেই প্রোটিনের সংখ্যা বড়জোর হয় ৭ থেকে ১০টি।
এইখানেই অনন্য করোনাভাইরাস পরিবারের ৪টি ক্যাটেগরির আপাতত জানা ৬০টি প্রজাতির সদস্যরা। এদের দেহে থাকে কম-বেশি ৩০টি প্রোটিন। তাই এদের জিনোমও অত্যন্ত দীর্ঘ এবং অসম্ভব জটিল। যাতে থাকে গড়ে ৩০ হাজার নিউক্লিওটাইড (গোষ্ঠীর সদস্যভেদে ২৮ হাজার থেকে ৩২ হাজার)।
ভবিষ্যতে হতে পারে অন্যান্য করোনাভাইরাসের হানাদারি
ভাইরাসদের অকেজো করে দিতে আমরা ওষুধ বানাই ওই প্রোটিনগুলিকেই লক্ষ্য করে। যাতে ওষুধের অণু ভাইরাসের ওই মতলববাজ প্রোটিনগুলিকে বেঁধে বা আটকে ফেলতে পারে অথবা ঘিরে ধরতে পারে। এই প্রোটিনগুলির চেহারা খুব এবড়োখেবড়ো। তার গায়ে কোথাও গর্ত আছে কোথাও বা সমতল। সেই গর্ত আবার ছোট বা বড় হতে পারে। গভীর বা অগভীর হতে পারে। ওষুধের ছোট অণু কোথায় গিয়ে ঠিকঠাক ভাবে বসতে পারবে সেটা জানার দরকার হয় বলেই ভাইরাসের প্রোটিন অণুগুলির ত্রিমাত্রিক গঠন আমাদের জানতে হয়।
কিন্তু সার্স-কভ-২ ভাইরাসের মতো যে সব ভাইরাস তাদের প্রোটিনগুলির গঠন আর রূপ দ্রুত বদলিয়ে ফেলে বার বার, তাদের ক্ষেত্রে একটা সময় পরে আমাদের ওযুধ আর তেমন কাজ করতে পারে না প্রোটিনগুলির চেনা-জানা গঠন বদলে গিয়েছে বলে। ফলে, ভাইরাসের ফন্দিবাজ প্রোটিনগুলির যে অংশে ওষুধের অণুর গিয়ে বসার কথা সেই জায়গায় গিয়ে তা বসতে পারে না। তখন ওষুধ কার্যকরী হয় না।
আমাদের শরীরেও আছে লক্ষ লক্ষ প্রোটিন। বিভিন্ন প্রোটিনের কাজ বিভিন্ন। আমাদের দেহের নিজস্ব প্রতিরোধী ব্যবস্থা (‘ইমিউন সিস্টেম’) যে কোনও ভাইরাসকে চিনতে, তার মতলব বুঝে ফেলতে আর তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে আমাদের প্রোটিনগুলিরই দেওয়া ‘বুদ্ধি’ আর তাদের জোগানো শক্তিতে।
আরও পড়ুন- হকিং, পেনরোজ কি উদ্ভাসিত অমল আলোয়? কী বলছে ইতিহাস
আরও পড়ুন- এ বারের নোবেলজয়ী গবেষণার অন্তরালে এই বাঙালিও
আমাদের দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ভাইরাসদেরও খুব বুদ্ধিমান হতে হয়। কারণ, আমাদের শরীরে ঢুকে তাদের বেঁচে থাকতে হবে তো। সেই বেঁচে থাকার জন্য ‘করে-কম্মে খেতে’ গিয়ে ভাইরাসগুলি তাদের শরীরে থাকা প্রোটিনগুলিকে ব্যবহার করে। এই প্রোটিনগুলিই ভাইরাসদের বুদ্ধি জোগায়, আমাদের দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে অকেজো করে দিয়ে সে কী ভাবে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে আর নিজেদের দ্রুত বদলিয়ে ফেলে বাঁচতে পারবে। আমাদের শরীরে। এই কাজে যে ভাইরাসের প্রোটিনগুলি যত দক্ষ, যত কৌশলী, সেই ভাইরাস আমাদের পক্ষে ততই বিপজ্জনক। কারণ, তাদের চিনতে, বুঝতে, সংক্রমণ রুখতে গিয়ে বার বার ধোঁকা খেতে হয় আমাদের দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে।
কাজটার গুরুত্ব কোথায়, কেন, বুঝিয়ে বলছেন পৃথা। দেখুন ভিডিয়োয়
ঘটনা হল, করোনাভাইরাস পরিবারের ৪টি ক্যাটেগরির সব প্রজাতির সকলেই কিন্তু আমাদের শরীরে বাসা বাঁধে না। শেষ দু’টি ক্যাটেগরি গামা ও ডেল্টার প্রজাতিদের মূলত পাখিতে দেখা যায়।
যদিও পৃথারা দেখেছেন, এই দু’টি ক্যাটেগরির কয়েকটি প্রজাতিও আমাদের ত্বকে দিব্য বেঁচে থাকতে পারে। ফলে, আগামী দিনে যে এই প্রজাতিগুলির হানাদারিতে আমরা কাবু হব না, তাই বা কে বুক ঠুকে বলতে পারেন?
করোনাভাইরাসের বাকি দু’টি ক্যাটেগরি (আলফা ও বিটা)-র প্রজাতিরা থাকে বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীতে।
সার্স-কভ-২ ভাইরাস যেমন বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন থেকে আমাদের শরীরে এসেছে বলে মনে করা হয়। তা সে আমাদের প্যাঙ্গোলিনের মাংসপ্রীতির জন্যই হোক অথবা আমাদের বন কেটে বসত বানানোর উৎসাহে এরা আমাদের আরও বেশি সংষ্পর্শে এসে পড়ার ফলে।
নিজের প্রয়োজনেই আশ্রয়দাতাদের মারতে চায় না ভাইরাসরা
কোনও ভাইরাসই তার কোনও আশ্রয়দাতা প্রজাতিকে (মানুষই হোক বা বাঁদর অথবা অন্য কোনও প্রাণী) মেরে ফেলতে চায় না। মেরে ফেললে সে বেঁচে থাকবে কী ভাবে? কী ভাবেই বা বিভিন্ন প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখবে ভাইরাসগুলি?
তবে ঘটনাচক্রে ভাইরাসরা শরীরে ঢুকলে প্রাথমিক ভাবে আশ্রয়দাতা প্রজাতিরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ আশ্রয়দাতাদের দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থা চট করে এই আগন্তুকদের চিনে উঠতে, তাদের মতলব বুঝে ফেলতে, তাদের রোখার উপায় খুঁজে নিতে পারে না। বুঝে উঠতে সময় লাগে। আর সেই সময়েই আশ্রয়দাতারা দ্রুত সংক্রমিত হয়, মৃত্যুর ঘটনাও বেড়ে চলে আশ্রয়দাতা প্রজাতিগুলির মধ্যে, প্রাথমিক ভাবে।
তার পর একটা সময়ে এই ভাইরাসগুলি আশ্রয়দাতাদের বন্ধু হয়ে যায়। নিজেদের টিঁকে থাকতে হলে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে আশ্রয়দাতাদেরও। কয়েক লক্ষ বছরের সহ-বাসের পর বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন যেমন এখন সার্স-কভ-২ ভাইরাসের বন্ধুই হয়ে গিয়েছে! আমরাও হব হয়তো কয়েকশো বছর পর।
ভবিষ্যতের হানাদারদের বুঝে ফেলতে চেয়েছেন পৃথারা
পৃথারা চাননি, সেই অসীম ধৈর্যে অটল থেকে করোনাভাইরাসের নতুন নতুন সদস্যদের হামলার প্রথম ঝটকায় আমরা এই ভাবে দলে দলে প্রাণ দিই। তাই তাঁরা করোনা পরিবারের ৪টি ক্যাটেগরির সব সদস্যকেই চেনা, বোঝার চেষ্টা করেছেন। যাতে আমাদের শরীরে তাদের আচার, আচরণ, ফন্দি, মতলব, কায়দা, কারসাজিগুলিকে বোঝা সম্ভব হয়। তা হলে সেগুলিকে জব্দ করার পথটা আমরা আগেভাগেই ভেবে রাখতে পারব। সার্স-কভ-২ ভাইরাসের জন্য এখন যে সব টিকা বা ওষুধ বানাচ্ছি সেগুলি দিয়েই রুখে দিতে পারব করোনা পরিবারের যে সদস্যরা ভবিষ্যতে আমাদের আক্রমণ করবে, তাদেরও।
সেটার জন্য দরকার করোনা পরিবারের চেনা, জানা সব সদস্যের আচার, আচরণ, ফন্দি, মতলব, কায়দা, কারসাজিগুলির মিলটা কোথায়, সেটা সবচেয়ে আগে বোঝা। সেই মিল যদি খুব কম জায়গাতেও থাকে তা হলেও সেই জায়গাগুলি চিনে ফেলা দরকার। যাতে সেই জায়গাকে লক্ষ্য করে ওষুধ প্রয়োগ করা যায়। জায়গাটিকে (বা, গুলি) ওষুধের অণুর চক্রব্যূহে বেঁধে বা আটকে ফেলা যায়, অথবা অকেজো করে দেওয়া যায়।
কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলে-মেয়ের বহু ক্ষেত্রেই মিল থাকে না আচার, আচরণে। তুতো ভাই-বোনেদের মধ্যে সেই মিলটা আরও কমে আসে। জ্ঞাতিদের ক্ষেত্রে তা আরও কম। পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর সঙ্গে আরও আরও কম। পাশের পাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে আরও আরও আরও কম।
পৃথাদের কৃতিত্ব তাঁরা করোনা পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে সেই ন্যূনতম মিলগুলিই খুঁজে বার করতে পেরেছেন। বিশ্বে প্রথম। তাদের গোটা জিনোম পরীক্ষা করে।
ওষুধ প্রয়োগের ১৫টি জায়গার খোঁজ মিলল
পৃথারা দেখেছেন করোনাভাইরাস পরিবারের ৪টি ক্যাটেগরির ৪০টিরও বেশি প্রজাতির ভাইরাসের সুদীর্ঘ আরএনএ জিনোমে আকারে ও ধর্মে একই রকমের ১৫টি জায়গা আছে (যাদের গঠন ত্রিমাত্রিক) যেখানে কোনও ওষুধ পৌঁছলে সব রকমের করোনা ভাইরাসেরই সব কায়দাকানুন, কারসাজিকেই হয়তো অকেজো করে দেওয়া যেতে পারে।
গবেষকরা কাজটা শুরু করেছিলেন সার্স-কভ-১ ভাইরাসের জিনোম নিয়ে। করোনা পরিবারের এই সদস্য হানা দিয়েছিল ২০০২ সালে। তার পর ২০১২-য় হানাদারি ছিল পরিবারের আর এক সদস্য মার্স-এর।
আরও পড়ুন- দূষিত জলে থাকা ৩ শত্রুকে হাপিশ করার পথ দেখালেন বাঙালি
আরও পড়ুন- ‘আমার তত্ত্বের ফাঁকফোকর খুঁজছি, তোমরাও খুঁজে দেখ’, এখনও বলেন জিম পিবল্স
ভাইরাসের আরএনএ-তে প্রোটিন তৈরি করার সংকেতগুলি থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আরএনএ-র কোথাও এই সংকেতগুলি রয়েছে দল বেঁধে। আবার কোথাও কোনও সংকেতই নেই। অতীতের গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রোটিন বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংকেত না থাকলে কী হবে, আরএনএ-র ওই অংশগুলিও ফন্দিবাজ প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে। তার জন্য জরুরি বার্তা (‘সিগন্যাল’) পাঠায়।
সার্স-কভ ২ ভাইরাসের কোথায় কোন প্রোটিন, কোনটিই বা আরএনএ জিনোম
কিন্তু ভাইরাসের আরএনএ-তে প্রোটিন বানানোর সংকেত নেই যে অংশগুলিতে, সেই জায়গাগুলি বেশ জটিল। সেখানকার কোনও অংশের গঠন দ্বিমাত্রিক। কোথাও বা তা ত্রিমাত্রিক। আবার কোথাও কোথাও জিনোমের অংশগুলির কোনও নির্দিষ্ট দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক গঠনই থাকে না। জায়গাগুলি অনেকটা যেন জলের স্রোতের মতো। যেন উপরে ভাসা একটা কাঠের টুকরো মুহূর্তের মধ্যে এখান থেকে ওখানে চলে যাচ্ছে।
পৃথারা ধাপে ধাপে এগোলেন। প্রথমে তাঁরা পরীক্ষাটা করলেন সার্স-কভ-২ ভাইরাসের জিনোম নিয়ে। সেই জিনোম ভাইরাসের দেহের মধ্যে রেখে (‘ইন-ভিভো’) এবং জিনোমকে ভাইরাসের দেহের বাইরে রেখে (‘ইন-ভিট্রো’)। দু’টি ক্ষেত্রে মিল খুঁজতে গিয়ে ধন্দে পড়লেন গবেষকরা। দেখলেন সার্স-কভ-২ ভাইরাসের দেহের বাইরে তার আরএনএ জিনোমের বহু অংশের গঠন ও ধর্ম যা হচ্ছে ভাইরাসের দেহের ভিতরে সেই অংশুগুলির গঠন ও ধর্ম বহু ক্ষেত্রেই বদলে যাচ্ছে। তা হলে তো ওষুধের লক্ষ্যবস্তু বদলে যাচ্ছে। ওষুধ কার্যকরী হবে কী ভাবে? ফলে ভাইরাসের দেহের বাইরে ও ভিতরে গোটা আরএনএ-র ঠিক কোন কোন অংশে অবিকল মিল থাকছে আকারে ও ধর্মে সেটা খুঁজতে শুরু করলেন পৃথারা। গোটা আরএনএ-তে পেলেন এমন মাত্র ৮৭টি অংশ। সবক’টিই দ্বিমাত্রিক। শুধু সার্স-কভ-২ ভাইরাসের ক্ষেত্রে।
এ বার পৃথারা সেই অংশগুলির সঙ্গে অবিকল মিল খুঁজতে শুরু করলেন করোনা পরিবারের সব সদস্যের গোটা আরএনএ জিনোমের অংশগুলির। মিল থাকা অংশগুলির সংখ্যা তখন আরও কমে এল। হল সাকুল্যে ৯টি। সবক’টিই দ্বিমাত্রিক।
কিন্তু যে কোনও লক্ষ্যবস্তুরই দ্বিমাত্রিক চেহারার বদলে তার ত্রিমাত্রিক চেহারাটা পেলে তাকে চিনতে, বুঝতে সুবিধা হয়। মানুষ তার হাতটা মাথায় রেখেছে নাকি বুকে সেটা তার দ্বিমাত্রিক ছবিতে বোঝা যায় না। বোঝা সম্ভব হয় মানুষটির ত্রিমাত্রিক ছবিতে।
করোনা পরিবারের সদস্যদের সংক্রমণ রুখতে ওষুধ কোন জায়গাগুলিতে হানা দিতে পারে, সেটা বুঝতে পৃথারা এর পর গেলেন দ্বিমাত্রিক অংশগুলি কোথায় কোথায় ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠতে পারে তার সন্ধানে। সুপার কম্পিউটারের মাধ্যমে, কম্পিউটার সিম্যুলেশনে।
তাতে তাঁরা লক্ষ লক্ষ ত্রিমাত্রিক গঠন পেলেন ওই মিল থাকা অংশগুলির। তাদের মধ্যে গোটা করোনা পরিবারের ৪টি ক্যাটেগরির ৪০টিরও বেশি প্রজাতির আরএনএ জিনোমে মেরেকেটে ১৫টি ত্রিমাত্রিক গঠনের জায়গা খুঁজে পেলেন গবেষকরা, যে অংশগুলি আকারে ও ধর্মে অবিকল একই রকমের।
এর ফলে, আগামী দিনে করোনা পরিবারের সদস্যদের আরএনএ জিনোমের ওই ১৫টি ত্রিমাত্রিক অংশকে বেঁধে ফেলার লক্ষ্যে ওষুধ বানানো হলে পরিবারের আপাতত অজানা, অচেনা সদস্যদের হামলাও ঠেকানোর ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে পারব আমরা আগেভাগেই।
পৃথাদের আরও কৃতিত্ব তাঁরা এখানেই থেমে যাননি। তাঁরা করোনা পরিবারের সদস্যদের আরএনএ-র সেই অংশগুলিরও খুঁটিনাটি পরীক্ষা করেছেন, যে জায়গাগুলির কোনও নির্দিষ্ট দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক গঠন নেই। অনেকটা জলের স্রোতের মতো। তাই অকেজো করার জন্য সেখানে কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ওষুধ পাঠানো সম্ভব হয় না। নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু পায় না বলে সেখানে পৌঁছে বসার জায়গাই পায় না ওষুধ।
ভাইরাসদের কারসাজি বন্ধের অন্য পথেরও হদিশ
পৃথারা দেখলেন করোনা পরিবারের সব সদস্যের আরএনএ-র ওই অংশগুলিতেও এমন ৩৬১টি জায়গা আছে, ধর্মের (‘প্রপার্টিজ’) নিরিখে যাদের মধ্যে খুব মিল। এরাও কিন্তু আমাদের শরীরে ভাইরাসদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটাতে, নিজেদের ঝটিতি বদলে ফেলতে তাদের প্রোটিনদের কার্যত মন্ত্রণা দেয়।
ফলে, এ বার কৃত্রিম ভাবে ওই জায়গাগুলির অবিকল প্রতিরূপ আরএনএ তৈরি করে সেগুলি দিয়ে জায়গাগুলিকে বেঁধে ফেলা অথবা অকেজো করে দেওয়া যাবে। আটকে দেওয়া যাবে। আরএনএ মেডিসিনের এটাই মূল ভিত্তি।
একটি স্মরণযোগ্য কাজ: অধ্যাপক গৌতম বসু
মতামতে। অধ্যাপক গৌতম বসু (বাঁ দিকে) এবং অধ্যাপক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।
কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরের বায়োইনফর্মেটিক্স-এর অধ্যাপক গৌতম বসু বলছেন, ‘‘এটাই এই গবেষণার সবচেয়ে বড় অভিনবত্ব। আমি এই গবেষণাকে শুধুই যে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি, তা নয়, এটি স্মরণযোগ্য কাজ। কোনও ভাইরাস পরিবারের গোটা জিনোম নিয়ে এর আগে গবেষণা হয়নি। ফলে, এই গবেষণা আগামী দিনে আরও অনেক গবেষণার পথ খুলে দিল। এ বার শুধু করোনা পরিবারের অন্যান্য ভাইরাসই নয়, অন্যান্য পরিবারের ভাইরাসদেরও গোটা জিনোম নিয়ে গবেষণা শুরু হবে। কারণ নিজেদের বাঁচার তাগিদেই ভাইরাসদের নতুন নতুন প্রজাতি খুঁজে নিতে হয়। যাতে বিভিন্ন প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়ে তারা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। তাই ভবিষ্যতে করোনা পরিবার তো বটেই, ভাইরাসদের অন্য পরিবারগুলির সদস্যদের হানাদারির জন্য আমরা যত আগেভাগে তৈরি থাকতে পারব ততই মঙ্গল। অন্য কোনও ভাইরাসের পরিবারের গোটা জিনোম নিয়ে গবেষণা হলে সেই ভাইরাসদেরও আগেভাগে চেনা-বোঝা আর তাদের রোখার প্রস্তুতি আমরা অনেক আগে থেকেই নিতে পারব।’’
গৌতম জানাচ্ছেন, ভাইরাসদের জিনোম বোঝার জন্য এখন নানা পদ্ধতিতে পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে। তাতে ভবিষ্যতে ওষুধ আবিষ্কারের নতুন নতুন দরজা খুলে যাবে। এই পদ্ধতিগুলির অন্যতম ‘নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স (এনএমআর)’। সম্প্রতি এই পদ্ধতিতে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের আরএনএ-র একটি অংশের ত্রিমাত্রিক গঠন দেখা সম্ভব হয়েছে। তবে সেটাও একটি অংশের মাত্র। এই গবেষকরা কিন্তু করোনা পরিবারের সব সদস্যের গোটা জিনোমটাই খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখেছেন। পরীক্ষা ও কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমে।
আক্ষরিক অর্থেই ব্রেকথ্রু গবেষণা: অধ্যাপক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
এই গবেষণা নিয়ে একই মতামত এসআইএনপি-এর বায়োফিজিক্সের অধ্যাপক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়েরও। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমত, গোটা করোনা পরিবারের সব সদস্যের আরএনএ জিনোম একেবারে ধরে ধরে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। যা এর আগে বিশ্বের কোথাও সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, ভাইরাসদের প্রোটিনগুলি আকারে ও ধর্মে দ্রুত নিজেদের বদলে ফেলে বলে করোনা পরিবারের সদস্যদের আরএনএ-র আর কোন কোন অংশকে ওষুধের টার্গেট করা যায় সেগুলি খুঁজে বার করা হয়েছে। তৃতীয়ত, সেগুলিতে পৌঁছে ছোটখাটো অণুর ওষুধ সঠিক ভাবে বসার জায়গা পাবে কি না তা বুঝতে সেই অংশগুলির স্থায়ী ত্রিমাত্রিক গঠন কোন কোন ক্ষেত্রে কতগুলি হতে পারে সেটাও দেখিয়েছেন গবেষকরা। তাই এই কাজ আক্ষরিক অর্থেই, ব্রেকথ্রু।’’
ভাইরাস গবেষণায় আলোকপাত করা পৃথাদের গবেষণা ভবিষ্যতে সব রকমের সব পরিবারের ভাইরাস রোখার নতুন নতুন অস্ত্রে শান দিতে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। হয়ে উঠতে পারে ব্রেকথ্রুই!
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।