বেরিয়ে আসছে মৃত তারার ‘প্রাণবায়ু’। গামা রশ্মি। প্রতীকী ছবি।
মৃত তারাদের ‘আত্মা’ বেরিয়ে যেতে দেখল ভারতের গর্বের উপগ্রহ ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট! এই প্রথম।
একটা-দু’টো নয়, প্রায় ৭৫ থেকে ৮০টা মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়ানো তারার (ডায়িং স্টার) শরীরের ভেতর থেকে তাদের ‘প্রাণবায়ু’ বেরিয়ে যাওয়ার সাক্ষী থাকতে পেরেছে অ্যাস্ট্রোস্যাট! তাদের ছবিও তুলেছে। পাঠিয়েছে তাদের বর্ণালীর ছবি। এই ব্রহ্মাণ্ডের একেবারে কিনার (এজ) থেকে।
আমাদের বাঁচা, মরা আছে। তারাদেরও আছে।
আমাদের কেউ কেউ ‘আত্মা-টাত্মা’য় বিশ্বাস করেন! কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পর আমাদের শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে যায় ‘প্রাণবায়ু’। সেই ‘প্রাণবায়ু’ বা ‘আত্মা-টাত্মা’কে চাক্ষুষ করার অনেক সাধ্য-সাধনা হয়েছে। মৃতপ্রায় মানুষকে একেবারে তাঁর অন্তিম মুহূর্তে কাচের বাক্সে বন্দি করে রেখে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, মানুষটির মৃত্যুর পর ওই কাচের বাক্সে চিড় ধরেছে! যা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে, আমাদের মৃত্যু হলে ‘প্রাণবায়ু’ বা যা কারও কারও বিশ্বাস বা অতি-বিশ্বাসে ‘আত্মা’, তা কাচের বাক্সে চিড় ধরিয়ে বেরিয়ে যায়! কিন্তু তা হাতে-কলমে প্রমাণ করা যায়নি এখনও।
মৃত তারার সেই ‘প্রাণবায়ু’ বা ‘আত্মা’!
কিন্তু ৭৫ থেকে ৮০টি তারার ‘আত্মা’ বেরিয়ে যাওয়ার যে ছবি তুলে পাঠিয়েছে অ্যাস্ট্রোস্যাট, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) দ্বিগুণ উচ্চতায় থেকে পৃথিবীকে পাক মারতে মারতে, তাতে ‘আত্মারাম খাঁচা’ হয়ে যাওয়ার জোগাড়! মহাকাশে ভারতের ‘সচিন তেন্ডুলকর’- অ্যাস্ট্রোস্যাট এত দিন যে সব ‘ইনিংস’ খেলেছে, তাতে তারাদের ‘প্রাণবায়ু’ বেরিয়ে যাওয়ার ছবি তোলাটাই তার ‘সেরা পারফরম্যান্স’ বলে মনে করছেন দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
যখন গামা রশ্মি ‘সার্চ লাইট’। খবর দিচ্ছে নতুন পালসারের
ব্ল্যাক হোলের রাক্ষুসে খিদে মেটাচ্ছে কোনও হতভাগ্য তারা!
ব্ল্যাক হোলের ‘শিকার’ হওয়া তারার ‘প্রাণবায়ু’ (সাদা স্রোত)
তারার শরীর ছিঁড়ে খাচ্ছে ব্ল্যাক হোল! (হলুদ আলো তারার দেহাবশেষ)
ভারতের গর্বের উপগ্রহ অ্যাস্ট্রোস্যাটের সায়েন্টিফিক অপারেশনের প্রধান, পুণের ‘দ্য ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে’র (আয়ুকা) অধ্যাপক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘আপাতত এটাই অ্যাস্ট্রোস্যাটের সেরা পারফরম্যান্স। এই ব্রহ্মাণ্ডের একেবারে কিনার থেকে প্রায় ৮০টি তারা বা নক্ষত্রের ‘অন্তিম শয্যা’র ছবি তুলে আনতে পেরেছে অ্যাস্ট্রোস্যাট। তুলে আনতে পেরেছে অত্যাশ্চর্য বিস্ফোরণের ছবি। যাকে বলে ‘গামা রশ্মি বিস্ফোরণ’ (গামা রে’ বার্স্ট বা জিআরবি)। আদিগন্ত মহাকাশের অতলান্ত আঁধারে ওই গামা রশ্মিই আমাদের পথ দেখায়। নতুন নতুন মহাজাগতিক বস্তুর হদিশ পেতে। যাকে ‘সার্চ লাইট’ও বলা যায়। উত্তোলনের সময় যেমন ‘সার্চ লাইট’ নিয়ে কয়লা খনিতে নামতে হয় শ্রমিকদের, ঠিক তেমনটাই। ওই গামা রশ্মিই তেমন আমাদের বলে দেয়, কোথায় কোথায় রয়েছে তারা। কোথায় কোথায় আর ক’টা রয়েছে ব্ল্যাক হোল। সঠিক ভাবে বললে, কোথায় কোথায় ছিল। কারণ, সেই রশ্মি যখন বেরিয়েছিল, তার অনেক অনেক পর তা ধরা পড়েছে অ্যাস্ট্রোস্যাটের ‘চোখে’। রশ্মিকেও তো অনেকটা পথ ছুটতে হয় মহাকাশে। তাতেও তো সময় যায়।’’
তারাদের জীবনচক্র
গামা রশ্মি কতটা শক্তিশালী
তারাদের মৃত্যুটাও বেশ অদ্ভুত রকমের। যখন তার গনগনে আঁচে জ্বলার মতো জ্বালানি উত্তরোত্তর ফুরিয়ে আসে, তখন তার ভীষণ রকমের কঠিন ‘হৃদয়’টাই (কোর) ধীরে ধীরে হয়ে যায় ব্ল্যাক হোল (অনেক সময়ে তা নিউট্রন নক্ষত্রও হতে পারে। তবে তা অন্য প্রসঙ্গ)। যার রাক্ষুসে খিদে। যাকে পারে তাকে খায়। যে তার আশপাশে, ধারে-কাছে আসে, তাকেই এক ঝটকায় তার ‘মুখে পুরে’ ফেলে ব্ল্যাক হোল। তার পর তাকে গিলেও ফেলে ব্ল্যাক হোল। তার রাক্ষুসে খিদের হাত থেকে নিস্তার নেই কারও। আলোও তার খিদে এড়াতে পারে না। চলে যায় ব্ল্যাক হোলের ‘পেটে’! আলো ব্ল্যাক হোলের থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না বলেই ব্ল্যাক হোল একেবারে ‘কৃষ্ণকলি’ কালো! (যদিও পরে স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, ‘ব্ল্যাক হোলস আর নট সো ব্ল্যাক’।) তবে সেই ব্ল্যাক হোলও কিছু কিছু জিনিস উগড়ে দেয়। সেও ‘বিকিরণ করে’। চেটেপুটে খাওয়ার পর আমরা যেমন ভাতের থালার ধারে এঁটোকাঁটা ফেলে রাখি, তেমনই মৃত্যুপথযাত্রী তারাটির শরীরের বাইরের় দিকে যতটা শাঁস-আঁশ ছিল, তা পেটপুরে খাওয়ার পর ওই মৃত তারার ছিন্নভিন্ন দেহের অংশবিশেষ ভাতের থালার ধারে এঁটোকাঁটা ফেলার মতো ব্ল্যাক হোলও তা ছিটিয়ে দেয় তার অ্যাক্রিশান ডিস্কে। ব্ল্যাক হোল ঘুরছে। আর মৃতপ্রায় তারাটাও ঘুরতে ঘুরতে চলে যাচ্ছে তারই বানানো ব্ল্যাক হোলের রাক্ষুসে পেটে। যেন ইচ্ছামৃত্যু! আর সেই সময়ই ব্ল্যাক হোলের অ্যাক্রিশান ডিস্কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার দেহাবশেষগুলো গামা রশ্মির বিকিরণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে।
ব্ল্যাক হোল যেখানে ‘এঁটোকাঁটা’ ছড়িয়ে রাখে, সেই ‘অ্যাক্রিশান ডিস্ক’
অ্যাস্ট্রোস্যাটের ‘চোখে’ ধরা পড়া তারাদের সেই ‘প্রাণবায়ু’র ছবি। সৌজন্যে: ইসরো।
আর সেই ভাবেই মহাকাশে, মহাবিশ্বে ওই গামা রশ্মি হয়ে ওঠে ‘রানার’। বার্তাবাহক। ‘রানার ছুটেছে, তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’! রানারের লাঠিতে বাঁধা ঘণ্টার আওয়াজ যেমন গভীর রাতেও বুঝিয়ে দিত, রানার ছুটে যাচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে আর নিয়ে যাচ্ছে চিঠি। যার মাধ্যমে এ প্রান্তের পাঠানো বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে ও প্রান্তে। ঠিক তেমনই গামা রশ্মিই হয়ে ওঠে এই ব্রহ্মাণ্ডের ‘রানার’! কোথায় কোন তারার মৃত্যু হয়েছে, আর সেই মৃত তারা থেকে জন্ম নিয়েছে আরও একটি ব্ল্যাক হোল, তার বার্তা বয়ে নিয়ে বেড়ায়, বার্তা বয়ে নিয়ে আসে আমাদের কাছে। তাই গামা রশ্মির হদিশ পাওয়াটাই কার্যত ‘মোক্ষলাভ’ হয়ে দাঁড়ায় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে। এই গামা রশ্মিই মৃত তারাদের ‘আত্মা’ বা ‘প্রাণবায়ু’!
‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর সায়েন্স অপারেশনের প্রধান দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (বাঁ দিকে) ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুকান্ত বোস
মহাকাশের ‘সচিন তেন্ডুলকার’- অ্যাস্ট্রোস্যাট
দীপঙ্কর বলছেন, ‘‘অ্যাস্ট্রোস্যাট সত্যি-সত্যিই আমাদের চমকে দিয়েছে। এখন মাসে ২ থেকে ৪টি করে নতুন নতুন গামা রশ্মি বিস্ফোরণের ঘটনা খুঁজে বের করতে পারছে অ্যাস্ট্রোস্যাট। এ বছর হয়তো মাসে পাঁচটি করে এমন ঘটনা আমাদের জানাতে পারবে অ্যাস্ট্রোস্যাট।’’
আরও পড়ুন- ‘ঈশ্বরের রাজ্যে’ বসেই এ বার ভিন গ্রহ খুঁজবেন বিজ্ঞানীরা!
দীপঙ্করের সঙ্গে একমত পুণের ‘আয়ুকা’র অধ্যাপক আরও এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুকান্ত বোস। প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কারে যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁদের অন্যতম সুকান্তের কথায়, ‘‘এ বছর আরও বড় সাফল্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অ্যাস্ট্রোস্যাট। এ বার হয়তো তা কোনও মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উৎসের ‘দোসর’ তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গটা (ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক কাউন্টারপার্ট) ব্রহ্মাণ্ডের কোথা থেকে আসছে, তারও হাল-হদিশ জানাতে পারবে আমাদের। আর সেটা হলে তো একেবারে সোনায় সোহাগা! মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অনেক কিছুই ভাল। তা অনেক দূরের ঘটনার তথ্য জানিয়ে দিতে পারে। বড় জলাশয়ের কোথাও না কোথাও কোনও এক সময়ে যে ঢিল পড়েছিল, তার পাড়ে তার বার্তা অনেক পৌঁছয় ঠিকই জল-তরঙ্গের মাধ্যমে, কিন্তু পৌঁছয়।
‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’... ব্ল্যাক হোলের খিদে মেটাচ্ছে তারা!
ফলে তা দেখে এটুকু অন্তত বলাই যায়, জলাশয়ের কোথাও না কোথাও কোনও এক সময়ে একটা বড় ঢিল পড়েছিল। তাই তরঙ্গের জন্ম হয়েছিল আর তা বৃত্তাকারে ছোট থেকে বড়, তা থেকে বড়, আরও বড় হয়ে জলাশয়ের পাড়ে পৌঁছেছে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দেখেও তার উৎসটা ঠিক কতটা দূরে, তা ঠিকঠাক বোঝায় যায় না। কিন্তু তার ‘দোসর’ তড়িৎ-চু্ম্বকীয় তরঙ্গের হদিশ পাওয়া গেলে সেই মনোবা়ঞ্চাও আমাদের পূর্ণ হবে। এ বার অ্যাস্ট্রোস্যাট হয়তো সেই ষোলো কলাও পূর্ণ করতে পারবে।’’
তারাদের ‘আত্মা’র রকমফের: অ্যাস্ট্রোস্যাটের নজরে পড়া গামা রশ্মির বর্ণালী। সৌজন্যে: আয়ুকা।