মধ্যবিত্তের হেঁশেল অনেক আগে থেকেই এমন এক যন্ত্র এক কোণে জায়গা করে নিয়েছে, যা অনেক সমস্যাই সহজ করে দিতে পারে। কিন্তু তাকে সে ভাবে পাত্তা দেওয়া হয় না।
প্রতি মাসেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে গ্যাসের দাম। এখন সিলিন্ডার পিছু ১০৭৯ টাকা দিতে হচ্ছে পকেট থেকে। মধ্যবিত্তের কপালে ভাঁজ পড়েছে বহু দিনই। বাঙালির ঘরে ঘরে এখন একটাই চিন্তা— মাংস কষা, আলুর দম, সর্ষে মাছের মতো প্রিয় পদগুলি কি খাওয়া মাথায় উঠল তা হলে? গ্যাসের খরচ তো টানাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু মধ্যবিত্তের হেঁশেল অনেক আগে থেকেই এমন এক যন্ত্র এক কোণে জায়গা করে নিয়েছে, যা অনেক সমস্যাই সহজ করে দিতে পারে। কিন্তু তাকে সে ভাবে পাত্তা দেওয়া হয় না। এই যন্ত্রটি হল মাইক্রোওয়েভ। এখন ঘরে ঘরে দেখা যায়। কিন্তু এর কদর বোঝেন না অনেকেই। সারা দিন নিজের মতো পড়ে থাকে। মাঝেমাঝে শুধু যে যার মতো নিজের খাবার ফ্রিজ থেকে বার করে এতে গরম করে নেন। কিন্তু এই যন্ত্রে দিব্যি তৈরি হয়ে যায় রোজের অনেক রান্নাই। তবে বেশির ভাগ মানুষ সে সম্পর্কে খুব একটা জানেন না।
শহরের পরিচিত খাদ্যারসিক এবং ফুড ব্লগার পূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ে বললেন, ‘‘আগে মা-ঠাকুরমারা প্রতি দিন আট থেকে ১০ জনের জন্য রান্না করতেন। কিন্তু এখন বেশির ভাগ সংসারই ছোট। কম রান্নার প্রয়োজন। যে কোনও ছোট সংসারের জন্য মাইক্রোওয়েভ কিন্তু দারুণ বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এই যন্ত্রটি কেনার পর বেশির ভাগ মানুষ ঠিক করে এই নিয়ে পড়াশোনাই করে না। যদি করত, তা হলেই বোঝা যেত মাইক্রোওয়েভে কী সহজে আলু সেদ্ধ করে ফেলা যায়, ভাত, পোলাও বানিয়ে ফেলা যায়, তিন মিনিটে কেক বানিয়ে ফেলা যায়। যে রান্না করতে গ্যাসে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগবে, তেমন রান্না সহজেই মাইক্রোওয়েভে করা সম্ভব। তা হলে আমি খালি খালি এত বেশি খরচ করে গ্যাসে রান্না করব কেন!’’
যে কোনও ছোট সংসারের জন্য মাইক্রোওয়েভ কিন্তু দারুণ বন্ধু হয়ে উঠতে পারে।
এক মত আরও এক ফুড ব্লগার সায়ন্তনী মহাপাত্রও। তিনি বললেন, ‘‘আমি তো অনেক রান্নাই মাইক্রোওয়েভে সেরে নিই। খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। মাছ বিশেষ করে খুব ভাল হয় মাইক্রোওয়েভে। চিংড়ি ভাপার কথা অনেকেই জানেন। তবে অনেকেই যেটা জানেন না, তা হল খুব টাটকা তেলাপিয়ার মতো মাছ যদি পাওয়া যায়, তা হলে মাইক্রোওয়েভে দারুণ হবে। অল্প লোকের জন্য পোলাও খুব তাড়াতাড়ি আর খুব ভাল রান্না হয়। তবে সবচেয়ে সুবিধা ভাত করা। যাঁরা প্রেশার কুকারে রান্না করেন, তাঁরা যদি এক কাপ চালের সঙ্গে দেড় কাপ জল দেন, তা হলে মাইক্রোওয়েভে দিতে হবে দু’কাপ জল। প্রথমে ৫ মিনিট হাই টেম্পারেচারে, তার পর ১০ মিনিট মিডিয়াম টেম্পারেচারে ঘুরিয়ে নিলেই একদম ঝরঝরে ভাত তৈরি। কোনও ঝামেলাই নেই। গ্যাসের খরচও অনেকটাই বাঁচে।’’
মাইক্রোওয়েভে সাধারাণত শুকনো রান্না, সিদ্ধ করা, বেক করা বা রোস্ট করা সহজেই সম্ভব। যেহেতু এই যন্ত্রে রেডিয়েশন দিয়ে খাদ্যকণা ভেঙে দেওয়া হয়। তাই তাড়াতাড়ি যে কোনও খাবারই সিদ্ধ করা সম্ভব। বেকিং, রোস্টিং, বা যে কোনও ভাপা রান্না করার জন্য মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করা যায়। তবে মাইক্রোওয়েভে রান্না করার সময়ে কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে।
বিনা পরিশ্রমে আগুনের সামনে না দাঁড়িয়ে মাইক্রোওয়েভে সহজেই রান্না সেরে ফেলা যায়।
মাইক্রোওয়েভে রান্না করলে কী কী জিনিস মাথায় রাখবেন?
দিল্লির বাসিন্দা শমিতা হালদার অনলাইনে রান্নার ক্লাস করানো শুরু করেন। অনেক বাচ্চা এবং কিশোর-কিশোরীও তাঁর ছাত্র-ছাত্রী। তাই অনেক রান্নাই তিনি মাইক্রোওয়েভেই শেখান। শমিতা বললেন, ‘‘যেহেতু বিনা পরিশ্রমে আগুনের সামনে না দাঁড়িয়ে মাইক্রোওয়েভে সহজেই রান্না সেরে ফেলা যায়, তাই অনেকেই আমার এই ক্লাসগুলি বেশি পছন্দ করে। কী করে মাইক্রোওয়েভে ডাল বা কড়াই পনির বা পোহা-ব্রেড ওমলেট করতে হয়, তা আমি মাঝেমাঝেই শেখাই। তেল কম লাগে, সময় তো কম লাগেই।’’
শমিতার কথায়, মাইক্রোওয়েভে রান্না করা খুবই সহজ। কিন্তু কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। সেগুলি কী, জেনে নিন।
শমিতার মাইক্রোওয়েভে তৈরি বিভিন্ন পদ। নিজস্ব চিত্র
১। স্টিল বা অন্য কোনও ধাতুর বাসন ব্যবহার করবেন না। মাইক্রোওয়েভ প্রুফ লেখা থাকলেও প্লাস্টিকের বাসনও এড়িয়ে চলাই ভাল।
২। কতটা তাপমাত্রায় রান্না করছেন, তা খেয়াল রাখতে হবে। সব খাবার কিন্তু হাই টেম্পারেচারে রান্না করলে চলবে না। সে কথা মাথায় রাখতে হবে।
৩। মাঝেমাঝেই রান্নার মাঝে একটু খেয়াল রাখতে হবে। ৫ মিনিট ঘুরিয়ে নিয়ে আর একটু নেড়েচেড়ে ফের ঘুরিয়ে নিন। এ ভাবে যে কোনও রান্না মাঝেমাঝে দেখে নিন।
৪। জলের পরিমাণ মাথায় রাখতে হবে। খুব বেশি জল দিলেও উপচে পড়তে পারে। আবার খুব কম জল দিলেও চলবে না। কারণ মাইক্রোওয়েভে যে কোনও খাবার একটু শুকনো করে দেয়।
৫। কত ক্ষণ ধরে রান্না করছেন, খেয়াল রাখুন। সব রান্নার জন্য কিন্তু একই রকম সময় লাগবে না।
মাইক্রোওয়েভে কিছু সহজ রান্না
ডাল (প্রণালী: শমিতা)
প্রথমে ডাল ভাল করে ধুয়ে আধ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। তার পর নুন-হলুদ দিয়ে জল দিয়ে পাঁচ থেকে ছ’মিনিট ঘুরিয়ে নিন। গলে গেলে পাত্রে একটু তেল, ফোড়ন আর পেঁয়াজ দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে তিন মিনিট মতো ঘুরিয়ে নিলেই ডাল তৈরি।
ডাল মাইক্রোওয়েভে করার সময়ে জলের পরিমাণটা ভাল করে দেখে নিতে হবে।
সর্ষে তেলাপিয়া (প্রণালী সায়ন্তনী মহাপাত্র)
টাটকা তেলাপিয়া লেবুর রসে ম্যারিনেট করে রাখুন। তার পর দই আর সর্ষে-পোস্ত বাটা দিয়ে প্রথমে তিন মিনিট ঘুরিয়ে নিন। তার পর বাকি মশলা দিয়ে আরও দু’মিনিট ঘুরিয়ে নিন। এর পর পেঁয়াজ বাটা, রসুন বাটা, টম্যাটো দিয়ে আরও সাত মিনিট ৭৫০ ডিগ্রি টেম্পারেচারে ঘুরিয়ে নিলেই চমৎকার মাছের পদ তৈরি।
টাটকা মাছ হলে মাইক্রোওয়েভে সহজেই সর্ষে ভাপার মতো রেসিপি তৈরি করতে পারেন।
দই চিকেন (প্রণালী পূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়)
দই, আদা-পেঁয়াজ-লঙ্কা বাটা, নুন গোলমরিচ এবং বাকি মশলা দিয়ে চিকেন ম্যারিনেট করে রাখুন। তার পর মাইক্রোওয়েভে দিয়ে উপর থেকে দু’তিন চামচ মাখন দিয়ে আট মিনিট ঘুরিয়ে নিন। কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা চিরে আরও দু’মিনিট ঘুরিয়ে নিন। তা হলেই চিকেন তৈরি।
মাইক্রোওয়েভে খুব সহজেই চিকেনের পদ বানিয়ে ফেলা যায়।