চাইনিজ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্যুইজিন। নিজস্ব চিত্র।
যে শহরের অলি-গলিতে একটা করে চাইনিজ দোকান রয়েছে, রাস্তায় সস্তার চাউমিনের ছড়াছড়ি, সেখানেই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন আমবাঙালিকেও চাউমিন খাওয়াবেন ফাইন ডাইনিংয়ে বসে। খরচ হবে সাধ্যের মধ্যে, অভিজ্ঞতা হবে উচ্চ মানের। সেই স্বপ্ন সত্যি করে দেখিয়েছেন জনপ্রিয় রেস্তরাঁ চেন-এর কর্ণধার দেবাদিত্য চৌধুরী।
কেরিয়ার শুরু করেছিলেন সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে। কিন্তু জীবনটা ছিল খাবার ঘিরেই। খাওয়াদাওয়া নিয়ে একটি শোয়ের সঞ্চালনা করতেন। ‘লক্ষ্মীছাড়া’ ব্যান্ডের সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে শোয়ের ফাঁকেই বিভিন্ন দেশের খাবার চেখে দেখতেন। ইচ্ছা ছিল, একটি ছোট্ট রেস্তরাঁ খোলার। শহরবাসীকে একটু অন্য রকম কিছু খাবার খাওয়ানোর। কিন্তু পকেটের জোর তখন সে ভাবে ছিল না। তাই কোথায় রেস্তরাঁ খোলার জন্য জায়গা পাওয়া যাবে, তা বুঝতে পারছিলেন না। মাথায় নতুন ভাবনার অভাব ছিল না। রেস্তরাঁ কেমন হবে, কোথা থেকে সরঞ্জাম আসবে, কী মেনু হবে, অন্দরমহল কেমন হবে, সে সব ছকে ফেলেছিলেন রেস্তরাঁ খোলার ২-৩ বছর আগেই। অবশেষে গল্ফ ক্লাব রোডে ফাঁকা মাঠে একটা জায়গা পেয়ে রেস্তরাঁ খোলার সাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। যদিও সে সময়ে অনেকেই বলেছিলেন ওই জায়গায় রেস্তরাঁ কোনও দিন চলতে পারে না। কিন্তু সে সব পাত্তা দেননি। আর খোলার পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি দেবাদিত্যকে।
গল্ফ ক্লাব রোডে ফাঁকা মাঠে একটা জায়গা পেয়ে রেস্তরাঁ খোলার সাহস দেখিয়েছিলেন জনপ্রিয় রেস্তরাঁ চেন-এর কর্ণধার দেবাদিত্য চৌধুরি। নিজস্ব চিত্র।
এক মাসের মধ্যে সেই ছোট্ট রেস্তরাঁর সামনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভিড় জমা শুরু হল। সেই ভিড় বারো বছর পরও দেখা যায়। টলিপাড়ার কাছাকাছি হওয়ায় রেস্তরাঁ তারকাদের ভিড়ও কম হত না। লোকমুখে সুখ্যাতি এমন ছড়াল যে, খুব তাড়াতাড়ি হোম ডেলিভারির হিড়িক সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ল। দেবাদিত্যের কথায়, ‘‘সে সময়ে আমি একটা ক্লাউড কিচেন শুরু করি। এ শহরে ক্লাউড কিচেনের ভাবনাটা কিন্তু আমারই প্রথম। হয়তো এই নামটা তখন ব্যবহার হত না। আরও একটা বিষয়ে আমরা এগিয়ে ছিলাম— নিজেদের ডেলিভারি। সুইগি-জোম্যাটো তো অনেক পরে এসেছে। তার আগেই আমাদের নিজস্ব ডেলিভারি ব্যবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন শহরে আমাদের একশোটার বেশি বাইক চলে। আমাদের গ্রাহকরা যে কোনও সময়ে ফোন করে বা অ্যাপের মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে সরাসরি অর্ডার করতে পারেন। আমরা ঠিক খাবার পৌঁছে দেবো।’’
‘চাওম্যান’ স্পেশাল কলকাতা স্টাইল চিলি চিকেন। নিজস্ব চিত্র।
এত বিপুল সাফল্যের চাবিকাঠি কী? দেবাদিত্য বুঝিয়ে বললেন, ‘‘আমরা যখন পছন্দের ব্র্যান্ডের পিৎজা অর্ডার করি, আমরা আশা করি দিল্লি-মুম্বই-কলকাতা, সব জায়গার পিৎজাই একই রকম হবে। কিন্তু চাইনিজ খাবারের সে রকম কোনও চেন ছিল না। আমরা সেই চেষ্টাই করেছি। ব্যারাকপুর-সোদপুর থেকে দক্ষিণে সোনারপুর পর্যন্ত— যেখানকার শাখা থেকেই অর্ডার করুন না কেন, চাওম্যান-এর সব খাবারে একই স্বাদ, একই দাম এবং একই পরিমাণে পাবেন।’’ কিন্তু সব শাখা থেকে খাবারের এক স্বাদ পাওয়া তো মুখের কথা নয়। অনেক নামী হোটেলের খাবারের স্বাদও সব শাখা থেকে এক রকম পাওয়া যায় না। একই রকম রন্ধনশিল্পী পাওয়া কি সম্ভব? দেবাদিত্যের উত্তর, ‘‘হাতের রান্না একটু এ দিক-ও দিক হতেই পারে। কিন্তু আমাদের মশলাপাতি সব এক জায়গা থেকে আসে। সস-ও সব এক জায়গা থেকে বানানো হয়। তাই স্বাদের খুব একটা হেরফের হয় না।’’
বেঙ্গালুরুর ইন্দিরানগরে ‘চাওম্যান’। নিজস্ব চিত্র।
ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও রকম আপস করেননি ‘চাওম্যান’-এর কর্ণধার। অনেক টাকা খরচ করে আমদাবাদের অ্যাপ প্রস্তুতকারী সংস্থাকে দিয়ে নিজস্ব ডেলিভারি অ্যাপ তৈরি করেছেন। কলকাতার পাশাপাশি বেঙ্গালুরু এবং দিল্লিতেও খুলেছে রেস্তরাঁর বিভিন্ন শাখা। ২০২৫-এর মধ্যে হায়দরাবাদ, চেন্নাই, চণ্ডীগড়ের মতো বাকি মোট্রো শহরগুলিতেও শাখা খুলে ফেলার লক্ষ্য রয়েছে সকলের। সে সবের জন্য একটা বড় টিমও গড়েছেন দেবাদিত্য। রয়েছে নিজস্ব আইটি-টিমও। দেশজুড়ে যেখানেই রেস্তরাঁ হোক না কেন, সব কাজের তদারকি হবে কলকাতার অফিস বসেই। সে ভাবেই এগোচ্ছে ‘চাওম্যান’।
‘চাওম্যান’-এ রয়েছে নানা রকম চাইনিজ পদের সম্ভার। নিজস্ব চিত্র।
চাইনিজ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্যুইজিন। তাই শুরুটা করেছিলেন সেই খাবার দিয়েই। তবে এখন মেনুতে দক্ষিণ-পূর্বের আরও অনেকে দেশের খাবারও পাওয়া যাচ্ছে ‘চাওম্যান’-এ। কোরিয়া, জাপান, তাইল্যান্ড— সব দেশের খাবার নিয়েই আগ্রহ বেড়েছে মানুষের। কেউ তাইল্যান্ডে ছুটি কাটাতে গিয়ে, কেউ নেটফ্লিক্সে সিরিজ দেখে উৎসাহ পেয়েছেন এ সব খাবার চেখে দেখার। সেই সুযোগটা লুফে নিয়েছেন দেবাদিত্য।
‘চাওম্যান’-এর ভক্ত যাঁরা, তাঁরা অন্য জায়গার চাইনিজ আর সে ভাবে খেতে চান না। এ বিষয়ে দেবাদিত্য যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু এতটা জোর দিয়ে কী করে এটা বলা যায়? বেশ কিছু টোটকা ছিল কর্ণধারের কাছে। তিনি জানেন বাঙালি টাকাপয়সা নিয়ে খুব স্পর্শকাতর, খাবার নিয়ে খুঁতখুঁতে, এবং খাবার একটুও খারাপ হলে বা চিলি চিকেনের পিস একটুও ছোট হলে সমালোচনা করতে ছাড়বে না। তাই অন্য রেস্তরাঁ যেখানে ১০ টাকা লাভ করে, ‘চাওম্যান’ লাভ রাখে ৬ টাকার। অবশ্য লাভের পরিমাণ এত বেশি যে, পুষিয়ে যায়। মাঝেমাঝেই খাবার চেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে সংস্থার হেডকোয়ার্টারে। কোনটা আরও ভাল করা যায়, সেই প্রয়াসই চলে। বাজারে সরঞ্জামের মূল্য বাড়লেও খাবারের দাম বাড়ানো হয় না। চেষ্টা চলে প্রযুক্তির সাহায্য সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তাতে ব্যবসার ক্ষতি কখনওই হতে দেননি। অতিমারিতেও ব্যবসা বিস্তার করেছেন। প্রত্যেক কর্মীকে তাঁদের প্রাপ্য বেতন এবং বোনাস দেওয়া হয়েছে। যখন অন্য অনেক রেস্তরাঁ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, সে সময়ে ‘চাওম্যান’ আরও শাখা খুলেছে।
বারো বছরে অনেক কিছু বদলাতে দেখেছেন দেবাদিত্য। তাঁর চারপাশের মানুষের ব্যবহার-আচরণ বদলে গিয়েছে সাফল্যের সঙ্গে। তবে কিছু জিনিস এখনও বদলায়নি। যেমন দেবাদিত্যর প্রিয় খাবার এখনও তাঁর মায়ের হাতের চিলি চিকেন! নিজের রেস্তরাঁর মেনুতে শয়ে শয়ে পদের মাঝেও এখনও এই পদটার জন্য মন ছটফট করে ‘চাওম্যান’-এর স্রষ্টার।