সেন্সর ও প্যাঁক-প্যাঁক

ছোট স্ক্রিনে ছেষট্টি আইন ভ্যানিশ হয়ে গেলে কী হবে, সিনেমার পরদায় সেন্সরবাজি ফুল ফর্মে। ওখানে মূল্যবোধ রক্ষার কাজটা ক্রিটিকাল, কারণ অবক্ষয় ক্রমশ মহামারীতে পরিণত। আধুনিক যুবসমাজ সংস্কৃতি বলতে যাদবপুরের ফেস্ট বোঝে, সান্ধ্যভাষা মানে ফিফটি শেডস অব গ্রে। স্লিভলেস যুবতীরা পিকে বলতে বিশুদ্ধ ভোকাল টনিকের বদলে রেডিয়ো-পরিহিত নগ্ন ব্যাটাছেলে ভাবে। গোটা জীবজগতেই পশ্চিমি বেলেল্লাপনার রমরমা।

Advertisement

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০১:১৩
Share:

ছোট স্ক্রিনে ছেষট্টি আইন ভ্যানিশ হয়ে গেলে কী হবে, সিনেমার পরদায় সেন্সরবাজি ফুল ফর্মে। ওখানে মূল্যবোধ রক্ষার কাজটা ক্রিটিকাল, কারণ অবক্ষয় ক্রমশ মহামারীতে পরিণত। আধুনিক যুবসমাজ সংস্কৃতি বলতে যাদবপুরের ফেস্ট বোঝে, সান্ধ্যভাষা মানে ফিফটি শেডস অব গ্রে। স্লিভলেস যুবতীরা পিকে বলতে বিশুদ্ধ ভোকাল টনিকের বদলে রেডিয়ো-পরিহিত নগ্ন ব্যাটাছেলে ভাবে। গোটা জীবজগতেই পশ্চিমি বেলেল্লাপনার রমরমা। কুকুররা যত্রতত্র লিভ-ইন করে, কাক নিজের বাবাকেও সন্দেহবশত কা-কা বলে ডাকে। আধুনিক ছাগলীরা মূলত ব্যভিচারিণী বলে কনফিউজড ছাগল-ছানা আহ্লাদে গলে গিয়ে যাকে-তাকে ব্যা-ব্যা সম্বোধন করে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে রিয়েলিটি থেকে সম্পূর্ণ চোখ-কান বুজে মানুষের শুভবুদ্ধি ফেরানোর কাজে কাঁচি-হাতে যাঁরা ব্রতী, তাঁদেরই সেন্সরওয়ালা বলে। সমগ্র জীবজগত নিয়েই কারবার বলে এই পুলিশদের মরালও বলা হয়। ইদানীং এঁদের দাপটে সিনেমায় কেবলমাত্র নির্বাক ছাগল দেখানো হয়, কাক সতত বা-বা বলে, কুকুররা যৌথ পরিবারে আস্থা ফিরে পায়। বদ লোকে চার-অক্ষর উচ্চারণ করে না। হল-ভর্তি গুরুজনদের সামনে ভুল করে সিগারেট খেয়ে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে ‘ইহা খুব ক্ষতিকারক’ বলে মুচলেকা দিতে হয়। যৌন ব্যভিচারের প্রশ্নই নেই, ফিফটি শেডস অব গ্রে-র মতো পশ্চিমি অপসংস্কৃতিকে কান ধরে বার করে দেওয়া হয়। মেয়েরা শরীর খোলার কথা ভাবতেই পারে না, সিরিয়ালে কুমারীরা শিবরাত্রি আর বিবাহিতারা ঘোমটা দিয়ে তুলসীতলায় সন্ধ্যারতি করে।

Advertisement

নারীশরীরের অন্য নাম অশ্লীলতা, তাকে ঢেকেঢুকে রাখাই মূল্যবোধের স্তম্ভ। নানা ভাষায় নানা রকম প্যাঁক-প্যাঁক করলেও নারীশরীর যে নরকের দ্বার, এ ব্যাপারে সব মরালেরই এক রা। নানা রূপে এই মরালবাণী প্রকাশিত। বিদেশি সিনেমায় নারীশরীর প্রদর্শন বন্ধ করার মরালকে ভারতীয় সংস্কৃতি বলে। আর কর্পোরেট বিজ্ঞাপনে প্রগতিশীল স্লোগান দিয়ে আটকালে তার নাম পণ্যায়ন বিরোধিতা। ‘পাড়ার মেয়ে বাইরে যাবে না’ বলে চোখ রাঙালে হরিয়ানায় তাকে বলে খাপ পঞ্চায়েত, কলকাতায় রকবাজি। আর ফেমিনিস্ট মরালীরা ‘ভারতের কন্যা বিবিসিতে যাবে না’ বলে আগুন জ্বালালে তাকে উদারনৈতিকতা, সরকার বাগড়া দিলে দেশপ্রেম বলা হয়। নাম যা-ই হোক, এ ব্যাপারে সব মরালই খুব কড়া, তাঁরা জালিম দুনিয়া থেকে দুধটুকু শুষে নিয়ে জনকল্যাণে বরাদ্দ করেন, যে জন্য সেন্সরবাজদের পরমহংসও বলা হয়। দুধের গুণাগুণ নিয়ে প্রশ্ন করলে তাঁরা বক দেখিয়ে একঘরে করে দেন, যাকে পরিভাষায় ‘হংসমধ্যে বক’ দশা বলে। তখন পাপীদের মাথায় বজ্রাঘাত হয়, চ্যানেল লাটে তুলে প্রাইম-টাইমে শুধু মোমবাতি দেখাতে হয়। সে জন্য বেকার যুদ্ধ না করে এর সামনে নতজানু হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, কারণ এই মরাল অজেয় অমর ও অক্ষয়। আগুন ইহাকে পোড়াতে পারে না, জল ভেজাতে পারে না, শুধু স্থান ও কাল বিশেষে নানা রূপ ধারণ করে, যে জন্য সেন্সরবাজির অন্য নাম ন হন্যতে।

Advertisement

bsaikat@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement